বাঁকুড়ার ‘জামবেদিয়া’- ফের কি এক আমলাশোল! / Amlasol 2.0

তৃণমূল সরকারের জমানায় বাঁকুড়া জেলার ছাতনা বিধানসভার ‘জামবেদিয়া’ গ্রাম ফের উসকে দিল তথাকথিত ও মিডিয়া বর্ণিত ‘আমলাশোল’ এর স্মৃতি! এখন আমলাশোলের আগে কেন ‘তথাকথিত’ এবং ‘মিডিয়া বর্ণিত’ বিশেষণ দুটো যোগ করা হয়েছে সেটা প্রতিবেদনের শেষে লিখবো। আগে ছোট করে জেনে নেওয়া যাক ‘জামবেদিয়া’র ঘটনাটা ঠিক কি!

বাঁকুড়া ১নং ব্লক এলাকার কালপাথর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত জামবেদিয়া বাউরি পাড়া। এখানেই বাস ১৫টি বাউড়ি পরিবারের। তাদের এই মুহুর্তে দিন কাটছে চরম দারিদ্রে এবং কার্যত অনাহারে। যেমন ধরা যাক সত্তরোর্ধ্ব অজিত বাউরির পরিবার। বয়সের কারণে অজিত বাউড়ির কাজ করার কোন ক্ষমতা নেই। তার মেয়ে কোকি বাউরি জন্ম প্রতিবন্ধী। সে একদিকে যেমন মূক-বধির, অন্যদিকে তার দুটো পা-ই অচল। আর ছেলে রাখহরি বাউড়ি জনমজুর। সপ্তাহে কোন দিন কাজ জোটে কোনদিন জোটে না। ফলে উপার্জন প্রায় নেই বললেই চলে। তারওপর অজিত বাউড়ির বার্ধক্য ভাতা বিগত দু-বছর হয়ে গেলো কোন অজ্ঞাতকারণে বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়ে কোকি বাউড়িরও প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার কথা হলেও সে কিছুই পায় না। পঞ্চায়েত ও ব্লক অফিসে এবং তৃণমূলী মাতব্বরদের দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরেও অজিত বাউড়ি ও তার পরিবার কোন সরকারি ভাতাই জোটাতে পারেননি।

ভরসা বলতে রেশনের মাসিক ২০ কেজি চাল। আর রাখহরির জনমজুরের কাজ করে সামান্য কিছু অনিয়মিত রোজগার। আর তাতেই আধপেটা খেয়ে কোনরকমে দিন গুজরান। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অপুষ্টির কারণে এদের শরীরে যত দিন যাচ্ছে তত নানাবিধ রোগ-ব্যাধি বাসা বাঁধছে। মাথা গোঁজার যে আস্তানাটা রয়েছে সেটার অবস্থাও শোচনীয়। ঐ এলাকার কোন বাউড়ি পরিবারই সরকারি আবাস যোজনায় বাড়ি পায়নি। খোঁজখবর করে এমনটাই আমরা জানতে পেরেছি।

সরকার ও পঞ্চায়েত তৃণমূলের হলেও স্থানীয় বিধায়ক এবং সাংসদ দুজনেই কিন্তু বিজেপির। সাংসদ তো আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও বটে! তাতেও যে কপাল খোলেনি জামবেদিয়ার বাঊরিদের তা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট। কাজেই আঙ্গুল শুধু শাসকদল তৃণমূলের দিকে নয়, খাতায় কলমে প্রধান বিরোধীদল বিজেপির দিকেও উঠবে! তাদের নেতা-মন্ত্রীদের অগোচরে তাদেরই নাকের ডগায় এমন মর্মান্তিক জীবন-যন্ত্রণার আলেখ্য চলতে থাকলে তা বিজেপির রাজনৈতিক ব্যর্থতাকেই একপ্রকার বেআব্রু করে!

