পোর্ট অফ কলকাতা / Kolkata Port Files

এই রাজ্যে যখন একজন সাধারণ মানুষ প্রাক্তন মন্ত্রীর দিকে তাক করে জুতো ছোড়েন, তখন সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন করে, “আপনি কি খালি পায়ে বাড়ি যাবেন?” আসানসোল আদালত চত্বরে “গরুচোর” বলে কেউ চিৎকার করলে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন, “কাকে বলছেন?” কিন্তু মেয়র-কাম-পুরমন্ত্রীর নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে খানাখন্দে ভরা রাস্তায় ট্রাক উল্টে সেই অঞ্চলের শাসক দলের কাউন্সিলরের পুত্র মারা যাওয়ার পরে, একটিও প্রশ্ন ওঠে না! ডিলিমিটেশন কমিটি ২০১১ তে কলকাতা পোর্ট বিধানসভা কেন্দ্র তৈরি করা থেকেই রাজ্যের বর্তমান পুরমন্ত্রী এখানকার বিধায়ক, শেষ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে তার ঘোষিত সম্পত্তির পরিমান কয়েক লাখ থেকে ১৩ কোটিতে পৌছে গেছে, তারপরেও খিদিরপুর, মোমিনপুরের রাস্তা আজও খানাখন্দে ভরা, কেন?

এর উত্তর দিতে গিয়ে হয়তো শুরু হবে কাদা ছোড়াছুড়ি, এক দল বলবে, এটা পোর্টের জায়গা, আরেক দল বলবে, রাস্তা দেখবে পিডব্লুডি। কিন্তু যতই যাই হোক, কেন্দ্র রাজ্য কাজ হয়নি বলে ট্যাক্স নিতে এক্কেবারেই ভুলবে না, সে তারা হাত ধরাধরি করে নিতেই থাকবে, কিন্ত রাস্তা, তা ঠিকভাবে মেরামতি হবে না।

কলকাতা পোর্ট, কলকাতা পুরসভার বর্তমান মেয়র এবং রাজ্যের পুরমন্ত্রী থাকেন এই বিধানসভা এলাকায়, কলকাতা পুরসভার সামনে যে অ্যাস্টন মার্টিন গাড়িটা মাঝে মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়, সেটার মালিকও এই বিধানসভা এলাকার কাউন্সিলর। এক সময় সংবাদ শিরোনামে আসা হরিমোহন ঘোষ কলেজও এখানে, সেই কলেজ যেখানে খোলা রাস্তায় পুলিশ গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিল। বহু রাজনৈতিক ওলটপালটের সাক্ষী এই বিধানসভা কেন্দ্র। আজ রইল সেই ওলটপালটের গপ্পো।

রাম পেয়ারে রাম, একদা এই অঞ্চলের কংগ্রেস বিধায়ক এবং বর্তমানে কলকাতা পুরসভার ৭৯ নাম্বার ওয়ার্ডের পাঁচবারের পুরপিতা। তার পুত্র গত শনিবার ওভারলোডেড ট্রাক চাপা পড়লেন, চিরেচ্যাপ্টা হয়ে মারা গেলেন সেই ৭৯ নাম্বার ওয়ার্ডেই। কিন্তু মিডিয়া, একটিও প্রশ্ন তুলল না। নিহতের পরিচয় জানা মাত্রই মিডিয়া ব্ল্যাক আউট, পজিটিভ নিউজ করার তাগিদ হয়ত। শুধু এইটুকু কনফার্ম করা হল, ফিরহাদ হাকিম কনফার্ম করেছেন, ট্রাক চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি কাউন্সিলর রাম পেয়ারে রামের পুত্র, রাম কিঙ্কর রাম। ব্যাস, খবর শেষ।

