বন্ডেজ বনাম ব্যান্ডেজ / My Name is Bond

বন্ড শব্দটা শুনলেই ট্যাক্সদীর্ন চাকুরিজীবি মহল উত্তেজিত হয়ে পড়েন, বিশেষ করে সরকার ঘোষিত বন্ড শুনলে তো সর্বাগ্রে ট্যাক্স বাঁচানোর উপায় বলেই খোঁজ খবর শুরু হয়।

তো ২০১৮ তে “আচ্ছে দিন” আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিজেপি সরকার চমৎকার নাম দিয়ে একটি বন্ডের নাম ঘোষণা করে – “ইলেক্টোরাল বন্ড”! বাংলায় যাকে বলে নির্বাচনী বন্ড বা আরও শুদ্ধভাবে বলতে গেলে নির্বাচনী ঋণপত্র। আমার মত গোলা পাবলিক ভেবে নিয়েছিল, হয়ত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের উৎসব , ভারতের নির্বাচনে টাকা জমা দিয়ে ট্যাক্স বা আয়কর বাঁচনো যেতে পারে। আমায় গালি দেবেন না । আমি বঙ্গবাসী, “আচ্ছে দিন” আর “উন্নয়ন” একসাথে চোখের সামনে ২৪x৭ দেখে দেখে বুদ্ধিটা বেশ কিছুটা ততদিনে গুলিয়ে গেছে। কাজেই নিজ গুণে ক্ষমা-ঘেন্না করে দেবেন।

কিন্তু যতদিন এগোল তত পরিষ্কার হতে লাগলো এই “ইলেক্টোরাল বন্ড” হল আসলে “না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা” হুঙ্কার ছাড়া এক চৌকিদার ও তার দলবলের একটু রেখে ঢেকে কালো টাকা হজম করার সরকারি প্রকল্প! তা বিষয়টা কি?

বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের থেকে ছলে, বলে, কৌশলে টাকা তুলে থাকে এবং সেই হিসেব বহির্ভুত টাকা বিভিন্ন ধূসর খাতে খরচ হয়। ২০১৪ তে ক্ষমতায় আসার পর এই “সব কা সাথ, খুদ কা বিকাশ” সরকার ব্যাপারটাকে গুছিয়ে ফেলল ইলেক্টোরাল বন্ড নাম দিয়ে। এতে কি হবে? এর মাধ্যমে যে কেউ যে কোন রাজনৈতিক দলকে যেকোন পরিমাণের অনুদান দিতে পারবে, দেশের অন্যতম ব্যাঙ্ক এসবিআই-এর মাধ্যমে। শুনতে খারাপ না লাগলেও , দেশের একটিমাত্র বোকার হদ্দ দল সিপিআই(এম) সুপ্রিম কোর্টে পুরো ব্যাপারটা অনৈতিক এবং বেআইনি দাবি করে কেস ঠুকে দিল। তোরা কোনোদিন এভাবে টাকা নিসনি, চিরটাকাল কৌটো নাচিয়ে এসেছিস ঠিক আছে, তাই বলে অন্যের খাওয়ার দিকে কুনজর কিসের?
যাকগে, বাদ দিন! এদের কান্ড কারখানা নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। আজ অব্দি এদের একটা কুচো নেতার নামেও বেআইনি টাকা লেনদেনের কোন অভিযোগ অব্দি কেউ করতে পারেনি। এই ঘোর বাজারি সভ্যতায় এরা গলিতে গলিতে চাঁদা তুলে আর সদস্যদের থেকে চাঁদা নিয়ে দল চালায় আবার সেভাবেই নাকি এরা দেশ-উদ্ধার করবে! কতটা সেকেলে আর বোকা ভাবতে পারছেন? সম্ভবত সেই বোকামির (যাকে ভদ্র ভাষায় দলীয় নীতি বলে) জোরেই ঠুকে দিয়েছিল কেসটা।

এদিকে কোর্টে কেস উঠলে সেটা নিজের নিয়মেই চলে । সেই চলার পথে ২০২১-এ কোর্টে একটি হিসেব পেশ হয় , তাতে দেখা যাচ্ছে ওই বোকার দলটি ছাড়া ভারতের প্রায় সবকটি স্বীকৃত দল এই বন্ডের মাধ্যমে টাকা নিয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি নিয়েছে বিজেপি (৬,৫৬৬ কোটি), দ্বিতীয় স্থানে কংগ্রেস (১,১২৩ কোটি) এবং তৃতীয় স্থানে সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে একটি আঞ্চলিক দল, তৃনমূল (১,০৯৩ কোটি)। শুধু তাই নয়, ২০১৮-১৯ এর পরের হিসেব অনুযায়ী তারাই দ্বিতীয় স্থান দখলে রেখেছে। কি চরম উন্নয়ন ভাবুন। বঙ্গবাসী হিসেবে এ আমাদের চরম গর্বের বিষয়।