আর বঙ্গ সংবাদমাধ্যমও বহুদিন হলো এসব খবর করা ছেড়ে দিয়েছে। বাম আমলে এই মিডিয়াই কিন্তু আমলাশোল নিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল! তাদের বক্তব্য ছিল আমলাশোলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। পিঁপড়ের ডিম খেয়ে কোনমতে বেঁচে আছে। তৎকালীন শহুরে জনমানসে এই ‘পিঁপড়ের ডিম’এর অভিঘাত হয়েছিল মারাত্মক। চারিদিকে বাম সরকারের নামে ছিছিক্কার পড়ে গেছিল। যদিও পিঁপড়ের ডিমের চাটনি ওখানকার একটি বহুল প্রচলিত খাবারের পদ, যার পোষাকী নাম, ‘কুরকুটের চাটনি’ আবার কোথাও ‘কাই পিমপুড়ি’। এখনও রমরমিয়ে মানুষ তা খায়। কিন্তু এসব কথা তো আর সেসময়ে ‘কাগজে’ লেখা হয়নি। টিভির খবরে বলাও হয়নি। কেন লেখা বা বলা হয়নি তা আজও ‘অজ্ঞাত’!

যেমন এরি পোলু। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, রেশম পোকা আপনার থালায় সুস্বাদু খাওয়ার হিসেবে শোভা পেতে পারে? হ্যাঁ পারে, তা সম্ভব আমাদের পাশের রাজ্য আসামে। এখনো এই খাওয়ারের ইনগ্রেডিয়েন্ট দিয়ে রাজনীতিকরণ হয়নি বলে, এই খাওয়ার নিয়ে চর্চা কোনোদিন হয়নি। তবে এই সুস্বাদু খাওয়ার নিয়ে কোনোদিন যে কুখাদ্য বলে অন্যায় চর্চা শুরু হবে না, তার গ্যারান্টি আমরা দিতে পারছি না।

যাই হোক, তবে কি আমলাশোলে দারিদ্র অনাহার ছিল না! দারিদ্র অবশ্যই ছিল। সবাই যে ভরপেট খেতে পেতো এমনটাও নয়। ক্ষুধাও ছিল।

আমলাশোল ছিল আদতে একটি অতীব দুর্গম এলাকা। রাস্তাঘাট প্রায় ছিল না বললেই চলে! আর এই দুর্গমতার জন্যেই প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের খুব একটা নজরে আসতো না আমলাশোল এলাকার জীবন যন্ত্রণার করুণ কাহিনী। তারওপর জেলা পরিষদ বামেদের হাতে থাকলেও গ্রাম-পঞ্চায়েত ছিল নরেন হাঁসদার ঝাড়খণ্ড পার্টির, ফলে বামেদের তরফেও সেভাবে পঞ্চায়েত স্তরে সক্রিয় হওয়ার এবং হস্তক্ষেপ করবার সুযোগও ছিল না। কেউ কেউ অবশ্য বৈমাতৃসুলভ আচরণেরও অভিযোগ তোলে। কিন্তু সেই আমলাশোলকেই যাবতীয় দুর্গম পথ লঙ্ঘন করেই রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে তৎকালীন সংবাদমাধ্যম। সে জন্য তাদেরকে কুর্নিশ!

অথচ সেই সংবাদমাধ্যমই আজ তিন দশক পর প্রযুক্তিতে ভর করে আগের থেকে অনেক বেশি উন্নত এবং পেশাদারি হয়েও কেন বাঁকুড়া শহরের থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে অবস্থিত জামবেদিয়াতে পৌঁছতে পারছে না আমরা জানতে চাই! এখানেও কি সেই কোন ‘অজ্ঞাত’ কারণের গপ্পো!

যাইহোক, আশার কথা হলো তথাকথিত ‘শূন্য’ পার্টির মুখপত্রের জনৈক সাংবাদিক জামবেদিয়াতে পৌঁছেছে। আর তাদের হাতধরে পৌঁছেছি আমরাও।

আমরা চাই না বাম আমলের আমলাশোলের পুনরাবৃত্তি! সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যই এই প্রতিবেদন! সঙ্গে রইলো দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসুত্র:
a) https://ganashakti.com/news/Family-of-6-in-Bankura-suffering-from-extreme-hunger