পুরমন্ত্রীর বিধানসভা

ডিলিমিটেশন কমিটি কলকাতা পোর্ট বিধানসভা তৈরির আগে, এই অঞ্চল কবিতীর্থ বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। আর এই অঞ্চল ছিল কংগ্রেস এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের স্ট্রংহোল্ড। বিধানসভার লড়াই চলত ফরওয়ার্ড ব্লকের কালিমুদ্দিন শামস আর কংগ্রেসের রাম পেয়ারে রামের মধ্যে। এই প্রসংগে বলে নেওয়া ভাল, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি যারা দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাম পেয়ারে রাম। ১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৮৭, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৬ এর নির্বাচনে এই অঞ্চলের বিধায়ক ছিলেন তিনি। তার জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে ১৯৯৬, ২০০১-এ ফরওয়ার্ড ব্লকের কালিমুদ্দিন শামস নির্বাচনে কবিতীর্থ ছেড়ে লড়াই করতে গিয়েছিলেন অপেক্ষাকৃত সেফ সিট নলহাটিতে। ঠিকঠাক সব চলছিল, কিন্তু তাল কাটে ২০১১ তে। ডিলিমিটেশন কমিটি বাতিল করে কবিতীর্থ বিধানসভা কেন্দ্র, তৈরি হয় কলকাতা পোর্ট বিধানসভা। তখন ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথর সরাতে তৈরি হয়েছে হয়েছে মহাজোট। একসাথে কংগ্রেস আর তৃণমূল, সাথে এনসিপি, এসইউসিআই, জিএনএলএফ, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা আর পিডিএস।

কংগ্রেসের সাথে তৃণমূলের জোট থাকায় কলকাতা পোর্ট সিট কংগ্রেস ছেড়ে দেয় তৃণমূল কংগ্রেসকে। ২০০৯ তে আলিপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে উপ-নির্বাচনে জেতা ফিরহাদ হাকিম টিকিট পান কলকাতা পোর্ট কেন্দ্রে। কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর তীব্র ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে নির্দল হিসেবে ওই কেন্দ্রে মনোনয়ন পেশ করেন রামবাবু। সামনে তৃণমূলের ফিরহাদ আর কলিমুদ্দিন শামসের পুত্র ফরওয়ার্ড ব্লকের মইনুদ্দিন।

২০১১ এর নির্বাচনে পরিবর্তনের তুমুল হাওয়ায় পোর্ট এলাকার মানুষ হাত তুলে সমর্থন দিলেন কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রার্থী ফিরহাদ হাকিমকে। দ্বিতীয় হলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের মইনুদ্দিন এবং তৃতীয় রামবাবু। নির্দল প্রার্থী হলেও তিনি নিজস্ব ক্যারিশ্মায় পেয়েছিলেন ২২,০০০+ ভোট। বিজেপি সেই সময় বাংলার মাটিতে গুরুত্ব পেতো না, ৩,০০০ ভোটও পায়নি তারা ওই বিধানসভায় সেবার।

২০১১ তে হল পরিবর্তন, আর পরিবর্তনের তিন মাসের মধ্যেই ৬ বারের বিধায়ক রামবাবু সব ক্ষোভ ভুলে সস্ত্রীক যোগ দিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে। সাথে সাথে পোর্ট এলাকার কংগ্রেস বিলীন হল তৃণমূলে। তাহলে পোর্ট এরিয়াতে তৃণমূল বিরোধী রইল কেবল ফরওয়ার্ড ব্লক, কিন্তু সেই অঞ্চলের নেতা একদা খাদ্যমন্ত্রী কালিমুদ্দিন শামস অসুস্থ, সেই অঞ্চলের ফরওয়ার্ড ব্লকের দায়িত্বে তার দুই ছেলে, মইনুদ্দিন আর নিজামুদ্দিন। ২০১৩ এর মার্চে কালিমুদ্দিন শামস মারা যাওয়ার পর পরেই, সেই বছর অক্টোবরে তার দুই পুত্র যোগ দেয় তৃণমূলে। এইভাবে পোর্ট এলাকার ফরওয়ার্ড ব্লকও বিলীন হয় তৃণমূলে। মানে ২০১১ থেকে ২০১৩, পোর্ট এলাকার কংগ্রেস আর ফরওয়ার্ড ব্লক দুজনেই দলবল নিয়ে তৃণমূলে। বিরোধিতা করবে কে?

