শ্রমকোড : রবীন্দ্রনাথ সব জানেন / Secrets of New Labour Code

“দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি,
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-‘পরে
ওরা কাজ করে।”

বাঙালীর “রবিরোগ” আজকের নতুন নয়। গত বছর বিধানসভা ভোটের সময় বাংলায় ভোট প্রচারে এসে, দেশের অবাঙ্গালী, বাংলাভাষী নন, এমন রাজনৈতিক নেতারাও যে রেটে রবি ঠাকুরের কবিতা আওড়াচ্ছিলেন তা দেখে আমাদের মত কম লেখাপড়া জানা অল্পশিক্ষিত অনেক বাঙালীই রীতিমত হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেছিল। আজকালকার ছেলে ছোকরাদের কেউ কেউ অবশ্য এই অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমরা প্রথমটায় পাত্তা দিইনি। দেদার হাততালি দিয়েছি। ভোট দিয়েছি। আর তাতেই বিপত্তি।

রবি আওড়ানো ফকিরবাবা এবং তাঁর চ্যালা-চামুন্ডারা রবি ঠাকুরের সেই “ওরা কাজ করে” র “ওরা” কেই আজ সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। একে তো সব হাতে কাজ নেই। তাই পেটের ভাত নিয়েই দেখা দিয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা। সে এক দিন ছিল যখন দেশের আকাশে বাতাসে কান পাতলেই বছরে দু-কোটি কর্মসংস্থানের আশ্বাস পাওয়া যেত, শেষে গতকাল জানলাম আপাতত দেড় বছরে দশলাখ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, তাও সেটাও আবার ভবিষ্যতের গর্ভে, মানে হবেই এমনটা না আঁচানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। আর বিগত আট বছর ধরে প্রতি বছর দুকোটি কর্মসংস্থানের হিসেবে ১৬ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছে কিনা, প্রশ্ন করতেই মসজিদের উঠোনে বারান্দায় মাটি খুঁড়ে শিবলিঙ্গ উঠতে শুরু করেছে। তার ওপর ধর্মীয় উস্কানি তো আছেই, যার জন্যে সংখ্যালঘু সমাজের কয়েকজন মিছিলের নামে অরাজকতা তৈরি করছে, আর তার দেখাদেখি কিছু সংখ্যাগুরু নেমে পড়েছে সাম্প্রদায়িকতা চাষ করবার প্রতিযোগিতায়। চোখের বদলে চোখ করতে গিয়ে গোটা ভারতীয় সমাজ আজ অন্ধত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আর এসব ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় চর্চার মাঝেই শাসক ফিসফিস করে হঠাৎ যেটা বলতে চাইছে সেটা হল ওরা কাজ করে তো বুঝলাম, কিন্তু আদৌ প্রতিদিন যতটা করলে আমাদের দেশ “বিশ্বগুরু” মানে ৫ ট্রিলিয়ন – ১০ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির মালিক হতে পারে ততটা করে কি! উঁহু! দেশনেতারা ঠিক কনভিন্স হতে পারছেন না। মানে দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করাকে তাঁরা আর যথেষ্ঠ বলে ভাবছেন না। আর কেনই বা ভাববেন? তাঁরা নিজেরা দেশ-বিদেশ গেলে রাতের বেলা যান, যাতে যাতায়াতে দিনের বেলা কাজের সময় নষ্ট না হয়। এমনকি সেই যাত্রাপথেও দেখবেন বলে সঙ্গে করে পাহাড় প্রমাণ বিভিন্ন সরকারী ফাইল কাগজপত্র নিয়ে যান। মানে যাকে বলে কর্মযোগী টাইপ! কাজেই নো ফাঁকিবাজি! জওয়ান যদি দিনরাত বর্ডার পাহারা দিতে পারে, তাহলে তুমি কোথাকার কে হে, যে আটঘন্টা খুটুর খুটুর করে পয়সা কামাবে!

কাজেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আসতে চলেছে নতুন শ্রম কোড। যেখানে বলা হচ্ছে দৈনিক বারোঘন্টা কাজ করা জরুরি। যতদূর জানা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার জুলাই ১, ২০২২ থেকে এই নতুন শ্রমকোড কার্যকর করার পথে হাঁটতে চলেছে। যার ফলে কোম্পানিগুলি তাদের অফিসে কাজের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করার সুযোগ পাবে। ইচ্ছে হলে, তারা কাজের সময় ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘন্টা করতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কর্মীকে দিতে হবে সপ্তাহে ৩ দিন ছুটি। আন্দোলনবিমুখ ছুটিপ্রিয় দেশবাসী নিশ্চিত ভাবেই অতিরিক্ত ছুটির পক্ষে সাড়া দেবেন, এটা শাসকেরা জানেন, আর তাই একদিনের অতিরিক্ত ছুটির বিনিময়ে সাপ্তাহিক ৪০ ঘন্টা (৮ ঘন্টা x ৫ দিন) কাজের সময়কে সাপ্তাহিক ৪৮ ঘন্টা (১২ ঘন্টা x ৪ দিন) করতে চাইছেন। মানে এখনকার নিয়মানুযায়ী, নতুন শ্রমকোড চালু হলে আপনার হাতে যেমন একদিন এক্সট্রা ছুটি আসছে, আবার উল্টোদিকে দেশ আপনার থেকে অতিরিক্ত একদিনের শ্রমও পাচ্ছে। একে আপনি মাস্টারস্ট্রোক কেন বলবেন না! একদম যাকে বলে আমাদের “দু হাতে লাড্ডু” কেস।

