জেতার সহজ উপায় / Tips and Tricks

আগামী ৮ই জুলাই আসছে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। কমিশনের হিসেবে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত মিলিয়ে মোট ভোট হওয়ার কথা ছিল ৭৩,৮৮৭ কেন্দ্রে। কিন্তু তা হচ্ছে না। ৯,০০০ এর বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইতিমধ্যেই জয়ী হয়েছেন কেউ কেউ। এদের মধ্যে সিংহভাগ শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের হলেও, তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে শূন্য পাওয়া বামেরা। অন্যদিকে খাতায় কলমে ও টিভির পর্দায় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুইটি আসন জিতলেও, তাদের এক বিজয়ী প্রার্থী ‘বাইরন’ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিদ্যুৎ গতিতে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। এত কিছুর পরেও রাজ্যে ৬০,০০০ এর বেশি আসনে নির্বাচন হতে চলেছে আর সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চলেছেন সব মিলিয়ে লক্ষাধিক প্রার্থী। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন হচ্ছে, তখন জয় পরাজয় থাকবেই। যেমন জেতার খিদে থাকবে, তেমন থাকবে হারার ভয়। তাই আজ আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস আপনাদের বলব, নির্বাচনে জেতার সহজ উপায়।

খাটের তলা থেকে তালা বন্ধ বাড়ি, কয়েক মাস আগে যেভাবে শাসক দলের মন্ত্রী-নেতা-কর্মীদের থেকে টাকার পয়সা উদ্ধার হচ্ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, সব বেআইনি টাকা ধরে থরে থরে সাজালে একটা কাঞ্চনজঙ্ঘা দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু শেষমেষ তা হয়নি, আপাতত বিরতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সির টাকা উদ্ধার কর্মসূচি। তবে, শুধুমাত্র টাকা দিয়ে এই রাজ্যে নির্বাচন জেতা যায় না, তা এক প্রস্থ প্রমাণিত। নাহলে আজ পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় থাকার কথা বিজেপির, তা হয়নি। আপনার কোনো নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আসল নিয়ন্ত্রক হল আপনার লক্ষ্য এবং টাকার সুষম বন্টন। ভোটারদের প্রণাম, সেলাম, গুচ্ছের প্রতিশ্রুতি এসব পুরোনো হয়ে গেছে। তাই চাই নতুন পন্থা।

প্রথমেই চাই একদল বিশ্বস্ত বাহিনী, যারা কেবল মিটিং মিছিল করবে না, খালি রাস্তার ধারে পতাকা লাগবে না, তাদের কাজ হবে দুয়ারে গিয়ে ভোট আদায় করে নেওয়া। আপনাকে সমর্থন করার জন্যে জন্যে ঘরে ঘরে আবেদনের দিন শেষ, তাই ভয় দেখিয়ে কাজ সারুন, আদায় করুন ভোট। আর কেউ বেশি ত্যান্ডাই-ব্যান্ডাই নকুলদানা স্টকে রাখবেন। কারণ আজকের দিনে বাংলার মানুষ চূড়ান্ত বিভ্রান্ত, কাকে সমর্থন দেবে বোঝা মুশকিল। মুখে এক তো মনে এক। তাই রিস্ক নেওয়া অনুচিত।

যাই হোক, এই মার্কেটে একটা পতাকা কিনতে মোটামোটি পাঁচ টাকা মত খরচ, কিন্তু মাত্র ২০০ টাকায় এই রাজ্যে পাওয়া যায় ছাপ্পা দেওয়ার লোক। গত পৌরসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগরে এমনই প্রশিক্ষণহীন ছাপ্পা কর্মী ধরা পড়েছিল, তাই এদিকে নির্বাচনী বাজেট বরাদ্দ করার বিষয়টা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। কারণ ছাপ্পা দিতে এসে ধরা পড়ে ধোলাই খাওয়া কিন্তু দারুণ লজ্জার ব্যপার। এদের ট্রেনিংটার দিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন, যদিও জেলায় জেলায় নবজোয়ার টাইপ কর্মসূচি থাকলে ভোট দান ও লুঠ, দুটোরই প্র্যাক্টিস ভালোভাবে হয়ে যাওয়া উচিত। তাই একশ দুশো পতাকা কম কিনুন, পাঁচ সাতটা ফ্লেক্স কম কিনুন আর সেই টাকা ইনভেষ্ট করুন সুলভ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাপ্পা কর্মীদের জন্যে। আর ফ্লেক্স কম দেখে বেয়াড়া সাংবাদিকরা যদি জিজ্ঞেস করে, “ফ্লেক্স কম কেন?” তখন বলে দেবেন, আপনি পরিবেশ সচেতনতার প্রচারের জন্যে প্লাস্টিক থেকে তৈরি ফ্লেক্স কম ছাপিয়েছেন। এ সব মানুষ থেকে মিডিয়া খায় ভালো।

ভোটের আগে জনতার বাড়ি গিয়ে, “আপনাদের কষ্ট ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই”, এই সব পন্থা পুরোনো। এ সব বলে আর কিছু হয় না। এমনিতেই রাজ্যে চাকরি নেই, তাই দলে দলে মানুষ পরিযায়ী হয়েছে, তাই ভোটার লিস্ট দেখে বের করে নিন, কারা কারা এলাকার বাইরে আছে। একদিন ভোটের জন্যে এরা তো আর এলাকায় আসবে না, সেই সুযোগ ১০০% কাজে লাগাতে হবে।

আর যারা এতকিছুর পরেও রাজ্যে রয়ে গিয়েছেন, তাদের জন্যে পাড়ার মোড়ে পাহারা বা “খড়্গ হাতে উন্নয়ন” বসিয়ে দিন। জনগণকে গুড় বাতাসা খাইয়ে বোঝান, কেনো ভোটকেন্দ্র তাদের জন্যে একটুও নিরাপদ নয়।

এবারে আসি বাহিনীর কথায়। ভোট পরিচালনা করতে আসা রাজ্যের অথবা কেন্দ্রের বাহিনীকে ভোটের আগের রাত্রিকালীন বিরিয়ানি ও পাঁইট দিয়ে ম্যানেজ করা গেলেই কেল্লা ফতে। ডাইরেক্ট পাহারা বসিয়ে দিন ভোট কেন্দ্রের মধ্যে। আর ক্যামেরা! ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো জোগাড় করলেই যথেষ্ট। মক্কা থেকে মনোনয়ন যখন সম্ভব হচ্ছে, তখন এসব ম্যানেজ করা নস্যি। আর তার ওপরে নির্বাচন কমিশন যদি হাতে থাকে, তবে তো কথাই নেই।

এসব দেখে সাধারণ মানুষ ভাববে, প্রশ্ন করবে, “ডিএ না পেয়েও কিছু কর্মী কেন সরকারের তাবেদারী করে চলেছে?” এই সবে কান দেবেন না, কারণ তারা জানেন না, সেই সরকারি কর্মীরা ডিএ পায়নি এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে তাদের কেউ কেউ অযোগ্য হয়ে গোটা চাকরিটাই পেয়েছে। অনুগ্রহ আনুগত্য প্রকাশ পাবেই। তাই আপনার এক্ষেত্রে চিন্তা করার কোন কারণ নেই।

এবারে আসি ভোটের দিনে, এটার প্রস্তুতি জোরদার হওয়া প্রয়োজন। বিরোধী গোষ্ঠীর কারা কারা এজেন্ট হতে চায়, তাদের তালিকা জোগাড় করে নিন। তারপর তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসুন, ভোট কেন্দ্রে কেন তাদের যাওয়া এক্কেবারে উচিত নয়। জনগণের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা করতে গেলে এসব আপনাকে করতেই হবে। এরপরেও যদি কেউ এজেন্ট হতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে ছোট্ট করে ডেমো দিতে পারেন। যেমন সিগারেটের প্যাকেটে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ছবি থাকে ওই টাইপ। আরও পরিষ্কার ভাবে বললে, দুর্ঘটনাপ্রবন রাস্তায় যেভাবে ভাঙা গাড়ি রেখে দেওয়া হয়, ওরকম কিছু দেখিয়ে দিলেই কাজ অনেকটা হয়ে যায়। তার পরেও কেউ না মানলে আপনার নিযুক্ত পাহারাদাররা তো ভোটের দিন রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবেনই।

এতেও যদি আপনার মনে দ্বিধাদন্দ্ব থেকে থাকে, তাহলে তাদের একটা লিস্ট ধরে থানায় পাঠিয়ে দিন, সুবিচার পেতে পারেন। কারণ নির্বাচনের মত মহৎ কাজের সমালোচনা যারা করবেন, তারা একসাথে হাজতে বসে সমালোচনা করুন, তা দেখতে বেশ ভালো লাগবে। আর এদিকে আপনি ভোটটাও সুষ্ঠ ও নির্বিঘ্নে করতে পারবেন।

এছাড়া ভোটের আগে, টেলিভিশন মিডিয়া মাতিয়ে রাখতে জেল ফেরৎ আসামী, রগড়ে দেওয়া নেতা, কচুবনে লাফ মারা নেতা অথবা চোর চোর বলে চিৎকার করা নেতা ধরে আনুন। কালোকে সাদা আর সাদাকে কালো বলতে এদের অনেকেই ওস্তাদ। তাই সারাক্ষন বিভ্রান্তি প্রচার করুন। বিভ্রান্তির টিআরপি এই রাজ্যে অত্যন্ত বেশি, তা চ্যানেলে চ্যানেলে বিজ্ঞাপিত করুন। এতে মিডিয়ার সান্নিধ্য পাওয়ার সম্ভাবনা ১০০%।

এখানেই শেষ নয়, ফেসবুক, টুইটারেও বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যে কিছু চাকরি না পাওয়া তরুণ তরুণী খুঁজে বের করুন, যারা পাবলিকের কাছে শত খিস্তি খেলেও কর্তব্য পালনে বিচলিত হন না। সাথে আপনিও মাঝে মাঝে গরিব মানুষের মাঝে গিয়ে পাত পেরে ভাত খান, জোর করে কোলে বাচ্চা তুলে নিন, সাইকেল চালান, গরম গরম বাতেলা মারুন, মন্দিরে পুজো দিন, মসজিদে চাদর চড়ান, হিন্দুকে মুসলিম – মুসলিমকে হিন্দুর ওপর তাতিয়ে দিন, স্টুডিওর ঠান্ডা ঘরে বসে এরা সযত্নে তা প্রচার করে দেবেন।

আর হ্যাঁ, দুর্নীতিবাজদের ক্ষেত্রে যুদ্ধ ঘোষনা করতে একদম ভুলবেন না, তাই সাথে কিছু সেরা দুর্নীতিবাজ রেখে দেবেন, তাহলেই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে পারবেন, এই বিশ্বাস মানুষের মনে গেঁথে দিতে হবে। কিন্তু মানুষকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

মানুষ সময় নষ্ট করে টিভি দেখবে, ফেসবুক দেখবে, চায়ের দোকানে চোর চোর অথবা সেটিং সেটিং বলে চিৎকার করবে। কিন্তু নির্বাচনের স্টেডিয়ামে খেলবেন আপনি, সাধারণ মানুষ কেবল দেখবে আর জ্বলবে, আর লুচির মত ফুলবে। এ সবই খেলার অঙ্গ। তাই মানুষের কথা ভেবে সময় নষ্ট না করে, রেফারি, স্কোরার এদের দিকে মনোনিবেশ করুন। কারণ কথায় আছে, ভোটদাতাদের থেকে ভোট গণনাকারীরা বঙ্গ রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই কাজগুলো মন দিয়ে করতে থাকুন, আপনার নির্বাচনে জয়ী হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আর এত সব করার পরেও যদি নির্বাচনে জেতা নিয়ে আপনার একটুও শঙ্কা থাকে, তাহলে আপনি আনফিট। গোহারান হারবেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস