হে সাংবাদিক! হে সাংবাদিকতা! / The Bengal Media

দিল্লি ও রাজ্যের শাসক মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করা মানে মৌচাকে ঢিল মারা!
এরা বোঝে খবর মানে কিছু ব্যক্তি বিশেষের লাফালাফি দাপাদাপি এবং তাদের সেই ‘লম্ফঝম্প’কে মিডিয়া ফুটেজ বা এয়ার টাইম পাইয়ে দেওয়া। কারণ এনাদের কাছে ‘রাজনীতি’ মানে হলো কিছু বিশেষ ‘রাজনেতা’দেরকে নিয়ে নাচানাচি করা। সেটা মাননীয়া বা তার ভাইপো অথবা জেলখাটা মুখপাত্র হতে পারে, শুভেন্দু-সুকান্ত-দিলীপ ঘোষদের বেনজির কু-কথার আস্ফালন বা ট্যুইট হতে পারে অথবা হতে পারে, কলকাতার উপকন্ঠে ভাঙড়ে নওশাদ সিদ্দিকির দলের পক্ষ থেকে রাজ্য শাসকদলকে ফিরিয়ে দেওয়া পাল্টা ‘প্রতিরোধ’।
কিন্তু আজকাল মিডিয়া এখানেই থেমে থাকছে না।
এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ মহিলা সাংবাদিক তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে ক্রিজ থেকে বেরিয়ে একটু স্টেপ আউট করে ‘ছক্কা’ মারতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধিয়েছেন। তিনি বামেদের খোঁচা দিয়ে যা বলতে চেয়েছেন তার সরমর্ম হলো, মিডিয়া মোটেই বিজেপি-তৃণমূল বাইনারি তৈরি করছে না, কাজেই অযথা মিডিয়াকে দোষারোপ না করে ‘সিপিএম’ বরং আত্মসমালোচনা করুক এবং রাজনীতিতে ‘লড়াই’ দিয়ে কিভাবে প্রাসঙ্গিক থাকতে হয় তা নওশাদ সিদ্দিকির কাছ থেকে শিখুক!
সেই সূত্রেই রাইজ অফ ভয়সেসের তরফে এই লেখার অবতারণা। আর লেখার শুরুতেই ‘মাননীয়া’ সাংবাদিককে অনুরোধ করব ভাবতে, নওশাদ সিদ্দিকির দলের এই লড়াই কলকাতার পার্শ্ববর্তী ভাঙড় না হয়ে যদি সুদূর উত্তরবঙ্গের চোপড়া হতো আর এদের হাতে যদি পাল্টা দেওয়ার মত অস্ত্রশস্ত্র না থাকতো তাহলে কি আর নওসাদ এত এয়ার টাইম বা ফুটেজ পেত! কেন জিজ্ঞেস করছি, সেটা সংবাদমাধ্যমের সবাই জানেন বা বুঝতে পারছেন! মাননীয়া সাংবাদিকও জানেন। কিন্তু আমরা যাঁরা চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এই মিডিয়ার দেখানো খবর দেখে নিজেদেরকে বেশ ‘সবজান্তা’ বা ‘বিজ্ঞ’ ভাবি তাদের জন্য এখানে কারণটা একটু বিশদে লিখতে বাধ্য হচ্ছি।
যেদিন মনোনয়ন জমাকে কেন্দ্র করে ভাঙড় ‘অগ্নিগর্ভ’ ছিল এবং মিডিয়ার দৌলতে ওটা ভাঙড় না ইউক্রেন ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, ঠিক সেদিনই উত্তরবঙ্গের চোপড়াতে বেলার দিকে সিপিআই(এম)এর নেতৃত্বে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থীরা সুবিশাল মিছিল সহযোগে সংশ্লিষ্ট বিডিও অফিসে মনোনয়ন দিতে যাচ্ছিলেন। ‘সুবিশাল’ বলছি কারণ স্বয়ং তৃণমূলের জেলা সভাপতি কানাহাইয়ালাল আগরওয়াল বলছেন মিছিলে ৪,০০০ এর মত লোক ছিল এবং সাংবাদিক মাত্রে সবাই জানেন, মিছিলের এই পরিমাণ জনসমাগমকে গ্রামাঞ্চলের নিরিখে “সুবিশাল”ই আখ্যা দেওয়া হয়। আর এই বিশালত্বেই বিপত্তি! শাসক বুঝতে পারে হাওয়া সুবিধের নয়। এঁরা মনোনয়ন জমা দিলে ঘোর বিপদ। তাই প্রথমে সেই নিরস্ত্র জনতার মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৪৪ ধারার নামে ‘দলদাস’ পুলিশকে দিয়ে ছোঁড়া হয় কাঁদানে গ্যাস। আর পরিকল্পনা মাফিক তারমধ্যেই দিনের আলোয় তৃণমূল দুষ্কৃতিরা ছুঁড়তে থাকে এলোপাথারি গুলি! মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ২০জনের মত উপস্থিত বাম-কংগ্রেস কর্মী সমর্থক আহত হন। প্রথমে মিডিয়া থেকে জানতে পারা যায় একজন মৃত। পরে অনেক রাতে জানা যায় ঐ ব্যক্তি বেঁচে আছেন এবং মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। মিডিয়া অবশ্য সে খবর দেয়নি জনতাকে। জানতে হয়েছে সমাজমাধ্যমের পোস্ট দেখে। সিপিআই(এম)র পক্ষ থেকে প্রথমটায় দাবী করা হয় মৃতের সংখ্যা দুই। কিছু মিডিয়াতে সেখবরও দেখানো হয়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সব মিলয়ে দুপুরের দিকে সব চ্যানেলে মেরেকেটে মিনিট পনেরো কুড়ির এয়ার টাইম বা ফুটেজ বরাদ্দ ছিল চোপড়ার জন্য।
আসলে চোপড়ার নিরস্ত্র জনতার অপরাধ, তাঁরা বুলেটের সামনে ‘প্রতিরোধ’ করতে পারেনি। নিরস্ত্র মিছিলে ‘গুলি’ তাও আবার প্রতিরোধহীন ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া। তারওপর ঘটছে সুদূর উত্তরবঙ্গে! এটা কোন খবর নাকি! তার চেয়ে কলকাতার কাছেই দুপক্ষের বোমাবাজি গোলাগুলি অনেক বেশি উত্তেজক হওয়ায় টিআরপি টানবে! কাজেই কলকাতা কেন্দ্রিক মিডিয়া মূলত ভাঙড়ে মনোনিবেশ করেছিল সেদিন। আর তাই এসে পড়েছে নওশাদ। আসেনি সিপিএম। কিন্তু ঐ চোপড়ার মিছিলটা যদি বামেদের না হয়ে বিজেপির হতো তাহলে যে ভাঙড় ফেলে মিডিয়া শুভেন্দু-সুকান্ত-দিলীপদের খুঁজে বার করে ফুটেজ এনে বাকি সারাদিন ধরে চালাতো না তার গ্যারান্টি আছে কি! আমাদের দর্শকদের অতীতের অভিজ্ঞতা কিন্তু তেমনই। ‘মাননীয়া’ সাংবাদিক অস্বীকার করতে পারবেন কি এই বাস্তবতা!
যদিও বর্তমান সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনার গুণমান নিয়ে আমাদের মানে রাইজ অফ ভয়েসেসের মূল প্রশ্নটা কিন্তু অন্য। সাংবাদিকতা পেশায় এই সাংবাদিক মহাশয়ার দক্ষতা ও সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। আমরা বা আমাদের জানাশোনার পরিসরে অনেকেই তাঁর গুণমুগ্ধ দর্শক এবং শ্রোতা। কাজেই, দারুণ প্রাসঙ্গিক তৃণমূল-বিজেপি, শওকত-নওশাদদের ভিড়ে শূন্য অপ্রাসঙ্গিক সিপিএম হারিয়ে গেলে যাক, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা চাইবো সাধারণ মানুষ বা মানুষের খবর আরও বেশি করে তুলে ধরুক সংবাদমাধ্যমগুলো! কিন্তু সেটা কি হচ্ছে আদৌ!
বিগত ছ-সাত বছরে ধরে গ্রাম বাংলা জুড়ে ঘটে চলা সারের দেদার কালোবাজারি, গ্রামীণ সমবায় ব্যবস্থা লাটে উঠে যাওয়ায় বেসরকারি ‘ক্ষুদ্র’ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর জোরজুলুম, চাষিদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, মান্ডিগুলোতে ফড়ে-দালালদের দাপটবৃদ্ধি ও কুপনবিলি নিয়ে স্বজনপোষণ ও কেলেঙ্কারি, গ্রামে গ্রামে পরিযায়ী শ্রমিক ও পরিযায়ী কৃষকের বাড়বাড়ন্ত, জেলায় জেলায় একের পর এক কৃষক আত্মহত্যার কথা, গ্রাম বাংলায় অস্বাভাবিক হারে ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুরদের সংখ্যাবৃদ্ধি ইত্যাদি খবরগুলো বেশি বেশি করে উঠে আসুক প্রাইম টাইমে যা ইদানীং প্রায় দেখাই যায় না। শেষ কবে এই সমস্ত জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কোন মিডিয়া বা চ্যানেলে হইচই হয়েছে আমরা মনে করতে পারছি না! সাংবাদিক ম্যাডামের কি মনে আছে! এমনকি বিগত এক দশক ধরে কলকাতা শহরে বসে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের চালিয়ে যাওয়া বেলাগাম দুর্নীতি ও তাদের বেনামী ফ্ল্যাটে সাজানো সারি সারি টাকার বান্ডিলের খবরও আমাদের জানতে হয়েছে আদালতের নির্দেশে ও নজরদারিতে ইডি/সিবিআই তদন্ত হয়েছে বলে! ‘মাননীয়া’ সাংবাদিকের মত শহরের নামজাদা সাংবাদিককূলের একজনও কেউ এব্যাপারে ‘কিচ্ছু’টি জানতো না এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য! নাকি কেষ্টোর বীরভূমের মত সাংবাদিকদের মাস মাইনে চলে এখানেও!
কাজেই আমরা চাইবো সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা আত্মসমালোচনা করুক তাদের বিগত এক দশকের কাজকর্মের। তা নাহলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিজেপি-তৃণমূল, শওকত-নওশাদদের প্রাসঙ্গিকতার চাপে মানুষ এবং মানুষের রুটিরুজি জীবন-জীবিকার সমস্যাগুলো চিঁরে চ্যাপ্টা হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে যে!
তাই চ্যাটারবক্স মিডিয়া ও তার কর্মীবৃন্দ আত্ম-সমালোচনার ‘চ্যারিটি’টা নিজেদের ‘হোম’ থেকে শুরু করলে ভালো হয়!
সবাই ভালো থাকুন।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
পুনশ্চ: মাননীয়া সাংবাদিক সিপিএমের দিপ্সীতা-ঐশীদের দেখতে পাচ্ছেন না বুঝলাম! নির্বাচন কমিশনের দরজায় ‘অশক্ত’ বিমানবাবুকে দেখলেন তাও বুঝলাম! কিন্তু তার অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা বাম যুব নেতৃত্ব পরিবেষ্টিত সেলিম-সুজনকে কেন দেখতে পেলেন না বা ‘শক্ত’ শরীরের মীনাক্ষী-সৃজন-প্রতীকুরদের কেন দেখতে পান না জানলে ভালো লাগতো। আপনাদের চ্যানেলগুলোতে অতিথি হিসেবে আসা শতরূপ-সায়নরা কিন্তু জেলায় জেলায় জনসভা করে বেড়ায়, তার ফুটেজ আপনারা পান কি?
Barun Kar
সঠিক সংবাদ পরিবেশনের অভাব প্রতিনিয়ত অনুভূত হচ্ছে।
Sanghamitra Chakraborty
একদম সঠিক কথা।