এরপর যারা অতিরিক্ত আয়ের জন্য ওভারটাইম খাটতে চান, তাদের জন্যও সুখবর আছে এই প্রস্তাবিত শ্রমকোডে। বর্তমান ফ্যাক্টরি আইনের অধীনে শ্রমিকদের ওভার টাইম বৈধ ছিল প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫০ ঘন্টা। নতুন প্রস্তাবিত শ্রমকোড চালু হলে, তা বেড়ে হবে ১২৫ ঘন্টা। মানে আপনি চাইলে এখনকার থেকে মাসিক অতিরিক্ত ৭৫ ঘন্টা শ্রমদান করে ডবলেরও বেশি ওভারটাইম রোজগার করতে পারবেন। আর হাতে টাইম থাকলে গেঁজিয়ে আড্ডা মেরে সময় নষ্ট না করে সেটা যদি দেশের কাজে লাগান এবং পাশাপাশি দু-পয়সা উপরি ঘরেও আসে তাহলে মন্দ কি !

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হাতের সব লাড্ডু গুলো খেয়ে ফেলবেন না। শ্রমকোডের গল্পটা আরেকটু বাকি আছে। একটু বিশদে খুঁটিয়ে পড়তে হবে। তবেই জুমলাটা বুঝবেন। না হলে সে আপনি হিন্দু হোন কিম্বা মুসলিম খতরে মে পড়ে যাবেন। তাই পয়েন্ট করে করে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি!

  • এক মাস মানে ৭২০ ঘন্টা। এখনকার নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মচারী ওভার টাইম মিলিয়ে মাসে সর্বোচ্চ ২২৬ ঘন্টা কাজ করতে পারতেন। যার মধ্যে ১৭৬ ঘন্টা বাধ্যতামূলক এবং ৫০ ঘন্টা ঐচ্ছিক। নতুন নিয়মে তিনি মাসিক সর্বোচ্চ ৩৪১ ঘন্টা কাজ করতে পারবেন যার মধ্যে ২১৬ ঘন্টা বাধ্যতামূলক এবং ১২৫ ঘন্টা ঐচ্ছিক। কিন্তু এই যে আপনার নতুন শ্রমকোডে বাধ্যতামূলক কাজের সময় মাসিক ২২% বেড়ে গেল, তাতে আপনার মাইনে বাড়ছে কি! সোজা কথায় না। কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, নতুন শ্রম কোড কার্যকর হলে অফিসের টাইম, কর্মচারী ভবিষ্য তহবিলে (EPF) অবদান বাড়লেও, কমবে বেতন। অবসরগ্রহণের পর কর্মচারীদের প্রাপ্ত অর্থ এবং গ্রাচুইটির পরিমাণ বাড়বে। মানে আপনার কোম্পানীর মালিকের বেনিফিট বাড়ছে আজকে। কারণ তিনি আপনার থেকে অতিরিক্ত ২২% কাজ আদায় করছেন আজকে। কিন্তু আপনি লাভবান হবেন অবসর গ্রহনের পর। আপনি রাজি তো!
  • তাছাড়া আমরা সবাই জানি ওভারটাইমের দৈনিক বেতন বা মজুরির হার সাধারণ দৈনিক বেতন বা মজুরির টিপিক্যালি দেড় থেকে দুগুণ হয়ে থাকে। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন এখনকার নিয়মানুযায়ী একজন চাকুরীজীবী / শ্রমজীবীর ওভার টাইমের ৫০ ঘন্টার প্রায় ৪০ ঘন্টা নতুন নিয়মে ঢুকে যাচ্ছে বাধ্যতামূলক কর্মসময়ের মধ্যে। ফলে ঐ চল্লিশ ঘন্টার জন্য কর্মচারীটি বর্ধিত হারে বেতন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। এতে কার লাভ! কর্মচারীর নাকি মালিকের! তাছাড়া সপ্তাহে চারদিন দৈনিক বারোঘন্টা কাজ করবার পর ওভারটাইম কাজ করবার মত সময় এবং শারীরিক সক্ষমতা আদৌ অবশিষ্ট থাকবে কি! অতিরিক্ত ওভারটাইমের গাজর ঝুলিয়ে এখনকার নিয়ম মাফিক ওভারটাইমের বর্ধিত হারে বেতন পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না তো! ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন। ভাবতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।
  • সপ্তাহের যে চারদিন আপনি ১২ ঘন্টা অফিসে ডিউটি করবেন, সেই চারদিন অফিস যেতে আসতেও তো কমপক্ষে ঘণ্টা দুয়েক খরচা হবে। তারপর ৬ ঘন্টা ঘুম আছে। বাকি ৪ ঘন্টায় বাথরুমের প্রাত্যহিক কাজ, বাজার-দোকান, খাওয়া-দাওয়া, বাপ-মা, বউ-বাচ্চাকে সময় দেওয়া ইত্যাদি সব কিছু করা যাবে তো! সন্তানের লেখাপড়া দেখিয়ে দেওয়া, স্কুলে দিয়ে আসা বা স্কুল থেকে নিয়ে আসা, এসবের জন্য সময় থাকবে তো! যারা মধ্যবয়স্ক বা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন, কিম্বা বাড়ির কর্মরত মহিলারা পারবেন এই সময়সীমা মেনে সপ্তাহে চারদিন ১২ ঘন্টা করে ডিউটি করতে! চলবে সংসার ! বহু মানুষ আছেন যারা সংসারের জোয়াল টানতে চাকরির পাশাপাশি কিছু সাইড কাজকর্ম/ব্যবসাপাতি করেন। নতুন শ্রমকোড আইনে বেতন কমে যাওয়ায় তারা আরও বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন সাইড ইনকামের ওপর। তাঁরা পারবেন তো সপ্তাহে ৪দিন এভাবে ১২ ঘন্টা ডিউটি করবার পর সাইড ইনকামের কাজকর্মে সময় দিতে!
  • নতুন শ্রমকোড আইন অনুযায়ী, সপ্তাহে তিনদিন ছুটি পাওয়ার পরও, বাৎসরিক ১২ টা পাবলিক হলিডে পাওয়া যাবে তো! যদি সাপ্তাহিক ছুটির দিন পাবলিক হলিডে পড়ে যায় তাহলে কি সেই বাৎসরিক ১২ টা ছুটিতে কোপ পড়বে? নতুন আইনে এব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। আপনাদের কারোর জানা থাকলে জানান।
  • আর সবশেষে সব থেকে বড় প্রশ্ন। সপ্তাহে চারদিন দৈনিক ১২ ঘন্টা করে কাজ করলে একজন কর্মচারীর শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে তো! তিনি কি পারবেন তার কর্মজীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুস্থ্য শরীরে কাজ করতে! কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই বলছে এ ব্যাপারে তাদের কোন মতামত নেই, সেটা ডাক্তারবাবুরা ভালো বলতে পারবেন। সরকারের বক্তব্য শুধু একটাই। নতুন শ্রম আইন দেশে বিনিয়োগ বাড়াবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে। এখন আপনি যদি এই অমানুষিক ১২ ঘন্টার খাটাখাটনিতে বয়সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কোম্পানী বা কর্তৃপক্ষ আপানাকে ১২ ঘন্টা কাজ করবার জন্য “আনফিট” প্রমাণ করে দিয়ে ছাঁটাই করে দেবে না তো! কারণ কর্তৃপক্ষের কাছে আপনার মত অভিজ্ঞকে বেশি মাইনে দিয়ে না পুষে, তার জায়গায় কম অভিজ্ঞ অথচ বারো ঘন্টা খাটতে পারবে এমন একজোড়া হাতকে কম বেতন দিয়ে রাখতে পারলেই তার বেশি লাভ! আর আপনি আমি মাঝবয়সে চাকরির খোঁজে গলগ্রহ হয়ে ঘুরে বেড়াব রাস্তায় রাস্তায়! এমনটা যে হবে না আমরা কি নিশ্চিত। বিবেচনা করে দেখুন আমরা ঠিক বলছি কি না!

এছাড়াও নতুন শ্রমকোড নিয়ে এমনই সব অজস্র প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বা আইএলও তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন বামপন্থী কর্মী সংগঠনের তরফে প্রতিবাদ -বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে, কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে তা মানুষের সামনে আনা হচ্ছে না। এ পোড়া দেশে সংবাদমাধ্যম আদৌ আছে কি না ইদানীং বোঝা যায় না। তারা সারাদিন শাসকের পজিটিভিটি আর মাস্টারস্ট্রোকের অপেক্ষায়। আর সেসব না থাকলে মন্দির-মসজিদ আছে, হিজাব আছে, শিবলিঙ্গ আছে, চাণক্যনীতি মেনে বিধায়ক-সাংসদদের দলবদল থেকে শুরু করে তাদের প্রণয়-পরকীয়া-বিচ্ছেদ আছে; খবরের শেষ নেই। শুধু আপনার আমার কাজে লাগবে এমন কোন খবর আপনি সচরাচর দেখতে পাবেন না। “ওরা কাজ করে” গুরুত্ব হারিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে, “তা তা থৈ থৈ”। অবশ্য ম-ম চিত্তে, “তা তা থৈ থৈ” চলুক, তাতে কোন অসুবিধে নেই, কিন্তু আমরা চাই, পাশাপাশি “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির”টাও থাক।

সরকার বাহাদুর জানুক, শ্রমকোডের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ঝুলির বেড়ালটা বেরিয়ে পড়েছে। মানুষ তার গলায় ঘন্টা পরাতেও তৈরি!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস