অ-সংসদীয় বেসাতি / Unparliamentary procrastination

কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনায় ব্যবহৃত বিভিন্ন বিশেষ্য/বিশেষণ শব্দমালা এই মুহুর্তে অসংসদীয় বলে লোকসভা সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে। লোকসভার অভ্যন্তরে এসব শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা নম্বর টু-এর উচ্চারিত জুমলাও রয়েছে! এছাড়াও দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য, স্বৈরাচারী, লজ্জাজনক, নাটক, অযোগ্য, চামচা, ভণ্ডামি, স্নুপগেট, মিথ্যা, অসত্য, গদ্দার, কালাবাজার, কেনবেচা, দালাল, কুম্ভীরাশ্রু, হেনস্থা ইত্যাদি এমন কিছু শব্দবন্ধ রয়েছে সেই লম্বা তালিকায় যা দেখে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া!

যদিও কোন সাংসদ এই সমস্ত শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে না, তবে সংসদের কার্যবিবরণী থেকে তা বাদ যাবে যাকে টেকনিক্যাল ভাষায় বলা হয় “এক্সপাঞ্জ” করা ।

মানে শাসক তার বিভিন্ন কাযকর্মের কারণে লোকসভার অন্দরে যে তীব্র সমালোচনা ও ধিক্কারের সম্মুখীন হয়েছে, তার কোন সরকারী নথি রাখতে চাইছে না। ফলে আগামী প্রজন্মের কাছে কোন সম্মক ধারণা থাকবে না। বর্তমান শাসকের ভাবমূর্তি ঠিক কতটা মলিন বা অনুজ্জ্বল ছিল অথবা সরকারের সমালোচনায় বিরোধীরা লোকসভার অভ্যন্তরে ঠিক কতটা তৎপর এবং তীক্ষ্ণ ছিলেন, তার রেকর্ড রাখা হবে না। মানে সোজা কথায় আগামী প্রজন্মের জন্য এও হল এক ধরণের ইতিহাস চুরি। বিরোধীদের সমালোচনার ধার ও ভার কমিয়ে সরকারকে উদ্ধার করার সংসদীয় এবং আইনি অপচেষ্টা। আর এর পাশাপাশি সংসদের অভ্যন্তরে বিরোধীদের বিরোধীতাকে এভাবে খর্ব করে দেখিয়ে, গণতন্ত্রের কফিন তৈরির কাজটাও শুরু হল বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এমনিতেই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে দেশ ও বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদলগুলো কর্পোরেট সংস্থাগুলোর থেকে দেদার টাকা তুলে, তা দিয়ে ঘোড়া কেনাবেচার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিরোধীশূন্য সংসদীয় ব্যবস্থা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এসবের পরেও এবার যে কজন মুষ্টিমেয় বিরোধী প্রতিনিধি সংসদের অভ্যন্তরে শাসকের নানা কাজকর্ম নিয়ে মুখ খুলতে, সেই তাদের মুখেও লাগাম পরাবার সরকারী অপচেষ্টা শুরু হল। আমাদের বলতে দ্বিধা নেই এমন চেষ্টাকেই ফ্যাসিসিম বলে।

তাছাড়া আমরা দেখেছি মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন প্রাদেশিক রাজ্য সরকারগুলির কাজকর্মের সমালোচনাতেও সংসদ উত্তাল হয়। নতুন অসংসদীয় শব্দের তালিকা প্রকাশ করে সেসব ক্ষেত্রেও সমালোচনার ভাষায় রাশ টানা হল। মানে এখন থেকে সাংসদদের ডানা ছেঁটে রাজ্য সরকারগুলোকেও সংসদের মধ্যে অতিরিক্ত সুরক্ষা বর্ম দেওয়ার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হল। যেহেতু এই মুহুর্তে বেশিরভাগ প্রাদেশিকস্তরেই বিজেপি বা তাঁদের সমর্থিত এনডিএ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, ফলে এই নতুন বিধি-নিষেধের মাধ্যমে তাদের পক্ষেই অতিরিক্ত ঝোল টানবার যে চেষ্টা হল সে ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত। কিন্তু এর পাশাপাশি দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিম্নজ্জিত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানাবিধ স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও সংসদে গর্জে ওঠা প্রতিবাদী কন্ঠকে নখ-দন্তহীন করে দেওয়া হল। মানে বাংলা থেকে নির্বাচিত আঠারো জন বিজেপি সাংসদ সেভাবে আর সংসদের মধ্যে তৃণমূল সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারবেন না। অথবা মুখ খুললেই বাধা দেওয়া হবে। আর এসব দেখে বামপন্থীরা বলতেই পারেন এ হল দিদি-মোদীর সেটিং। সামনের টেবিলে “চা-বিস্কুট” সাজিয়ে রেখে গোপন রাজনৈতিক ভাব-ভালোবাসার আদান প্রদান।
কিন্তু রাইজ অফ ভয়েসেস বাম-ডানের কচকচানিতে ঢুকবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে চায়, চিটফান্ড কান্ডে জড়িত কিম্বা খামে ভরে, তোয়ালে মুড়ে টাকা খাওয়া সাংসদ-বিধায়করা যে সাংসদীয় ব্যবস্থায় কলার তুলে আইনসভা চত্বরে ঘুরে বেড়ায়, কার্যত বিভিন্ন সরকারী তদন্তকারী সংস্থার সাথে কুমীরডাঙ্গা খেলে বেড়ায়, অথচ সংসদের এথিক্স কমিটি একবারও তাদেরকে মিটিং করে শুনানির জন্য ডেকে পাঠাবার সময় পায় না, অথবা যে দেশের কোন এক রাজ্য বিধানসভার স্পিকার সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষী করে সর্বসমক্ষে দলবদলানো-রংবদলানো একগুচ্ছ বিধায়কের দলবদল স্বীকার করেন না, সেই দেশে সংসদের অভ্যন্তরে মিথ্যা-অসত্য-দুর্নীতিগ্রস্ত-চামচা- কুম্ভীরাশ্রু ইত্যাদি শব্দগুচ্ছকে অসংসদীয় আখ্যা দেওয়াটাই এক ধরণের স্বৈরাচার! শাসকের অঙ্গুলিহেলনে বানানো এই বিধি-নিষেধ আদতে এক লজ্জাজনক নাটুকে ভণ্ডামি! আর তাই দেশের সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সাথে করা জুমলেবাজ শাসকের এমন গদ্দারিকে রাইজ অফ ভয়েসেসের তরফে ধিক্কার!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.livemint.com/news/india/taanashah-jumlajeevi-among-words-now-banned-in-parliament-11657774331261.html
b) https://www.news18.com/news/explainers/news18-explains-what-happens-when-an-mp-uses-unparliamentary-words-whats-history-behind-the-rule-5552257.html