যাদের হয়ে বলার কেউ ছিল না / IT Professionals

আইটি প্রফেশনাল। মানে একজন পেশাদার তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী।

আমরা মাঝরাত পর্যন্ত বাড়িতে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করি। কারণ আমাদের একটা পেশাদারী দায়িত্ববোধ এবং দায়বদ্ধতা আছে। আবার সক্কাল সক্কাল ফ্রেশ হয়ে নাকে-মুখে গুঁজে ঢুলু ঢুলু চোখে লোকাল ট্রেনে গুঁতিয়ে সেক্টর ফাইভের ঝাঁ-চকচকে অফিসপাড়ায় ছুটে যাই। কারণ সময়ে অফিসে পৌঁছানোটাও পেশাদারিত্বের নমুনা। তারপর ঘাড় গুঁজে সারাদিন ফের ল্যাপটপ খুলে কাজ। সেভাবে দেখলে আমরা যারা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করি, তারা নাওয়া খাওয়া, বাথরুম, সারাদিনে টুক করে কয়েকঘন্টার পাওয়ার ন্যাপ আর ভিড় ঠেলে অফিস যাতায়াতের সময়টুকু বাদ দিলে, সারাদিনই প্রায় বলতে গেলে ল্যাপটপে কাজ করি। এখন এই যে আমাদের সারাক্ষণ এত কাজ কাজ কাজ… এটাকে কি “শ্রম” বলে! মানে আমরা কি “শ্রমিক”! আর এই প্রশ্নের সামনে এসেই আমরা হোঁচট খাই। কারণ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও সামাজিক “শ্রেণী”বিন্যাস বেঁচে রয়েছে। আমাদের আত্মশ্লাঘার প্রায় অনেকটাই এই শ্রেণীবিন্যাস ঘিরে। আমি ব্র্যান্ডেড জামা কাপড় পরি , ঝাঁ চকচকে অফিসে কাজ করি, উইকএন্ডে কাজের চাপ না থাকলে বর-বউ-বাচ্চা মিলে মলে বেড়াতে যাই, সিনেমা দেখি, পপকর্ন খাই, কাজেই আমরা কখনই কল-কারখানায় কাজ করা মুটে-মজুর-লেবার হতে পারি না। আর সেইজন্যই অফিস পলিটিক্স / নেপোটিজম কিম্বা ভয়াবহ বেতন বৈষম্যের শিকার হলেও একজোট হয়ে প্রতিবাদ করার কথা ভাবতে পারি না। আর এরই সুযোগে বিলাস বহুল অফিস ইমারতগুলোর খোপে খোপে অত্যাচার ও শোষণ দিন দিন বাড়তে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ নীচে দেওয়া হল শেষ দশ বছরে দেশের বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সিইও এবং সেখানকার ফ্রেশারদের বেতন বৃদ্ধির বৈষম্যর ছবিটা! মোবাইল ব্যবহারকারীরা বাম থেকে ডানে স্ক্রোল করে সম্পূর্ণ তথ্য দেখুন।

সংস্থা২০২২ সালে সিইও-এর বেতন (বার্ষিক/টাকা)২০১২ সালে সিইও-এর বেতন (বার্ষিক/টাকা)দশ বছরে বেতনবৃদ্ধি
(%)
২০২২ সালে ফ্রেশারের বেতন (বার্ষিক/টাকা) ২০১২ সালে ফ্রেশারের বেতন (বার্ষিক/টাকা) দশ বছরে বেতনবৃদ্ধি
(%)
ইনফোসিস৭৯.৭৫ কোটি.৮০ কোটি ৯,৮৬৮%৩.৬ লক্ষ২.৭৫ লক্ষ৩১%
উইপ্রো৬৪.০০ কোটি.১০ কোটি১,১৫৪ %৩.৫ লক্ষ২.৪ লক্ষ৪৬%
টিসিএস৩৪.০০ কোটি.০০ কোটি৩২৫%৪ লক্ষ১.৬ লক্ষ১৫০%
টেক মাহিন্দ্রা২৯.০০ কোটি.০০ কোটি২,৮০০%৩.৪ লক্ষ২.৫ লক্ষ৩৬%
এল এন্ড টি ইনফোটেক২৬.০০ কোটি.৬৩ কোটি১,৪৯৫%৪.৫ লক্ষ২ লক্ষ১২৫%
এইচসিএল২২.০০ কোটি.৪০ কোটি১৬১%৩.৫ লক্ষ৩ লক্ষ১৭%
মেডিয়ান৩১.৫০ কোটি.৩৭ কোটি৮৬৪%৩.৫৫ লক্ষ২.৪৫ লক্ষ৪৫%
তথ্য : মানিকন্ট্রোল রিসার্চ

এতটা বৈষম্য! হ্যাঁ, ঠিক এতটাই। কিন্তু, এই প্রসঙ্গ উঠাবে কারা? একা একজন! নাহ্, এক এক করে, হাতে হাত ধরে অনেকজন, যার গালভরা নাম, “ইউনিয়ন”।

কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে কথা না বলাটাই অথবা ইউনিয়নবাজি না করাটাই আইটি পেশাদারিত্বের অঙ্গ, এমনটাই আমাদেরকে একপ্রকার পাখি পড়ানোর মত বোঝানো হয়েছে। একজোট হলেই লোকে বলবে “ইউনিয়নবাজ”। তারচেয়ে বরং অফিস যাওয়া-আসার পথে বাসে-ট্রামে-ট্রেনেতে-অটোতে লেবার ইউনিয়নগুলোকে অবিলম্বে ব্যান করা উচিৎ বলে চিৎকার করাটাই অনেক বেশি, যাকে বলে “ইন”, কাজেই আমরা অনেকেই সেটাই করি। ভাবখানা এমন দেখাই যেন এই লেবার ইউনিয়ন গুলোই দেশের কর্মসংস্কৃতিটাকে তিলতিল করে নষ্ট করেছে। অথচ “ন্যাসকম” নামক সংগঠনটি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার সাথে যুক্ত “শিল্পপতিদের ইউনিয়ন” কিনা, ভেবে দেখবার সময় পাই না। যদিও জানি এনারা মাঝেমধ্যেই একত্রিত হয়ে মিটিং করে নিজেদের মুনাফা বাড়াতে দাবি-দাওয়ার লিস্টি বানিয়ে দেশের নেতা-মন্ত্রীদের সাথে দেখা করেন এবং আদায়ও করেন। কিন্তু তাও এটাকে শিল্পপতিদের ইউনিয়ন বলা যাবে না। বরং অ্যাসোসিয়েশন নামটা বেশ চমৎকার। আর আমরা হলাম গিয়ে ঝাঁকের কই। মেনেও নিয়েছি। “আউট অফ বক্স” থিঙ্কিংটা শুধুমাত্র অফিসের ব্যবসা বাড়াতে যতটুকু দরকার, ততটা ভাবাতেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ বলে আমাদের শেখানো হয়েছে। আমাদেরকে শেখানো হয়েছে শিল্পপতিদের বেশি মুনাফা মানেই বেশি বিনিয়োগ, আর বেশি বিনিয়োগ মানেই বেশি কর্মসংস্থান অর্থাৎ বেশি কাজ বা চাকরির সুযোগ। কাজেই আমরা নুন খাই, আর গুণ গাই। আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নই। হায়ার এন্ড ফায়ারের তত্ত্বে তাই আমাকেও বিশ্বাস করতে হয়, কারণ ভয় যে আমাদের অন্যতম “জন্মগত অধিকার”।

কিন্তু সব জায়গাতেই কিছু অবাধ্য লোকজন থাকে। যারা একটু স্বাধীনচেতা। ঝাঁকের কই না। মানে যাদেরকে আসল “আউট অফ বক্স” বলা যায়। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও তার থেকে ব্যতিক্রম হবে কেন! এই তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা মন দিয়ে নিয়ম-নিষ্ঠার সাথে অফিসের কাজ করেন, আবার দিনের শেষে নিজেরদের অধিকার, ন্যায্য বেতন বুঝে নিতে পিছপা হন না। বরং তাঁরা মনে করেন, এটা হল তাদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। কোথাও কোন সহকর্মীকে হেনস্থা হতে দেখলে এগিয়ে যান, সাহায্যের হাত বাড়ান। তাঁরা মনে করেন এটুকু সহমর্মিতা না দেখালে “কলিগ” হয়ে লাভ কি! এভাবেই শুরু হয়েছে পথ চলাটা! এদের একটা পোশাকি নাম আছে- All India IT & ITES Employees Union বা সংক্ষেপে AIITEU।

এরা নিঃশব্দে কাজ করে। খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায় এদের কথা শোনা যায় না। আসলে বর্তমানে কর্পোরেট চালিত এবং পালিত সরকারী ব্যবস্থায় অধিকারের চেয়ে আনুগত্যের গুরুত্ব বেশি। আমরা প্রায় সবাই এটা মেনে চলি। এর একটা গালভরা ইংরাজী নামও আছে – লয়ালিটি। কিন্ত স্বামীটি লয়াল বললে, স্ত্রৈণ না বিশ্বস্ত কোনটা বোঝায়, যেমন আমরা গুলিয়ে ফেলি, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলিও গুলিয়ে ফেলছে তারা কাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, মানুষের কাছে না মালিকের কাছে। আপাতত মালিকের দাবিমত কর্মীদের ইউনিয়নবাজিকে বাঁকা চোখে দেখিয়ে বা এদেরকে একদম না দেখিয়ে মালিকের অ্যাসোসিয়েশানকেই গ্লোরিফাই করে চলেছে। তাই আর পাঁচটা শ্রমিক ইউনিয়নের মত AIITEU-র কর্মকান্ড সংবাদমাধ্যমে আসে না।

অবশ্য একতরফা ভাবে সংবাদমাধ্যমকে দোষ দেওয়া চলে না। AIITEU একটি নতুন সংগঠন। কর্মসূচী তুলে ধরার বা প্রচারের কোনো সিস্টেমেটিক মেকানিজম এরা এখনও তৈরি করে উঠতে পারেনি। সোশ্যাল মিডিয়া প্রেজেন্সও তেমন নেই এদের। নেই নিজেদের কোনো সংবাদমাধ্যম/মুখপত্র। সুতরাং এরা কি করছেন না করছেন, তা সাধারণ মানুষের না জানাই স্বাভাবিক। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত অসংখ্য কর্মীও এদের কথা জানেন না।

তাই তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত কর্মীদের বলছি, এনাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিন। ইতিমধ্যেই AIITEU বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক কাজ করেছে। তার একটা লিঙ্ক দেওয়া হল নীচে।

https://www.aiiteu.org/updates/press-releases/

কাজেই এদের সাথে কথা বলুন। এদের ভালো-মন্দ বিচার করুন। নিজেদের কর্মজীবনের সুখ-দুঃখ সমস্যার কথা ভাগ করে নিন AIITEU-র সাথে। হয়ত আপনার কর্মজীবনের অনেক সমস্যার সমাধান বা সুরাহা পেয়ে যেতে পারেন এদের মাধ্যমে।

ধন্যবাদান্তে
একবিংশ শতকের এক আইটি শ্রমিক

তথ্যসূত্র :
a) https://www.moneycontrol.com/news/business/it-ceo-pay-shot-up-835-in-a-decade-while-freshers-salary-grew-45-8602591.html/amp
b) https://www.aiiteu.org/