হাজারো খোয়াইঁশে অ্যায়সি / A thousand wishes like this

আজ তো হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক টুইটার অথবা ইন্সটাতে “শুভ নববর্ষ” আদান প্রদানের দিন। সকালে লুচি-আলুদ্দম-বোঁদে সাঁটিয়ে, দুপুরে সরষে ইলিশ বা চিংড়ি মালাইকারি চেটেপুটে খাওয়ার দিন। আর সন্ধ্যে হতে না হতেই হালকা সুরায় গলা ভিজিয়ে “ইনি বিনি টাপা টিনির” তালে পা মেলাবার দিন। তাই আজ আমরা সরকারের নির্দেশমত যতটা সম্ভব পজিটিভ থাকবার চেষ্টা করছি। শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রত্যুত্তরে “শুভ! সত্যি কি তাই?” মেসেজ পেয়েও পজিটিভিটির ঘেরাটোপে নিজেদেরকে সংযত রেখেছি।

বিগত এক সপ্তাহ মূলস্রোতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে আমরা দেখলাম, দৃঢ়তার সাথে সরকারের সমালোচনায় গলা মেলাতে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে। আর তাই আমরাও আমাদের কলম বিগত এক সপ্তাহ-দশদিন বন্ধ রেখেছিলাম। মাননীয় শ্রী তাপস দাসের হাঁসখালি কান্ডের ওপর একটি দুর্দান্ত লেখাকে আমরা অস্বীকার করবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারিনি এবং তাই সেটিকে প্রতিবেদনের আকারে প্রকাশ করেছি। আর জ্বালানীর দামে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গিয়ে, একটা লেখা লিখতে বাধ্য হয়েছি। এছাড়া আমাদের কলম বন্ধ ছিল।

মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলির মধ্যে আবার শিরদাঁড়াযুক্ত সাংবাদিক হয়ে ওঠবার এমন ইচ্ছেকে কুর্নিশ জানিয়ে যখন নিজেরাই নিজেদের এপিটাফ লিখব প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি তখনই রাইজ অফ ভয়েসেস-এর অন্দরমহলে আওয়াজ উঠল “কি ব্যাপার! লেখা কই!” কারণ টিকা-টিপ্পনী উড়ে আসছে পাঠকদের থেকে। সুদুর শিমূরালী থেকে ফোন আসে, হাঁসখালি নিয়ে একটা প্রতিবেদন দিয়েই দম ফুরিয়ে গেল! বোলপুর, নামখানা, মাটিয়া, ইংরেজবাজার অথবা বাঁশদ্রোণীর নির্যাতিতাদের কথা লিখলেন কই! উত্তরবঙ্গের জনৈক শুভাকাঙ্খীর অনুযোগ তিলাবনী পাহাড় চুরির প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু মেখলিগঞ্জের কাছে তিস্তার আস্ত চর বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ কই! আপনাদের কাছে উত্তরবঙ্গ মানে কি শুধুই দার্জিলিং আর কাঞ্চনজঙ্ঘা! এক ছাত্র জানালেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আক্রান্ত উপাচার্য বদলি হয়ে গেছেন। নতুন যিনি এসেছেন তিনি নাকি চটি-চালিত ববি-পালিত! বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিবাদী মুখ আনিস খানকে আগেই বাড়িতে ঢুকে খুন করা হয়েছে, এবার উপাচার্য বদল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহার্ঘ্য জমি রিয়েল এস্টেট প্রমোটারের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করা হল। রাইজ অফ ভয়েসেস কিছু লিখল না তো! অথবা এক বিজেপি সমর্থক জানালেন, শাসক ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপ্রক্রিয়াকে স্থবির করে দেওয়ার যে নির্লজ্জ অপচেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধেই বা আপনাদের লেখা কই! নবান্ন থেকে বিজ্ঞাপনের বরাত এল না কি!

আর এইসব সমালোচনাবিদ্ধ ঋদ্ধ অভিজ্ঞতাই ফের কলম ধরাল। যদিও আজ যখন পজিটিভ থাকবো ঠিক করেছি তখন সেখান থেকে নড়ছি না। তাই নতুন বছরের জন্য তুলে রাখা কিছু ইচ্ছেকেই আপনাদের সামনে একে একে তুলে ধরছি।

  • নতুন বছরে পেট্রল-ডিজেল-কেরাসিনের দামটা কমে যাক। দাম কমুক সরষের তেল আর সানফ্লাওয়ার তেলের। গ্যাস সিলিন্ডারের দামটাও আয়ত্তে আসুক।
  • পাড়ায় পাড়ায় কাটমানি /তোলাবাজির সিণ্ডিকেট চালিয়ে হঠাৎ বড়লোক ও দাপুটে নেতা বনে যাওয়া অট্টালিকার বাসিন্দাদের আমরা যেন ফের ন্যাতা বানিয়ে দিতে পারি।
  • শিক্ষা দপ্তরের ঘুঘুর বাসায় ইঁট নয়, থান ইঁট পড়ুক। সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত রাঘব বোয়াল গারদে যাক। যোগ্য টেট উত্তীর্ণরা ফুটপাথে নয়, ক্লাসঘরে বসুক। টিউটোপিয়ান ইউটোপিয়ায় আক্রান্তদের, উডবার্ন ওয়ার্ডে নয়, গারদের পেছনে চিকিৎসা হোক।
  • আনিস খান হত্যাকান্ডে জড়িত সিভিক পুলিশ, উর্দিধারী পুলিশ এবং শাসকদলের নেতাদের জেলে ঢুকিয়ে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু হোক।
  • বর্ধমানের তুহিনা খাতুনও বিচার পাক। বাদশা এবং তার দলবল গ্রেপ্তার হোক। স্থানীয় বিধায়ককেও প্রয়োজনে তদন্তের আওতায় আনা হোক।
  • হাঁসখালি, বোলপুর, নামখানা, মাটিয়া, ইংরেজবাজার অথবা বাঁশদ্রোণীর নির্যাতিতারা এবং তাঁদের পরিবার সুবিচার পাক। ধর্ষকরা যেন শাসকের ঝান্ডা দুলিয়ে বেঁচে না যায়।
  • রামপুরহাট গণহত্যার মূল মাথারা প্রত্যেকে গ্রেপ্তার হোক ও দ্রুত শাস্তিদানের প্রক্রিয়া চালু হোক।
  • ঝালদার বিরোধী দলের মৃত কাউন্সিলর তপন কান্দু ও তার পরিবারও সুবিচার পাক। জড়িত শাসকদলের নেতারা এবং থানার উর্দিধারী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
  • সিবিআই সারদা-রোজভ্যালি-নারদা প্রভৃতি তদন্তের মত ঘুমিয়ে না পড়ে, জেগে থাকুক। এই মুহুর্তে বাংলা থেকে যেকটি মামলা হাতে রয়েছে তার প্রত্যেকটার দ্রুততার সঙ্গে যথাযথ তদন্ত হোক।
  • জেলখাটা আসামী চোর চিটিংবাজদের, রাজনৈতিক দলগুলো মুখপাত্র বানানো বন্ধ করুক। বাংলার মানুষের একটা মান সম্মান আছে। সেটাকে মর্যাদা দেওয়া হোক। মুখপাত্র সাজা দাগীদের রোজ রোজ টিভির পর্দায় দেখতে ভালো লাগে না।
  • আমাদের লাটসাহেব রাজ্যের তথাকথিত প্রধান বিরোধী দলের পার্ট না হয়ে নিজের পদমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হোন।
  • কথায় কথায় ৩৫৬ আর রাজ্যপালের কাছে দরবার নিজেদের দুর্বলতা আর কেন্দ্র-নির্ভরতাকে প্রকট করছে। ল্যাংচা খান, কিন্তু এভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাঁধে ভড় দিয়ে লেংচে চললে ভবিষ্যৎ নেই। কাজেই রাজ্যের তথাকথিত প্রধান বিরোধী দল এব্যাপারে সচেতন হোক।
  • লাল পার্টির নেতারা সম্মেলনের “ঢক্কানিনাদ” কাজে করে দেখাক। ইদানীং লালঝান্ডা হাতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের সম্মিলিত প্রতিবাদ যত না হচ্ছে তার থেকে সম্মেলনের ঘনঘটা ও ফটোশুট বেশি চোখে পড়ছে।
  • আগামী বছরে রাজ্যের সমস্ত বিচারপতি, আমলা বা পুলিশ মনে রাখুক তারা স্কুলের বাচ্চা নয় যে নীল-সাদা ড্রেস পড়ে ঘুরে বেড়ালে আমরা জনসাধারণ তা মেনে নেব। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় কিন্তু আপনাদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে।
  • এসএসকেএম এর উডবার্ন ওয়ার্ডে ফের সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা চালু হোক। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা মনে রাখুক অপরাধীদের আশ্রয়স্থল জেল। হাসপাতাল না।
  • কথায় কথায় হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ হোক। নতুন বছর জুড়ে আমরা সবাই যেন নিজেকে শুধুই মানুষ ভাবা প্র্যাকটিস করতে পারি।
  • এভিলকে যেন আমরা সবাই নির্দ্বিধায় এভিল বলবার সাহস জোটাতে পারি। লেসার গ্রেটারের ভুলভুলাইয়ে ঘুরে পথ হারানো বন্ধ হোক।
  • আগামী শিল্প সম্মেলনে বাংলায় প্রচুর শিল্প আসুক। লক্ষ লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরি হোক। সব হাতে কাজ, আর সব পাতে ভাত জুটুক। ভাতা নির্ভরতা বন্ধ হোক।
  • আর পরিশেষে বাংলার সবকটা মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম তাদের নিজের নিজের শিরদাঁড়া খুঁজে পাক যাতে রাইজ অফ ভয়েসেস নির্দ্বিধায় নিজের এপিটাফ লিখতে পারে।

হাজারো খোয়াইঁশের শিরোনামে মাত্র এইকটা ইচ্ছের কথা লিখলাম, কারণ এটাকে হাজার বানাবার দায়িত্ব আপনাদের হাতে ছাড়তে চাই।

কমেন্ট বক্সে আপনারা আপনাদের ইচ্ছে লিখুন।

এমন সহস্র “ইচ্ছেডানা”য় ভর করে বাংলা আবার তার হৃত গৌরব ফিরে পাক।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস