হাই চান্স / The Game Is On!

৮:২৫-এর হাওড়া-মেদিনীপুর লোকাল। অফিস থেকে বেরোতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজকের অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিছু মানুষের কথোপকথন মাথার ভিতর ঘুমিয়ে পড়া পোকাগুলোকে আবার কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আজকের এই প্রতিবেদন।

আমার ঠিক উল্টোদিকেই বসেছিলেন ওনারা তিনজন। আমি হেডফোনে গান শুনছিলাম। ওনারাও নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলেন। কান চুলকাতে হেডফোনটা একটু নিচে নামাতেই কানে এল, “ভাইপোর হাই চান্স!” এই রে কি চান্স! তারপর এক এক করে যে সব চান্স শুনলাম, তাতে পাঁশকুড়া নামা অবধি আর হেডফোন কানে তুলতে পারিনি।

আজ আমরা সবাই জানি এনসিপি’র প্রতিষ্ঠাতা কাকা শরদ পাওয়ারের হাত থেকে ঘড়ি কেড়ে নিয়েছেন ভাইপো অজিত। মানে নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছে, বিজেপি’র জোটসঙ্গী অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী এনসিপি’র প্রতীকের আসল হকদার। ঠিক এমনটাই হয়েছিল মাস ছয়েক আগে শিবসেনার সাথে। দলের প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের পুত্র উদ্ভব ঠাকরের কাছ থেকে শিবসেনার প্রতীক মায় মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি পর্যন্ত ছো মেরে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন একনাথ শিন্ডে।

এবার নাকি সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বাংলায়! কে ঘটাবে? আমার সহযাত্রীদের কথা অনুযায়ী ঘটাবেন ভাইপো স্বয়ং! আর সেই সুত্রেই “ভাইপোর হাই চান্স” উক্তিটি করেছেন সেই সহযাত্রীদের একজন।

কেন তাদের এমনটা মনে হচ্ছে! সে ব্যাপারেও তাদের মতামত স্পষ্ট। আমাদের পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে যেভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থা ইডি একটা বিশ বছরের পুরোনো কেসে জেলে ঢোকাল, যে তৎপরতা দেখাল, সেটা কিন্তু আমাদের রাজ্যে পিসি বা ভাইপোর বিরুদ্ধে সম্পূর্ন মিসিং! ঠিক মহারাষ্ট্রের অজিত পাওয়ার-ছগন ভুজবলদের কেসের মত। ঘটনাচক্রে আজিত পাওয়ার হলেন আবার শারদ পাওয়ারের ‘ভাইপো’। শেষ কবে অজিত পাওয়ার এবং তার ঘনিষ্ঠ ছগন ভুজবলকে ইডি-সিবিআই ডেকে পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকার জলসেচ প্রকল্প কেলেঙ্কারি, সমবায় ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারি বা চিনি কেলেঙ্কারিতে ডেকে পাঠিয়েছে দুজনে চেষ্টা করেও মনে করতে পারবেন না। আজ যে বিজেপির দেবেন্দ্র ফাড়নবিশ অজিত পাওয়ারকে গালমন্দ না করে সকালে জল গ্রহণ করেতেন না সেই দেবেন্দ্র হলেন মহারাষ্ট্র সরকারে অজিতের মতই উপ-মুখ্যমন্ত্রী! মানে দুজনে একে ওপরের কলিগ! কাজেই আমার তিন সহযাত্রীদের মতে রাজনীতি যখন সম্ভাবনার শিল্প তখন কোন কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না!

কাজেই ভাইপো পিসির থেকে ‘ঘাসফুল’ চিহ্ন হাতিয়ে বিজেপির সাথে ভিড়ে গেলে অবাক হওয়ার কি আছে! ‘নতুন তৃণমূল’ এর সেই গপ্পোটা ভুলে গেলে চলবে! এমনকি ভাইপো সোজা বিজেপি দলে ভিড়ে গেলেও আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই! ‘হাই চান্স’। এটাই হলো তাদের মোদ্দাকথা।

‘ভাইপো’ বিজেপি তে! ধুস ! কি যে বলেন….

কিছুটা অসাবধানতাবশতঃ আমার মুখ ফস্কেই কথাটা বেরিয়ে এসেছিল!

তা শুনে এদের একজন আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন “পশ্চিমবঙ্গের ১০ টা খাঁটি বিজেপি নেতার নাম বলুন দেখি?”

“দিলীপ, তথাগত, শমীক, রাহুল সিনহা…”

আমি আটকে গেলাম। আর কোন নাম মাথায় আসছে না। যাদেরই নাম মনে আসছে, যাদেরই ছবি চোখের সামনে ভাসছে তাদের সবাই তো প্রাক্তন তৃণমূলী!

আমার সহযাত্রীটি আমার অবস্থা দেখে মুখে প্রশান্তির ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘আর মনে আসছে না তো’!

আমি ‘না’ বলাতে সোজা বলে দিলেন ‘বাকিগুলো সব তৃণমূলের সাপ্লাই দেওয়া মেটিরিয়াল! কাজেই সবই সম্ভব! এরা কে কোথায় কখন যাবে কিচ্ছু আগে থেকে বলা যায় না!’

কথাটা শুনে আমারও মনে হলো সত্যিই তো! বছর সাত-আটেক আগেও কেউ কি ভেবেছিল মুকুল, অর্জুন, শুভেন্দু, লকেট, জিতেন্দ্র, নিশীথ, অনুপম, সব্যসাচী, জল শোভন, শঙ্কুদেব, রাজীবের মত বাঘা বাঘা একঝাঁক তৃণমূল নেতা বিজেপি’র সাথে জুড়ে যাবেন? এদের অনেকে ফের তৃণমূলে ফিরে এলেও ফের যে তারা বিজেপির দিকে ঝুঁকবেন না সে গ্যারান্টি এদের বাড়ির বাপ-মা-বউ-বাচ্চারাই দিতে পারবে না তো আমি দেওয়ার কে! কাজেই একপ্রকার মানতে বাধ্য হলাম ভাইপোর ‘হাই চান্স’!

কিন্তু বাড়িতে আমার বউ যে ‘দিদি-ভক্ত’! আমিও যে খুব একটা দিদি কে অপছন্দ করি তেমনটাও নয়…. ভোটও তো দিয়েছি! যদিও গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে শুভেন্দুকে হেব্বি লাগতে শুরু করেছিল। শিক্ষামন্ত্রী ও তার বান্ধবীর খাটের তলা থেকে বান্ডিল বান্ডিল টাকা উদ্ধারের পর তো ‘রাম-রাম’ করে উঠেছিলাম! তারপর থেকে তৃণমূলকে গালি দিয়ে শুভেন্দুর হয়ে গলা ফাটাতে গিয়ে বউএর সাথে বেশ কয়েকবার ঝগড়া পর্যন্তও হয়ে গেছে! কিন্তু আমার সহযাত্রীরা সব গুলিয়ে দিল! মনের ভেতরটা খচখচ করতে লাগলো! তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কথাটা চালিয়ে যাই…. দেখি না শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! তাই সরাসরি প্রশ্ন করলাম ‘ভাইপো বিজেপি করবে তো বুঝলাম, কিন্তু বিজেপি ভাইপোকে দলে নেবে কেন?’

আমার সহযাত্রীরা সমবেত ভাবে জানালেন বিজেপি’র কেন্দ্রীয় থিঙ্কট্যাঙ্কের কাছে, শুভেন্দু-অভিষেকের গুরুত্ব প্রায় একই রকম। দুজনেই বড় নেতা, দুজনেরই সিঙ্গেল পয়েন্ট এজেন্ডা, একে অপরকে জেলের ঘানি টানানো। সংগঠন দুজনেই বোঝেন! অভিষেকের অ্যাডেড অ্যাডভান্টেজ উনি টেক স্যাভি, ঝড়ঝড়ে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারেন, ক্ষেপে গিয়ে গালিগালাজ দেন না। আর আইপ্যাকের সৌজন্যে তৃণমূলের সংগঠনে যেভাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আধিপত্য বিস্তার করেছেন, তাতে বিজেপি থিঙ্কট্যাঙ্কের কাছে ভাইপোরই বেশি নম্বর পাওয়া উচিৎ। তার ওপরে অভিষেকবাবু গোটা বাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নবজোয়ার যাত্রা করেছিলেন, ওদিকে শুভেন্দু’তো এখনো কাঁথি থেকে কোলাঘাট অবধি হেঁটে উঠতে পারেনি! উলটে ফাঁকা ব্রিগেডে গীতা পড়িয়ে রাজ্য বিজেপির মুখ পুড়িয়েছে! শেষ মুহুর্তে লোক হবে না খবর পেয়ে সফরসূচী বাতিল না করলে আর একটু হলে প্রধানমন্ত্রীরও মুখে চুন কালি পড়তো।

এদিকে বামেরা ক্রমশঃ শক্তিশালী হচ্ছে। নিজেদের প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী ছাড়ুন, রাজ্যে একটা সাংসদ, বিধায়ক ছাড়াই যেভাবে ৫০ দিন ধরে হেঁটে ব্রিগেড ভরিয়ে দিল, তাতে শুভেন্দুর জায়গায় অভিষেককে অগ্রাধিকার দিলে বঙ্গে বিজেপি’র সম্ভাবনা বাড়বে বই কমবে না। না হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতা এসে আর প্রশ্ন করেন, “বামেরা বাড়ছে কেন?”

আমি এনাদের কথা গুলো অস্বীকার করতে পারলাম না।

তাও বোধহয় আমার দোনামোনা ভাবটা বা মনের মধ্যেকার খচখচানিটা মুখে ফুটে উঠছিল, লুকোতে পারছিলাম না। তাই তিন সহযাত্রীর একজন যে ঢঙ-এ আমাকে বাকিটা বোঝালেন তাতে ইদানীং আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে ওঠা বিজেপি ঘনিষ্ঠ ইউটিউবার কাম সাংবাদিকদের কথা মনে পড়ে গেল!

ভদ্রলোকের বক্তব্য অতীতে যে সমস্ত তৃণমূলী নেতারা বিজেপিতে গেছেন তাদের সেই যাত্রাপথ নাকি হুবহু এক। প্রথমে চুপচাপ, তারপর নিজের বিধানসভায় আইসোলেশন, তার পরে “আমরা দাদার অনুগামী গোছের” পোষ্টারিং ক্যাম্পেন, তারপর ঘন ঘন বৈঠক, আর সবশেষে সবাইকে বেকুব করে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি যোগ। ঠিক পাঁচটা স্টেপ। অভিষেক ইতিমধ্যেই চুপচাপ হয়ে গেছেন। তার নিজস্ব লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারেই পুরো জোর ও বেশি সময় দেবেন বলে নিজেকে বাকি রাজ্য থেকে আইসোলেটেড করার ইচ্ছা প্রকাশও করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর বেরিয়েছে। দলের মধ্যে বয়সের উর্দ্ধসীমা নিয়ে বিতর্কটাও জিইয়ে রেখে নতুন তৃণমূলের হয়ে ক্যাম্পেন করার প্রক্রিয়াটাও তিনি যাথারীতি অব্যহত রেখেছেন। কুণাল ঘোষ বা দেবাংশু ভট্টাচার্যের মত অনেকেই আমরা অভিষেকদার অনুগামী বলে বাজারে ও সমাজমাধ্যমে খুল্লম-খুল্লা মুখও খোলেন। কাজেই দল বদলে ফেলার সমস্ত উপসর্গই স্পষ্ট বিদ্যমান।

কাজেই এরপর ভাইপো ব্যানার্জ্জী মহারাষ্ট্রের শিন্ডে বা পাওয়ার হলে বলবার কিছুই নেই।

কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্যকথা! অভিষেক বিজেপির হাত ধরলে বা বিজেপি জয়েন করলে আমার ইদানীং ‘হেব্বি’ লাগতে থাকা শুভেন্দুর কি হবে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেবেন্দ্র ফাড়নবিশের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সাচ্চা সনাতনী দেবেন্দ্র থুতু গিলে অজিত পাওয়ারের হাত ধরতে পারলে দলবদলু শুভেন্দু কেন ভাইপোর হাত ধরতে পারবে না!

আর এসব কথাবার্তার মাঝেই চলে এল পাশকুড়া।

তাই ‘বাই’ বলে ট্রেন থেকে একা নামতে পারলাম না। সঙ্গে নামলো ‘ভাইপোর হাই চান্স’ ভাবনাটাও।

ধন্যবাদান্তে,
তারক সামন্ত