যদিও এসব হিসেবে দেশবাসীর বিশেষ মাথাব্যথা হয়নি , হওয়ার কথাও নয়। কারণ, ২০১৪ পরবর্তী ভারতে অনেক বেশি জরুরি প্রশ্ন, কার বাড়ির ফ্রিজে কিসের মাংস রাখা আছে! আর বঙ্গবাসী তো উন্নয়নের আলোর ঠ্যালায় অন্ধপ্রায়।
সবকিছুই চমৎকার চলছিল , গোলমাল করে ফেলল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির অধীন পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ। ঐতিহাসিক রায় এল, ইলেক্টোরাল বন্ড সম্পুর্ন বেআইনি এবং অনৈতিক। আগামী ৩১শে মার্চের মধ্যে কোন দল, কার কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছে সেই তালিকা কোর্টের সামনে পেশ করতে বলা হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ককে। তারপর সেই টাকা ফেরাতে হবে সমস্ত দলকে।

এবার পালে বাঘ পড়েছে। প্রথমে হিসেব, তারপর ফেরত। যদিও এই কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আম দেশবাসী হিসেবে আমার সম্পুর্ন আস্থা আছে! তারা ঠিক কোন একটি কানাগলি খুঁজে বের করবেই, যাতে হিসেব না দিতে হয়, ফেরত দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই এবং সেটাকেই তখন “মাস্টার্সস্ট্রোক” বলে সংবাদমাধ্যমে ঢাক পেটানো হবে।

কিন্তু আমার মাথায় অন্য একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তৃণমূলকে এত টাকা দিল কে? কেন দিল?

এ ধরণের টাকা মূলত দেয় দেশের বিরাট বিরাট ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও কর্পোরেট সংস্থাগুলি। মূলতঃ তাদের বড় বড় প্রজেক্টের লালফিতের ফাঁস এড়াতে এবং শাসক এবং বিরোধী (আগামীর সম্ভাব্য শাসক) উভয়কেই খুশি রাখতে। ব্যাপারটা নিঃস্বার্থ নয়, সেটা সবাই জানে এবং বোঝে।

আর এখানেই আমার প্রশ্ন, ২০১১-র পর থেকে এ রাজ্যে তো একটি আলপিনের কারখানাও খোলেনি! অদূর ভবিষ্যতে খুলবে এমন কোন সম্ভাবনাও আছে বলে অতি আশাবাদী বাঙালীও এই মূহুর্তে মনে করে না। বরং তারা এই অব্যবস্থাটা মেনেই নিয়েছে।

বাংলার গ্রামে-গ্রামে কর্মক্ষম অথচ বেকার পুরুষ খুঁজে পাওয়া মুস্কিল, কারণ তারা সবাই ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক। এমন “সব পেয়ে গিয়েছি”র রাজ্যে একটি আঞ্চলিক দলকে (পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যাদের অস্তিত্ব নেই) এত টাকা দিল কোন গৌরী সেন? আর কেনই বা দিল ?

তাহলে কি বন্ডের গল্পটা এই রাজ্যে যেমন কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে তেমন? কি সেটা?

সেটা হল , উন্নয়নের বিনিদ্র কান্ডারি তৃনমূল , উন্নয়নের নাম করে যা সংগ্রহ করেছে, দুষ্টু লোকে যাকে বলে কাটমানি এবং যার পরিমান নাকি অকল্পনীয় , সেটাকেই ভুয়ো কোম্পানি খুলে তাদের মাধ্যমে বন্ড হিসাবে দলীয় তহবিলে ঢোকানো হয়েছে , তারপর সেই নাম-কা-ওয়াস্তে কোম্পানিও বিলীন হয়ে গিয়েছে। সন্দেহ করার কারণ চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে হাত পাকানো তৃণমূলের কাছে বেনামি কোম্পানি খুলে , ভুয়ো একাউন্ট খুলে টাকা এদিক ওদিক করার মুন্সিয়ানা আজ সর্বজনবিদিত।

তাহলে সেই বন্ডের তালিকা সত্যিই প্রকাশ হলে কি জানা যাবে? সত্যিই তৃনমূল বড় বড় ব্যবসায়ী সংস্থার কাছে “অনুদান” পেয়েছে, নাকি নিজেদের তোলাবাজির , চাকরি বিক্রির কালো টাকাই এভাবে ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে গ্রহণ করে সাদা করে নিয়েছে!

আপনাদের কি মনে হয় ? কমেন্ট বক্সে জানান। মানে বন্ডেজ মুক্ত গণতন্ত্র ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে রাজ্যের শাসকদলের করা দগদগে ক্ষতটা দেখিয়ে দেবে না তো?

ধন্যবাদান্তে
কুশল ভট্টাচার্য