রক্তস্নাত ত্রিপুরা / Bloodbath in Tripura

“কেউ আছনি, আমার কাকুরে কাইট্যা ফেলাইছে….”

ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর ত্রিপুরার মানুষের অসহায়, আর্ত চিৎকারের এটাই প্রতিধ্বনি!

তাদের অপরাধ, তারা সিপিআইএম দলকে সমর্থন করে। শুধু এক জায়গায় নয়, ত্রিপুরার দিকে দিকে আজ এক ছবি। গণহারে মার খাচ্ছেন সিপিআইএম কর্মীরা। রাজ্যজুড়ে শাসক দল বিজেপি’র লাগামহীন সন্ত্রাস। বামুটিয়া, খোয়াই, শান্তির বাজার থেকে মেলাঘরের দিকে দিকে রক্তস্নাত হচ্ছে ত্রিপুরার সিপিআইএম কর্মী থেকে সমর্থকেরা।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, ভোটের ফলাফলের পর সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, “ভোট ভাগাভাগি না হলে ফলাফল অন্যরকম হত।” একজন সিজনড পলিটিশিয়ানের কাছ থেকে এমন বালখিল্য উক্তি আশা করা যায় না। বহুদলীয় গনতন্ত্রে ভোট ভাগাভাগি তো অন্যতম শর্ত, তাই গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা এখানে সবচেয়ে বেশি, সেটা যদি মানিকবাবু এখনো না বোঝেন, তাহলে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত লম্ফঝম্ফ করেই কাটিয়ে দিতে হবে। কারণ আপনারা যাদের সাথে জোট করেছিলেন, তারা কংগ্রেস থেকে তৃণমূল, তারপর বিজেপি, তারপর পুনরায় কংগ্রেস হয়েছেন। আর সেটা ত্রিপুরার মানুষজন ভাল করে জানেন, বোঝেন। তার পরেও ৩৬% মানুষ আপনাদের ওপর বিশ্বাস করেছিল। তারাই আজ মার খাচ্ছেন শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীদের হাতে। আপনারা কোথায়? আপনাদের শীর্ষ নেতৃত্ব কোথায়? নানা রাজ্যের থেকে নির্বাচনের প্রাক্কালে উড়ে আসা আপনাদের কেন্দ্রীয় কমিটি/পলিটব্যুরোর নেতারা, স্টার ক্যাম্পেনাররা কোথায়? খোঁজ নিন। দিল্লীর সিপিআইএম সদর দফতরে রোজ তালা খোলা আর তালা বন্ধ করাই কি এখন তাদের প্রধান কাজ? কমরেড শব্দের মানে কি তারা আজ ভুলেছেন? আহত সাথীর চিৎকার এখনও যদি তাদের স্পর্শ না করে, তাহলে তারা কিসের নেতা, কিসের মানুষ, কিসের কমরেড? ধরে নিয়ে আসুন! ঘুরিয়ে দেখান রক্তস্নাত ত্রিপুরার ছবি!

তাঁরা পারতেন না দিল্লির জন্তর মন্তর অথবা নির্বাচন কমিশনের সামনে ত্রিপুরার মানুষের জন্যে ধর্নায় বসতে? ডাকতে পারতেন না দেশের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক মঞ্চে? পারতেন না কনাট প্লেস থেকে করোল বাগ পর্যন্ত মোড়ে মোড়ে ত্রিপুরায় চলতে থাকা বিজেপি’র সন্ত্রাসের ছবি সেঁটে দিতে? দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের ডেকে জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখাতে পারতেন না ত্রিপুরার অসহায় রক্তস্নাত মুখগূলোকে? কেন্দ্রীয় বাহিনী ত্রিপুরাতে থাকতে এই অবস্থা হলে, কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকলে কি হবে বুঝতে পারছেন? দেশজুড়ে বিবিসির ডকুমেন্টারি দেখাতে আপনারা যতটা উৎসাহী হয়েছিলেন, ত্রিপুরার মার খাওয়া মানুষগুলোর আর্তনাদ, হাহাকারকে মানুষের কাছে ছাড়িয়ে দিতে উৎসাহী নন কেন? নাকি ছয়মাস ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, তারপরে আপনারা এদের কথা বলবেন? প্রশ্ন রইল। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা থাকলে, যারা তড়িঘড়ি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাদের এগিয়ে দেওয়া উচিৎ নয় কি?

আর পশ্চিমবঙ্গ, তাদের কথা বাদই দিন। তারা এখন প্রবল ব্যস্ত একটি বই ও তার পিডিএফ ফাইল নিয়ে। কিন্তু দু দিন আগে এরাই “অধীর” আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, ত্রিপুরার ফলের দিকে। আশা করেছিলেন, ফলাফল পজিটিভ হলে, তার ফায়দা যেন বঙ্গে তোলা যায়। কিন্তু তা হয়নি, তাই তারা তাদের ত্রিপুরার কমরেডদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ভুলে, আজ একটি বইয়ের পিছনে ধাবমান। এদের একটুও সাহসে কুলায়নি রাজ্যের বিজেপি’র অফিসের সামনে ত্রিপুরার অসহায় মানুষগুলোর হয়ে প্রতিবাদ জানানোর। হয়তো ইউটিউবের সিলভার বাটনের আনবক্সিং তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আর কংগ্রেস! তারা ভোট মেটার পর নিজেদের ঘরে ছিটকানি আটকে ভালই আছে। এই তো দেশজোড়া হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে বিস্তর খাটাখাটনি গেল! এখন তো বিশ্রামের সময়! ত্রিপুরা একটা ছোট্ট রাজ্য। তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়! তারচেয়ে বরং পেগসাস নিয়ে কেমব্রিজে ভাষণ দিয়ে আসা বেশি জরুরি! বিশ্রাম বেড়ানো এবং প্রচার সবই হবে!

আর সবশেষে মথা…. যাঁরা এক মাস আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে ‘লড়কে লেঙ্গে ত্রিপ্রাল্যান্ড’ মনোভাব নিয়ে লড়েছে, ফলাফল বের হতেই তাদের প্রিয় ‘বুবাগ্রা’ আপাতত সেই বিজেপির সাথেই গা-ঘষাঘষি করতে ব্যস্ত। বিজেপির রাজ্য মন্ত্রীসভায় তাদের কেউ যোগ দিলেও আমরা অবাক হব না।

আসলে ত্রিপুরা তো দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে পড়ে থাকা এক চিলতে ছোট্ট একটা রাজ্য। তার খবর দেশের কজনই বা রাখে! তাই সেই রাজ্যের আক্রান্ত মানুষের পাশে থাকবার জন্য এই প্রতিবেদন। এখানে বামপন্থীরা উপলক্ষ মাত্র! কংগ্রেস ও মথা কিছু করবে না জানা কথা। কিন্তু বামপন্থীদের এত নিষ্ক্রিয়তা চোখে লাগে!

আমাদের মনে হয়েছে বামেরা, মানে তাদের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব ত্রিপুরার আক্রান্ত মানুষের পাশে থাকবার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন না। তাদের বঙ্গীয় বামপন্থী সাথীরা যারা কয়েকদিন আগেও ত্রিপুরা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতেন তারাও বিস্ময়করভাবে এই ইস্যুতে নীরব! কিছু খুচরো ট্যুইট আর ফেসবুক পোষ্ট করে হাত ধুয়ে ফেলছেন। আর আপাতত ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর মায়া কাটিয়ে দীপক ঘোষের বইয়ের পিডিএফ ফাইল নিয়ে লাফালাফি করছেন; চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া স্টান্টবাজ উঠতি দক্ষিণপন্থী নেতার হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। এনাদেরকে বুঝতে হবে, কমরেড মানে যতটা সহযোদ্ধাকে বোঝায়, ততটা সহযোগীকে বোঝায় না! কাজেই এই মুহুর্তে বামফ্রন্টের বাইরে থাকা সহযোগী দল ও তাদের নেতাদের নিয়ে নাচানাচি বন্ধ করে লাল ঝান্ডা হাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলা দেশ ও রাজ্যের সহযোদ্ধাদের রক্ষা করাটা বেশি জরুরি।

তা নাহলে কামান দাগার জন্য সদর দপ্তরটাও একদিন থাকবে না।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস