চা-বিস্কুট / Wah Ji Wah

চা-বিস্কুট আমরা প্রায় প্রত্যেক বাঙালীই খেয়ে থাকি। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা আর খবরের কাগজ ছাড়া আমার মত অনেকের তো দিনই শুরু হয় না। কিন্তু চায়ে চুমুক দেওয়ার মুহুর্তে, যেমন কাপ আর ঠোঁটের দূরত্ব ঘুচে যায়, ঠিক তেমনই সমতলের ট্যুইট যুদ্ধ, রাজনৈতিক কুস্তি পাহাড়ে উঠে মাঝখানে চায়ের কাপ রেখে যে এভাবে দোস্তিতে পরিণত হতে পারে জানা ছিল না। জানলাম।

এতদিনকার বন্ধুর বৈরিতা যাকে রাজ্যের প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম “স্নায়ুযুদ্ধ” বলে অভিহিত করে আসছিল, তা হঠাৎই বন্ধুত্বে পরিণত হওয়ায় এখন আবার আগামী কয়েকদিন রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প বলে চালিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা হবে। ইতিমধ্যেই বিরোধীরা মানে বাম-কংগ্রেস “ইডি-সিবিআই”কে নিষ্ক্রীয় রাখবার শর্তে পদ্মপাল আর মাননীয়ার মধ্যে অতীতের বন্ধুরতা পেরিয়ে বন্ধুত্ব হয়েছে বলে কাল সন্ধ্যে থেকে চিৎকার চেঁচামেচি জোড়ায়, তাদের সেই অস্ত্র ভোঁতা করে দিতে আজ সকাল থেকেই ইডি অফিসারেরা হানা দিয়েছেন আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা রাজ্যের দুই মন্ত্রীর বাড়িতে। এমন মেকি হানা-তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ বিগত পাঁচ-ছ’বছরে আমরা কম দেখিনি। গ্রেপ্তারিও দেখেছি। তারপর দেখেছি উডবার্ন ওয়ার্ড। আর সেখান থেকে সোজা গাড়ি করে বাড়ি। যদি বা গ্রেপ্তারও হয়েছেন কেউ, তারপর জেলের মধ্যে কি রকম প্রথমশ্রেণীর বন্দী হিসেবে ভিআইপি ট্রিটমেন্টে তিনি রয়েছেন তার সবিস্তার বিবরণ যেভাবে সামনে আসতে থাকে মনে হবে, এ যেন কোন মহাজীবনের রোজনামচা পড়ছি। সকালে কখন উঠলেন, কি খেলেন, কোন কাগজ পড়লেন, কখন স্নান সেরে কি কি পদ দিয়ে দুপুরের আহার করলেন, তারপর কতক্ষণ দিবানিদ্রা দিলেন, বিকেলে পায়চারী করলেন কি না, রাতেই বা ডিনার কি দিয়ে করলেন, রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে কি না ইত্যাদির বিশদ ফিরিস্তি চলতে থাকে, যদ্দিন না তিনি জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন। আর ছাড়া পেলেই আবার যে কে সেই ! যাদের বিরুদ্ধে একসময় কোটি কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ ছিল তারা এখন হয় তৃণমূল না হয় বিজেপির নেতা-মন্ত্রী, সাংসদ-বিধায়ক অথবা সাংগঠনিকভাবে দলের উচ্চপদে আসীন। একজন তো আবার আবার শাসকদলের মুখপাত্র। কাজেই আজ দুই মন্ত্রীর কাউকে ইডি গ্রেপ্তার করলেও যে ন্যয় বিচার হতে চলেছে আমরা নিশ্চিত হতে পারব না।

যাইহোক চা-বিস্কুটে ফিরি। গতকাল একটি প্রথমসারির টিভি চ্যানেল আয়োজিত সান্ধ্যকালীন কলতলার ঝগড়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের দুজন মুখপাত্র উপস্থিত ছিলেন। একজন বললেন রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন দুটির প্রেক্ষাপট আলাদা। আমাদের নাকি মনে রাখতে হবে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত “উপ” আছে। অন্যজন বললেন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসকে যথাযথ সম্মান জানানো হয়নি। তাই উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত থেকে একদা “পদ্মপাল”কে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সুবিধে পাইয়ে দেওয়া।

যদিও বিভিন্ন সংবাদসংস্থা সূত্রে যা খবর তা হল স্বয়ং ইউপিএ চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী এবং শারদ পাওয়ার মাননীয়াকে ফোন করেছিলেন এবং প্রত্যুত্তরে মাননীয়া নাকি বিরোধী জোটের প্রার্থীকে নিঃশর্ত সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও যে পাহাড়ে উঠে তৎকালীন বড়লাট তথা আজকের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে চা-বিস্কুট খাওয়া হয়নি। সেখানে আবার কোন অজ্ঞাতকারণে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত বিজেপি শাসিত আসামের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধেও চিটফান্ড দুর্নীতির ভুরিভুরি অভিযোগ। কিন্তু শেষ কবে তাঁকে সিবিআই বা ইডি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তিনি নিজেও মনে করতে পারবেন না। আর সেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই মাননীয়ার দলের এহেন ভোল বদল! শেষমেশ উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত থাকবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা!

কিন্তু সামনে যে ছেঁদো যুক্তিটা রাখা হচ্ছে সেটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য! তৃণমূল কংগ্রেস যদি সত্যিই বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক শক্তি বলে মনে করে, যদি মনে করে দেশের বিপদ, তাহলে সেক্ষেত্রে দেশের বিপদের আগে এভাবে দলের মানসম্মান কে এগিয়ে দিয়ে নেতৃত্ব কি প্রমাণ করতে চাইলেন! দেশ নয়, আগে দল! দলীয় স্বার্থ দেশের থেকে অনেক উপরে!

জবাব পাব কি?

বাংলার মানুষ কিন্তু প্রতিদিন সকালবেলা উঠে চা-বিস্কুট খেতে খেতে খবরের কাগজের পাতায় সেই উত্তরই খুঁজবেন। আর সদুত্তর না পেলে কোন “উপ” নয়, কোন কোন উপঢৌকনের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, সাংবিধানিক সঙ্কটের প্রশ্নে এমন আপোস, রাজনৈতিক পশ্চাদসরন মানুষের মনে তার লম্বা তালিকাও তৈরি হতে থাকবে।

সে তালিকায় যে শুধু চা-বিস্কুট থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।
মুকুল-মদন- ববি-কুনাল- টুম্পাই-কানন ইত্যাদি থেকে শুরু করে পার্থ-পরেশ-ব্রাত্য, এমনকি ভাইপো-ভাইপো বউ, অনেক কেউই থাকতে পারে।

ধন্যবাদান্তে
সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়