এই উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই শুরু হল তৃণমূল আর কংগ্রেসের মধ্যে খোটাখুটি, ভেঙ্গে গেল মহাজোট।

চলে এলো ২০১৬, জোট হল বাম কংগ্রেসের। পোর্ট এরিয়াতে যেহেতু ফরওয়ার্ড ব্লকের সংগঠন বলে কিছু আর নেই, তাই বামফ্রন্ট সিট ছাড়ল কংগ্রেসকে। লড়াই করলেন কংগ্রেসর রাকেশ সিং, সেই রাকেশ সিং যাকে আমরা এখন বিজেপি নেতা হিসেবে চিনি, আরো ভালো করে বললে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে ড্রাগ কান্ডে কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারপর জামিনে ছাড়া পাওয়ার মিডিয়াতে ওনার খবর আর পাওয়া যায় না, সম্ভবত এখনও বিজেপিতেই আছেন। আর মইনুদ্দিন, তিনি হচ্ছেন উনি, যিনি গত নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে কান্নাকাটি করে ফরওয়ার্ড ব্লকে ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃত্ব তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে। আর রইল নিজামুদ্দিন, ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন এই তৃণমূল নেতা আজ ৭৫ নাম্বার ওয়ার্ডে ৬৬% সমর্থন পেয়ে কাউন্সিলর। এখানে জেনে রাখা ভাল সম্প্রতি ফরওয়ার্ড ব্লকও দ্বিখন্ডিত, যাদের একটি অংশ তাদের দলের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের জন্ম শতবর্ষে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করেন, আর আরেক অংশ বামেদের সাথে মিছিলে অংশগ্রহণ করে।

তা যাই হোক, এত বড় বড় রথী মাথারথী এই কেন্দ্রে, কিন্তু এদের এত ডিটেইল কাহিনী আগে শুনেছেন কি? শুনেছেন কি একটা কেন্দ্রের সব বিরোধী বিলীন হয়েছে শাসক দলে? শাসক থেকে বিরোধী সবাই যখন এক দলে, তখন সেখানে তো স্বর্গীয় উন্নয়ন হওয়া দরকার। কিন্তু হয়েছে কি?

এই কেন্দ্রেই এত রাজনৈতিক ওলটপালটের পর একটু বর্ষায় রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়ে, এলাকার রাস্তায় ইয়া বড় বড় গর্ত হয়ে থাকে, আর সেই গর্তে ওভারলোডেড লরি উল্টে মারা যায় ৬ বারের বিধায়ক এবং বর্তমান কাউন্সিলরের ছেলে।

দুর্ঘটনাস্হল

তবে, এই অঞ্চলের লোকেদের ভোটে জিতে আসা পুরমন্ত্রী অথবা বন্দর কর্তৃপক্ষ কিন্তু আজ রাবিশ দিয়ে গর্ত বুজিয়েছেন, ঠিক পুকুর বোজানোর স্টাইলে। রাস্তা ঠিক করে সারাইয়ের কাজ শুরু হয়নি। কেনো আর হবে? যদি এই অঞ্চলের ওয়ার্ড থেকে এমনি এমনি ৯০% ভোট পাওয়া যায়, তাহলে ফালতু পয়সা খরচ করে কি হবে? তাহলে যেমন চলছে, চলুক। বিধায়ক ফিরহাদ হাকিমকে প্রশ্ন করে হবে কি? উনি তো প্রায় ৭০% শতাংশ মানুষের আশীর্বাদ নিয়েই খানাখন্দে ভরা রাস্তার তদারকি করছেন।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস