চায়ের সাথে ডিএ / The DA Files

গতকাল এক বন্ধ চটকলের সামনের গাছতলায় চা খাচ্ছিলাম। দোকানে বসা খরিদ্দাররা কথা সে কথা বলতে বলতে চায়ের ভাড়ে তুফান তুলছিলেন, সে নানান বিষয়। ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট থেকে ঘুরতে ঘুরতে আল্টিমেটলি প্রসঙ্গ এসে দাঁড়াল রাজনীতিতে, তারপর সাম্প্রতিক ত্রিপুরা, মেঘালয়, সাগরদিঘীর উপনির্বাচন ঘুরে ডিরেক্ট দুর্নীতি। বর্তমান থেকে অতীত শাটল ককের মতন এপাশ ওপাশ করতে করতে প্রসঙ্গ উঠল চায়ের দোকানের সামনের বন্ধ কারখানার। সেখানে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “গোটা রাজ্যের কারখানা বন্ধ হয়েছে শ্রমিকদের জন্যে”।

চুপ থাকতে পারলাম না, বলে উঠলাম, “এটা ঠিক বলছেন না দাদা”।

একজন অচেনা লোকের মুখে এই বক্তব্য শুনে ভদ্রলোক একটু ক্ষেপে গিয়েই বললেন, “তাহলে ঠিকটা কি, বলে ফেলুন?”

পাল্টা জবাব দিলাম, “এই পৃথিবীতে একটা কারখানাও শ্রমিকের জন্যে বন্ধ হয়নি, এটা আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, যদি আপনারা সময় দেন।” সম্মতি পেলাম।

বললাম,”বেশ কয়দিন ধরে রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা তাদের প্রাপ্য ডিএ’র দাবিতে আন্দোলন করছেন..”।

কথা শেষ না হতেই পাল্টা এলো, “এখান এত সাবজেক্ট থাকতে ডিএ আসছে কোথা থেকে?”

“সম্পর্ক আছে, সেটাই বলেছি। ধরে নিন, রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা এক্ষেত্রে শ্রমিক, তাহলে অটোমেটিকালি মালিক হচ্ছে রাজ্য সরকার। আজ কর্মচারীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছেন, কেবলমাত্র তাদের প্রাপ্য ডিএ’র দাবিতে, যেটা দিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু বছরের পর বছর সরকার তা দিচ্ছে না। ডিএ চাইতে গিয়ে তারা দিনের পর অপমানিত হয়েছেন, এমন কি কুকুরের সাথেও তাদের তুলনা করেছে তাদের মালিক। তাদের মালিকের ম্যানেজার আবার বলেছেন, না পোষালে চলে যান। এমনটা কি কাঙ্খিত ছিল? ছিল না, বহুদিন ধরে অপেক্ষা করতে করতে এদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে, তাই এরা রাস্তায়।” এতটা বলার পর আমায় আর থামতে হয়নি। বাকিটা স্মূথলি শেষ করেছিলাম।

“সরকারি অফিসের এই হতভাগা শ্রমিকরা প্রথমে প্রতীকী দু-ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করেছিলেন, তাতে কাজ হয়নি। বরং কিছু জায়গায় শাসক দলের বা কারখানার দিক থেকে দেখলে ম্যানেজার বা সুপারভাইজারের শাসানিও খেতে হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে শ্রমিকদের (পড়ুন কর্মচারীদের) বিক্ষিপ্ত ক্ষোভগুলো এক জোট হতে লাগল। যার জেরেই হল একদিনের কর্মবিরতি। ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে, রাজ্য বাজেটে হঠাৎ করেই চিরকূট কাণ্ডের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩% ডিএ ঘোষণা হল। তা একেবারেই যথেষ্ট না হলেও, সবাই মিলে একসাথে পেন ডাউন করলে যে কিছু ফল পাওয়া যায়, তা আবারও প্রমাণিত হল।”

একটা পুরোনো কথা আছে,”Capital has zero value without the power of labours.” বাংলায় তর্জমা করলে যার মানে দাঁড়ায়, “শ্রমিকের শ্রম ছাড়া অথবা শ্রমিকের শক্তি ছাড়া সম্পদের কোনো মুল্য নেই।

“সরকার হোক বা কারখানা, শ্রমিক-কর্মচারী ছাড়া তাদের কোনো মুল্য নেই। আজ ভাবুন তো, যদি একটা সপ্তাহ সারা রাজ্যের সব কর্মচারী, পুলিশ, আমলা ইত্যাদি সবাই কাজ বন্ধ করে দেয়, তাহলে কি হবে? এর চেয়ে এটা ভালো নয় কি, এদের ন্যায্য দাবি মিটিয়ে দেওয়া? দাবি না মিটলে যদি লাগাতার কর্মবিরতি চলে, তাহলে তো একদিন নেতা-মন্ত্রীদের পাশে ডিএ না পাওয়া পাহারাদাররা নাও থাকতে পারে। সেদিন? সেই ইঙ্গিত পেয়েই কি আনস্টেবল সিভিক ভলেন্টিয়ার্সদের কনস্টেবল পদে নিয়োগ করার বিষয় খতিয়ে দেখার নির্দেশ?”

“সরকারি কর্মচারী কাজ করবে, পাওনা গন্ডা পাবে না, আর মন্ত্রী সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় হেলিকপ্টার চড়ে ঘুরবে, অযাচিত খরচ করবে, এটা যেমন মানা যায় না। তেমনই শ্রমিকরা কাজ করবে, আর মাসের পর মাস প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাবে না, এটা কয়েক মাস শ্রমিকরা মানলে, লং টার্মে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব না। তাই কারখানায় ঝাঁপ পড়ে। শ্রমিকদের কারণে তাই কারখানা বন্ধ হয় না, বন্ধ হয় মালিকের গাফিলতিতে।”

“কথাটা খারাপ বলেননি, কিন্তু শুধু আমি না, অনেকেই বিশ্বাস করে শ্রমিকদের জন্যেই কারখানাগুলো বন্ধ হয়, এতে কি সত্যিই কোন সত্যতা নেই?” পাল্টা প্রশ্ন এল।

মুচকি হেসে উত্তর দিলাম,”মালিক হোক কি সরকার, এদের অনেক টাকা। আর প্রচারযন্ত্র, এগুলো তো কেনা যায়। আর তাদের উদ্দেশ্য মোটামুটি ভাবে একটাই, মানুষকে এটা রোজদিন বোঝানো, অধিকার আসলে উপহার হিসেবেই আসবে, কিন্তু অধিকার তো সে ভাবে আসে না। সেটা… “

চায়ের দোকানী বলে উঠলেন, “অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়।”

আর কি! আমি মুচকি হেসে বাড়ির পথ ধরলাম।