হাঁসখালি আমাদের ক্ষমা করবে তো? / Hanskhali Rape Case

২০২০ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের হাথরাস জেলায় চার জন উচ্চবর্ণের পুরুষ মিলে ১৯ বছর বয়সী দলিত যুবতীকে গণধর্ষণ করে। মেয়েটি গরুর খাবার সংগ্রহের জন্য একটি খামারে গিয়েছিল। সেখানে তাকে গণধর্ষণ করা হয়। মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয় এবং আহত অবস্থায় গলায় ওড়না জড়িয়ে টেনে নিয়ে যায় ধর্ষকেরা। মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাতের কারণে মেয়েটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। মেয়েটি ধর্ষণ প্রতিহত করার চেষ্টা করলে, অপরাধীরা তার শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে। কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে তার মা ঘটনাস্থলে আসেন এবং মেয়েকে খামারে পড়ে থাকতে দেখেন। প্রথমে স্থানীয় থানায় নির্যাতিতার পরিবার গেলে পুলিশ তাদের অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে এবং পরিবারের সদস্যদের লাঞ্ছিত করে। শেষ পর্যন্ত অনেক টালবাহানার পরে পুলিশ ২০শে, সেপ্টেম্বর, ২০ অভিযোগ নথিভুক্ত করে। দুই সপ্তাহ ধরে মেয়েটি জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ের পরে দিল্লির একটি হাসপাতালে মারা যায়। ধর্ষণের পরে প্রথম ১০ দিনে একজন অপরাধীকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। এমনকি মেয়েটির মৃত্যুর পরে, মৃতদেহটি পরিবারের সম্মতি ছাড়াই পুলিশ জোর করে দাহ করে।

২০২২ সালের ৫ই এপ্রিল নদীয়া জেলার হাঁসখালি থানার গাজন গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্যামনগর পূর্বপাড়া। স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের ছেলে সোহেল গোয়ালির জন্মদিনে বাড়িতে মদ্যপানের আসর বসে, সেখানে সোহেল তার এক বান্ধবী ১৫ বছরের নাবালিকা কিশোরীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসে। সোহেল ও আরো বাকি চারজন মদ্যপানের পর সেই কিশোরীকে গণধর্ষণ করে। পাশবিক অত্যাচারে কিশোরী অচৈতন্য হয়ে পড়ে। তখন সোহেল ও তার সঙ্গীরা মিলে মেয়েটিকে সেই রাতেই মেয়েটির ঝুপড়ি বাড়িতে রেখে আসে, এবং নির্যাতিতার পরিবারকে হুমকি দিয়ে আসে বিষয়টি জানাজানি হলে পরিবারের পক্ষে ভালো হবে না। নেতার ছেলের হুমকির ভয়ে পরিবার কিশোরীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সাহস করতে পারেনি। গ্রামেই এক হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হয়। অত্যধিক রক্তক্ষরণের ফলে সেই রাতেই গণধর্ষিতা কিশোরী মারা যায়। কিশোরীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সোহেল সেই রাতেই প্রমাণ লোপাটের জন্য ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই জোর করে মৃত কিশোরীর দেহ দাহ করে। মৃতার পরিবার ভয়ে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেনি। শেষ পর্যন্ত চাইল্ড লাইনের সহযোগিতায় গত ১০ই এপ্রিল মৃতার পরিবার থানায় অভিযোগ দায়ের করে। অবশেষে ঘটনার ছয়দিন পরে গত ১০ই এপ্রিল মূল অভিযুক্ত সোহেল গোয়ালিকে গ্রেপ্তার হয়।

হাথরাস ও হাঁসখালি এই দুই গণধর্ষণ ঘটনায় আপাতভাবে কোনো তফাৎ দেখা না গেলেও, তফাৎ আছে। হাথরাস গণধর্ষণ কাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সামাজিক, মানবতাবাদী সংগঠন, নারী সংগঠন ঘটনার নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছিল। বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিকদলগুলি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। আমাদের শাসক তৃণমূল দল হাথরাসে প্রতিনিধি পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। অথচ হাঁসখালি গণধর্ষণ নিয়ে সামাজিক সংগঠন, মানবতাবাদী সংগঠন, নারী সংগঠন, সুশীল সমাজ এবং শাসক দল তৃণমূল আশ্চর্যরকম ভাবে চুপ। আরো অবাক করা মত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জীর বিবৃতি। তিনি বলেছেন- “ছেলেটির নাকি মেয়েটির সঙ্গে লাভ অ্যাফেয়ার্স ছিল। ইজ ইট আ ফ্যাক্ট? আমি ডিজি সাহেবকে বলছি।……….. মেয়েটি মারা গিয়েছে ৫ তারিখ। অভিযোগ দায়ের হয়েছে ১০ তারিখে। কেন আগে অভিযোগ দায়ের করলেন না। কেন বডিটা পুড়িয়ে দিলেন। আমি সবটা না জেনেই বলছি—আসলে রেপ হয়েছে, না প্রেগন্ট্যান্ট ছিল, নাকি অন্য কোনও কারণ ছিল, নাকি কেউ ধরে ধরে চড় মেরেছে, বা শরীরটা খারাপ হয়েছে? লাভ অ্যাফেয়ার্স তো ছিলই, বাড়ির লোকেরা তা জানত, পাড়ার লোকেরাও তো জানত।……..এখন যদি কোনও ছেলেমেয়ে প্রেম করে, আমি কি তাদের আটকাব? এটা কি উত্তরপ্রদেশ, যে লাভ জেহাদকে আটকানো হবে!”

আশাকরি এর পরে প্রতিবেদনে লেখার মত কিছু থাকে না। শুধু এটুকুই বলার হাথরাসের বদলে হাঁসখালি, উত্তরপ্রদেশের বদলে বাংলা বলেই কি আমরা এত কিছু দেখেও কিছুই দেখছি না? এই হিরণ্ময় নীরবতা আমাদের ক্ষমা করবে তো?