সিঙ্গুর : ধাত্রীভূমি বনাম বধ্যভূমি / The Singur Files

আজ মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরে।

নাহ। কোন শিল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনে বা উদ্বোধনে ফিতে কাটতে উনি যাচ্ছেন না।

উনি যাচ্ছেন বাজোমেলিয়া গ্রামের সন্তোষী মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে। আর পুজো শেষে তারপর কামারকুণ্ডু ষ্টেশনের একটা রেল ওভারব্রিজ উদ্বোধন করার কথা আছে মুখ্যমন্ত্রীর।

যেখানে একটা গাড়ি কারখানা এবং অনুসারী শিল্প হলে অঞ্চলটার চেহারা বদলে যেত, হতে পারত একটা নতুন “টাটানগর” এর মত শহর, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন তারই অনুপ্রেরণায় নির্মিত একটি মন্দিরে পুজো দিতে এবং পার্শ্ববর্তী রেল ওভারব্রিজ উদ্বোধনে। কতটা মানানসই সেটা আপনারা বিচার করবেন। আজ আমরা একটু স্মৃতি রোমন্থন এবং আত্মসমালোচনার পথে হাঁটতে চাইছি।

জমি আন্দোলনের ব্যানার টাঙিয়ে সিঙ্গুর থেকে শিল্প তাড়ানোর জন্য বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সেই প্রবল আন্দোলন এবং ২৬ দিনের মরণপণ অনশন, এখন তো স্কুলের ইতিহাস বইতে পড়ানো হয়, যেখানে সিঙ্গুর আন্দোলনকে দেখানো হয় গাড়ির কারখানা হঠিয়ে, ভাতের কারখানা চালু রাখবার বিজয় নিশান হিসাবে। অবশ্য এই প্রসঙ্গে তৎকালীন বাম সরকারের “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ” স্লোগান তুলে, তার বাস্তবায়নে সীমাহীন প্রশাসনিক ব্যর্থতাও যথেষ্ট সমালোচনার দাবী রাখে। সেই সময় এই ইস্যুতে বাম শরিক দলগুলোর মধ্যেকার পারস্পরিক অবিশ্বাস-অসহযোগিতা ও বেনজির অন্তর্ঘাতও আমরা জনসাধারণ দেখতে পেয়েছিলাম। কৃষি জমিতে শিল্প স্থাপন নিয়ে বাম সরকারের শরিক দলগুলোর মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ তরজা যেমন প্রতিদিন সামনে চলে আসছিল, তেমনই ৩৪ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধীতাকে হাতিয়ার করে তৎকালীন বাম সরকারকে হঠাবার জন্য তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি এবং কট্টরবামদের মধ্যে একটা মরিয়া বোঝাপড়াও বেআব্রু হয়ে পড়েছিল। মানে চিদম্বরম-রাজনাথরা প্রায় একে অপরের সাথে রীতিমত হাত ধরাধরি-গলাগলি করে, বাংলা জুড়ে জমি আন্দোলনের নামে শিল্প-বিরোধীতায় অক্সিজেন জুগিয়েছিলেন। তাতে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপালও! গানওয়ালার বই থেকে পরে জানা যায়, কিছু বিদেশী দূতাবাসের হত্তাকত্তা-কর্মীরাও যুক্ত ছিলেন এই জমি আন্দোলনের সাথে। ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পাওয়া এগিয়ে থাকা এগিয়ে রাখা সাংবাদিককূলও বাম সরকারের অভ্যন্তরীণ ডামাডোল এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদ করতে করতে তৎকালীন বাম সরকারের বিকল্প প্রায় একটা সমান্তরাল প্রশাসনিক ব্যবস্থার ছবি মানুষের সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর এনাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন “পরিবর্তন চাই” হাওয়া তোলা সুশীল সমাজ তথা বিদ্বজনদের একটা বড় অংশ যা এই আন্দোলনকে জনমানসে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল। তাছাড়া নীচুতলার একশ্রেনীর বাম কর্মী-সমর্থকদের পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টা এবং দাদাগিরির বিরুদ্ধেও বেশ কিছুদিন ধরে মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল, যাকে সুচতুরভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল “পরিবর্তন চাই” স্লোগানে। মানে এক কথায় শুধু হাত-ঘাস-পদ্মের মিলিজুলি বিরোধিতাই নয়, গাড়ির কারখানা বন্ধ করে “ভাতের কারখানা” চালু রাখবার দাবীতে বলতে গেলে প্রায় গোটা বাংলার সংবাদমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীমহল সেইসময় নজিরবিহীন অতিসক্রিয়তা দেখিয়েছিল।

কিন্তু আজ এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর, ভাতের কারখানা বনাম গাড়ির কারখানার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া যুযুধান দুইপক্ষ যখন ফিরে দেখেন অতীতকে, তখন কি তাঁরা আদৌ ভাবেন টাটার মত শিল্পগোষ্ঠী বাংলা ছাড়া হওয়ায় ঠিক কি বার্তা সেদিন বাংলা থেকে গিয়েছিল দেশের তাবড় শিল্পপতিদের অলিন্দে! যেসমস্ত শিল্পী-বুদ্ধিজীবী বিদগ্ধ মানুষজন সেদিন গাড়ির কারখানা তাড়িয়ে মানুষকে আলু এবং শসা চাষের পরামর্শ দিয়েছিলেন, বুঝিয়েছিলেন ধান চাষ আসলে ভাতের কারখানা, তাঁদের কজন পরবর্তী সময় সিঙ্গুরের চাষীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাল টেনেছেন! তাঁরা জানেন কি, সিঙ্গুরের চাষিরা তাদের ফসলের ন্যায্য দাম পান না! তাই কিছুদিন আগে বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে মাছের ভেড়ি বানাবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং সেই খবর লোক জানাজানি হওয়ায়, স্থানীয় প্রশাসনের তরফে ভেড়ি বানানোর প্রক্রিয়ায় আপাতত লাগাম পড়ানো হয়েছে! যে ৪০০ একর জমির জন্য বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সেদিন আওয়াজ তুলেছিলেন, তার মেরেকেটে ১০%-১৫% জমিতে এখন চাষবাস হয় বলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। আর বাকি জমি এখনও ধূ-ধূ মাঠ। চাষবাসের উপযুক্ত নয়। তাহলে জমি ফিরিয়ে লাভ কি হল? চাষিরা তো জমি ফেরত চেয়েছিলেন চাষবাস করবেন বলে!

সেদিনের সেই গানওয়ালা, ছবিওয়ালা, থিয়েটারওয়ালা, কবিতাওয়ালা কিম্বা সিনেমাওয়ালারা যাদের ভাতের কারখানার চিন্তায় জমি আন্দোলনের দিনগুলোতে রাতে ঘুম আসত না, আজ তাঁদের কেউ বিধায়ক, কেউ সাংসদ, কেউ আবার সরকার পালিত বিভিন্ন সংস্থার সর্বেসর্বা! অনেকে আবার পরবর্তী সময় চিটফাণ্ডের টাকায় সিনেমা বানিয়ে, ম্যাগাজিন -জার্নাল-টিভি চ্যানেল চালিয়ে পকেট ভরেছেন! ফলে তাদের রান্নাঘরে ভাত ফুটেছে টগবগিয়ে! কিন্তু একদিনের জন্যও তাঁরা কি সেইসব সিঙ্গুরের চাষি পরিবারগুলোর খোঁজ নিয়েছেন যাদের ফেরত পাওয়া জমিতে আজও ফসল ফললো না, অথবা ফললেও মা-মাটি-মানুষের জমানায় ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে তারা আপাতত অন্য জীবিকার সন্ধানে!
আর আমরা যারা শিক্ষিত অথবা স্বল্প শিক্ষিত, চাকরি করে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষজন, যারা এখন সামান্য সরকারী চাকরি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে জমি-বাড়ি বেচে বা বন্ধক রেখে অথবা পারিবারিক সর্বস্ব সঞ্চয় দাঁওতে লাগিয়ে নেতা-মন্ত্রীদের দশ-পনেরো-বিশ লাখ টাকা ঘুষ দিতে পিছুপা হচ্ছি না, তারাও কি একবার ভেবে দেখব না, সিঙ্গুর কি সত্যি আদতে জমি আন্দোলনের ধাত্রীভূমি, নাকি বাংলার শিল্প সম্ভাবনার বধ্যভূমি!

আজকের সবকটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতার বড় খবর হল এইমসের মত প্রথমসারির সরকারী হাসপাতালের কল্যাণী শাখায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও নাকি দুর্নীতি ও টাকা খাওয়খাওয়ি হয়েছে। এক্ষেত্রে ফর এ চেঞ্জ অভিযোগের তীর বিজেপির বিরুদ্ধে। মানে এবার এক্কেবারে “সনাতনী” ঘুষ! আর এক্ষেত্রে অভিযোগকারীও হলেন একজন বিজেপি সমর্থক ফলে অভিযোগটা এক্কেবারে ঊড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। মানে সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে, তা হল আমাদের রাজ্যের শাসকদল এবং খাতায় কলমে প্রধানবিরোধী দল, দুজনেই ঘুষ খায়! অন্তত অভিযোগটা এমনই। সিআইডি ইতিমধ্যে তদন্তভার হাতে নিয়েছে। আর সবকিছু দেখে শুনে আমাদের মনে হচ্ছে বাংলায় কি তবে ছেলেমেয়েদের একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ ঘুষ দিয়ে নেতা মন্ত্রীদের খুশ করাটাই ভবিতব্য!

গাড়ির কারখানা হঠিয়ে ভাতের কারখানার প্রতিশ্রুতি দেওয়া লোকগুলো যেভাবে রাজ্যের কোনায় কোনায় ঘুষের কারখানা চালু করেছেন তার বিরুদ্ধে আমরা কি মুখ খুলবো না? পরিবর্তন চাইব না এমন অব্যবস্থার?

সুশীল সমাজের লোকজনেরা না হয় বিদগ্ধ মানুষজন, সম্মানীয় ব্যক্তি তাই ওনারা নিজেদের থুতু গিলতে ইতস্ততঃ করছেন! এভিলের লেসার ভার্সনের জন্ম দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা জনসাধারণ খামোখা ওঁদেরকে ক্রাচ বানিয়ে ওনাদের ভরসায় থাকব কেন? কেন ওনাদের বাপান্ত করে সময় নষ্ট না করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করব না?

জানতে চাই আমরা। নীচের কমেন্ট বক্সে আপনাদের মতামত লিখে জানান আমাদেরকে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস