বিলকিস / Bilkis Bano

গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসে ৫৯ জন করসেবকের জ্যান্ত পুড়ে মারা যাওয়ার পর, গুজরাটে তখন চলছে রায়ট। দিনটা ৩ মার্চ, ২০০২। বিলকিস সেদিন পালাচ্ছিল পরিবারের সাথে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আশ্রয় বলতে মাঠের পাশের একটা ঝোপ, সেটাকে আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ লাগলেও, তা সেটা ছিল না। ২৫-৩০ জনের উন্মত্ত রক্তলোলুপ পশুর দল তলোয়ার, শেকল, লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ২১ বছরের বিলকিসের ওপর। ওদের কাউকে কাউকে আবার বিলকিস চিনত, দুধ নিতে আসত ওদের বাড়িতে। ওরা বিলকিসের চোখের সামনেই গণধর্ষন করে খুন করল ওর মা-সহ চার মহিলাকে। সেদিন খুন হয়েছিল মোট ৮ জন, যার মধ্যে ছিল বিলকিসের সাড়ে তিন বছরের বাচ্চাটাও। কোল থেকে টেনে-হিচড়ে পাথরে আছাড় মেরে খুন করা হয়েছিল ফুটফুটে বাচ্চাটাকে। ধর্ষণ করার পর “মানুষের বাচ্চা”গুলো বিলকিসকে মৃত ভেবেছিল, তাই উলঙ্গ বিলকিসকে মাঠে ফেলে রেখেই, ওরা বেরিয়েছিল ওদের পরবর্তী কাজে। কিন্তু বিলকিস মরে নাই। সেই মানুষের বাচ্চাগুলোও মরে নাই, ওদের সংবর্ধনা দিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ওদের বরণ করে নিয়েছে মহিলারাও।

“আজাদী কি অমৃত মহৎসব”-এর দিনে, ১৫ আগস্ট গুজরাটে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিলকিস বানোর পৈশাচিক ঘটনায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া ১১ জন মানুষের বাচ্চাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ছেড়ে দেওয়াও হল। এই প্রতিবেদন যিনি আজ পড়ছেন, যিনি লিখছেন, সবাই মানুষের বাচ্চা। হ্যা, আমরা মানুষের বাচ্চা, বিলকিসও তাই, ওর ধর্ষণকারীরাও তাই, ওদের যারা শাস্তি দিল, যারা ছেড়ে দিল, যারা বরণ করে নিল, ওরাও তাই, মানুষের বাচ্চা।

বিলকিসের পরিবারকে যারা খুন করেছিল, যারা বিলকিসের বাচ্চাকে পাথরে আছড়ে ফেলেছিল, বিলকিসকে যারা ধর্ষণ করেছিল, সেই মানুষের বাচ্চাদের মুক্তির পরে গুজরাতের বিজেপি বিধায়ক সি.কে. রাজুল বলেছেন,

“ওরা কোনও অপরাধ করেছেন কিনা জানি না। তবে অপরাধ করার কোনও নির্দিষ্ট কারণ নিশ্চয়ই ছিল। ওরা ব্রাহ্মণ। আর আমরা জানি ব্রাহ্মণরা ভালো চরিত্রের হয়। তাদের কোণঠাসা করা ও সাজা দেওয়ার পেছনে কোনও কারণ থাকতে পারে।”

বাহ্, গনতন্ত্র বাহ্।

তদন্ত করেছিল সিবিআই। রায় দিয়েছিল সিবিআই কোর্ট। মামলার শুনানি হয়েছিল মুম্বইতে। সুপ্রিম কোর্টের পুরোনো বিভিন্ন মামলার রায় মানলে, বিলকিস মামলার দোষীদের ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটা কোনও ভাবেই গুজরাট সরকারের হাতে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেটাই হয়েছে।

বন্দি রেহাইয়ের বিধি ২০১৪ সালে বদলালেও এই ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হল ১৯৯২ সালের বিধি মেনে। তাই, ১১ জনকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে গুজরাট সরকারের কমিটি, আদালত নয়। পঞ্চমহলের জেলাশাসকের নেতৃত্বে তৈরি কমিটিতে ১০ জনের মধ্যে ৫ জনই ছিলেন বিজেপি নেতা। গোধরার বিধায়ক ছাড়াও ছিলেন কালোলের বিজেপি বিধায়ক সুমনবেন চৌহান, বিজেপির গোধরা তালুকার প্রধান সরদারসিন প্যাটেল, গোধরা মহিলা মোর্চার সহ সভানেত্রী বিনীতাবেন লেলে, আরএসএস-ভিএইচপি-এবিভিপি-র নানা দায়িত্ব সামলানো বিজেপি রাজ্য কমিটির সদস্য পবন সোনি। তাছাড়া ছিলেন এসপি, জেল সুপার, সমাজকল্যাণ আধিকারিক, সেশন বিচারক। এই বছর মে মাস পর্যন্ত সদস্য ছিলেন প্রাক্তন বিজেপি কাউন্সিলর মুরলী মুলচান্দনি, বিজেপির মহিলা নেত্রী স্নেহাবেন ভাটিয়া। এরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মুক্তি দিয়েছেন খুনীদের, ধর্ষকদের। গর্ব হচ্ছে না আপনাদের!

“কোনও নারীর জন্য এভাবে বিচার শেষ হয় কীভাবে? আমি আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর আস্থা রেখেছি। আমি সিস্টেমের উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম।”

বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে বিলকিসের। রাইসিনা হিলে বসে থাকা দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি নীরব। এত বড় বাড়িতে বসে কি আর এত কিছু দেখা যায়! শোনা যায়! কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় ওই বাড়িতে বসে নিশ্চিন্তে আরাম করা যায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই টিপ্পনী অত্যন্ত সচেতনভাবে করা হল। কারণ, এই অধিকার দেশের সংবিধান দেশের প্রতিটি মানুষকে আজও দিয়ে চলেছে।

“মহিলাদের প্রতি সম্মান দেশের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ৷ আমাদের নারীশক্তির পাশে থাকা প্রয়োজন”

১৫ই আগস্ট বলেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু বিলকিস বানোর প্রসঙ্গে উনি মুখে কুলুপ এটেছেন, এটাই কি তার পক্ষে মহিলাদের পাশে থাকার দৃষ্টান্ত! বাংলার নিজের মেয়ে এই ব্যাপারে চুপ করে থাকবেন, এতে একেবারেই আশ্চর্য হয়নি কেউ।

পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, লাভপুরের ক্ষেত্রে উনি একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হাথরস কান্ডে বাংলা থেকে এক ঝাঁক প্রতিনিধি উত্তরপ্রদেশের গ্রামে পাঠালেও, বিলকিসের ব্যাপারে উনি নীরব। আমাদের মনে আছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হাঁসখালির ঘটনা, যার প্রসঙ্গে উনি স্টেজে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে বলেছিলেন,

“ছেলেটির নাকি মেয়েটির সঙ্গে লাভ অ্যাফেয়ার্স ছিল। ইজ ইট আ ফ্যাক্ট? আমি ডিজি সাহেবকে বলছি।… মেয়েটি মারা গিয়েছে ৫ তারিখ। অভিযোগ দায়ের হয়েছে ১০ তারিখে। কেন আগে অভিযোগ দায়ের করলেন না। কেন বডিটা পুড়িয়ে দিলেন। আমি সবটা না জেনেই বলছি—আসলে রেপ হয়েছে, না প্রেগন্ট্যান্ট ছিল, নাকি অন্য কোনও কারণ ছিল, নাকি কেউ ধরে ধরে চড় মেরেছে, বা শরীরটা খারাপ হয়েছে? লাভ অ্যাফেয়ার্স তো ছিলই, বাড়ির লোকেরা তা জানত, পাড়ার লোকেরাও তো জানত।… এখন যদি কোনও ছেলেমেয়ে প্রেম করে, আমি কি তাদের আটকাব? এটা কি উত্তরপ্রদেশ, যে লাভ জেহাদকে আটকানো হবে!”

বিলকিসের লড়াই এখনো জারি আছে, তার হয়ে কোর্টের লড়াইতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জনসমক্ষে তিরস্কৃত তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র, প্রাক্তন সিপিআইএম সাংসদ পলিটব্যুরো সদস্য সুভাষীনি আলি, সাংবাদিক-চলচ্চিত্র নির্মাতা রেবতী লাউল, অধ্যাপক রূপরেখা ভর্মা। দেশের কোটি কোটি মানুষ আজ পাশে আছে বিলকিসের।

কিন্তু হাঁসখালির সেই মেয়েটি সে আজ পুড়ে ছাই, মুখ্যমন্ত্রী সেদিন আত্মপক্ষ সমর্থনে এত কথা খরচ করলেন, কেন করলেন এই প্রশ্ন আজও অনেকেই তোলেননি, কারণ তারা কেউ রুদালী নয়, আবার কারো কাছে এটা “ক্যালকুলেটেড অশ্রু”পাতের সময় নয়, আবার অনেকেই বাংলার একটিমাত্র নিজের মেয়ের কাছেই দায়বদ্ধ।

হাঁসখালির নির্যাতিতার বাড়িতে

হাঁসখালি কাণ্ডে আজ তদন্ত চলছে, আদালতের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত চালাচ্ছে। কি হবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস