জেলের ভাত / Tonic Vs. Panic
তিনি এলেন। বললেন। কিন্তু জমলো না।
ভাইপোকে ডেয়ারডেভিল তকমা দিয়ে শুরুটা স্টাইলে করলেও, ব্যাপারটা যে জমছে না, কোথাও যে একটা ছানা কেটে যাচ্ছে নিজেই বুঝতে পারলেন।
আর তারপরই যা তিনি আজ পর্যন্ত কোনদিন করেননি, সেটাই করে বসলেন বা বলা যায় করতে বাধ্য হলেন। সভার সেই লড়াকু মেজাজটা ধরে রাখতে আঁকড়ে ধরলেন কেষ্টকে।
এখানে বলা প্রয়োজন, অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্ট হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি গরু পাচারকান্ডে জেলে ঢুকে যাওয়ার পরও দলনেত্রীর সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন, যা পার্থ চ্যাটার্জ্জীর মত দলের ‘প্রাক্তন’ মহাসচিব তথা এক সময়কার মন্ত্রীসভার ‘নাম্বার টু’ পর্যন্ত পাননি। দলের মধ্যেকার ভাইপো শিবিরও মুখে কুলুপ এঁটে তা হজম করেছে। ফলে কেষ্টর দর যে আপাতত তৃণমূল দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণে অনেক তথাকথিত নামি-দামি হেভিওয়েট নেতাকে টপকে, পিসি-ভাইপোর ঠিক পরেই, তা আজ দিনের আলোর মত পরিষ্কার। আর সভাতেও প্রাণ ফেরাতে সেই কেষ্টনামই জপলেন স্বয়ং মমতা! জেলা নেতাদের বললেন কেষ্টকে “বীরের সম্মান” দিয়ে জেল থেকে ফেরত আনতে। মানে উনি আশা করছেন কেষ্ট নির্দোষ এবং জেল থেকে ছাড়া পাবেন! কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী হয়েও কিভাবে একজন জেলবন্দী কয়েদির হয়ে সওয়াল করলেন বা কেন তাঁকে করতে হল?
কারণ বাংলার মানুষ দেরীতে হলেও ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে তৃণমূল দলটা চোর-চিটিংবাজে ভর্তি। বিগত দশ বছরে একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে সিবিআই/ইডির হাতে ল্যাজেগোবড়ে হয়ে বেশ কিছু নেতা-মন্ত্রীদের এক ধারসে জেলযাত্রাই এর একমাত্র কারণ। যার সাম্প্রতিক সংযোজন পার্থ ও কেষ্ট। আর তাই ভাষণ দিতে উঠলেই দলের সমস্ত নেতা-মন্ত্রীকে দুর্নীতি এবং জেলযাত্রা নিয়ে কিছু শব্দ খরচ করতে হচ্ছেই। মমতা নিজেও তার ব্যতিক্রম হতে পারছেন না। এমনকি সিবিআই/ইডির তদন্ত ও গ্রেপ্তারি প্রসঙ্গে আইনি লড়াইয়ের আশ্বাসও দিয়ে ফেলছেন এই বলে যে:
“আমি পুরোটা শুনে নিয়েছি, জানবেন কিচ্ছু নেই, তদন্ত শেষে কিচ্ছু পাবে না, কোর্টে কিছুই প্রমাণ হবে না।”
কিন্তু পরের কথা পরে, তাতে এখনকার জিজ্ঞাসাবাদ-জেলযাত্রা-হেনস্থা আটকাবে কি? কর্মী সমর্থকদের দোলাচলটা তিনি বুঝতে পারেন! তাই তিনি নেত্রী। ফলে তালটা কেটে যাচ্ছেই! বলে ফেলছেন কিছু এলোমেলো কথা। এমনকি একটা সময় কানে এলো তিনি বলছেন,
“কোনও বিধায়ক বা মন্ত্রী কিন্তু নিজেদের প্যাডে চাকরির রিকোয়েস্ট করবেন না। প্রয়োজনে মুখোমুখি কথা বলবেন।”
এতো প্রকাশ্যে দুর্নীতিতে ইন্ধন! এরপর কেন কোন তদন্তকারি সংস্থা নিয়োগ দুর্নীতিতে ওনাকে ডাকবে না বা আদালতে ওনার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করবে না? যদি এসব বাদও দিই, তাহলেও এতো স্বয়ং নেত্রীর ভাষণেই দিশাহীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে! মানে তাঁর সরকার নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির হাত ধরবে না ছাড়বে, সেই বার্তাটাই সঠিকভাবে গেলো না কর্মী সমর্থকদের মধ্যে। উল্টে মুখে ‘কেষ্টনাম’। ফলে ভাইপো থেকে শুরু করে দলের জেলখাটা মুখপাত্র তাদের বশংবদ মিডিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে যে “নতুন” তৃণমূলের গপ্পোটা বাজারে ছড়াচ্ছিলেন সেটাই তো ‘বিশ বাঁও জলে’ চলে গেল!
আসলে মুখে “বাংলার বাড়ি” প্রকল্পের কথা বললেন ঠিকই কিন্তু বক্তৃতাতে সারাক্ষণ বাংলার জেলখানাই তাড়িয়ে বেড়ালো নেত্রীকে। তিনি জানেন কেষ্টই শেষ নয়, একে একে আরও অনেক নেতা-মন্ত্রী সিবিআই/ইডির ডাক পাবে। থাকবে গ্রেপ্তারের সম্ভাবনাও। মানে আগামীদিনেও উইকেট পড়তেই থাকবে। যেমন একটা ছোট্ট উদাহরণ হল গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত হঠাৎই সামনে আসা সন্মার্গ চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। সিবিআই ইতিমধ্যেই ধরপাকড় শুরু করে দিয়েছে। হালিশহর পুরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান রাজু সাহানি জেলে ঢুকে গেছে। এলাকার বিধায়ককে নিয়ে চলছে টানাটানি, যে কোনদিন জেলে ঢুকে যেতে পারেন। ফলে হালিশহর এলাকার তৃণমূলের রথী-মহারথীদের শুরু হয়ে গেছে নড়াচড়া। ইতিমধ্যেই “আমি মরে যাইনি” বলে একজনের হুঙ্কার এসে গেছে। অর্জুনের মুখেও হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করে পাট ছেড়ে বালি চুরির প্রতিবাদ। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, শুধু ভাইপো-কেষ্ট-ববি করলে হবে, আমারও আছি, আমাদের কে দেখো মা!
ফলে একসময় দলীয় কর্মী সমর্থকদের মনোবল বাড়াতে গিয়ে তিনি বলে বসলেন,
“বাড়িতে বসে ভাত খেতেন, না হয় জেলে বসে ভাত খাবেন। মনে রাখবেন, জেলের চালটাও আমরা দিই।”
কিন্তু এতে কি আদৌ কাজ হবে! এ যেন নেত্রী প্রছন্নভাবে জেলযাত্রার মানসিক প্রস্তুতি নিতে বললেন।
এটা “ভোকাল টনিক” না “চোরের প্যানিক” সেটা সময় এগোলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে!
কিন্তু নেতা-মন্ত্রীদের জেলযাত্রা যে আপাতত চলবে এবং তারমধ্যেই বিজেপির এজেন্সি আর সিপিএমের বিকাশবাবুদের বিরুদ্ধে তোপ দেগে লড়াই চালাতে হবে সে বার্তাও নেত্রী ঠারেঠোরে দিয়ে দিলেন।
ধন্যবাদান্তে
সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
Comments are closed.