ক্লেপটোম্যানিয়া / Kleptomania
তৃণমূল সরকার মানেই দুর্নীতির পাহাড়, জনমানসে ক্রমশঃ এমন একটি ছবি তৈরি হচ্ছে। পরিবর্তনের জমানায় গত একদশকে একের পর এক শীর্ষ নেতৃত্ব যেভাবে নিজেদের তৈরি দুর্নীতির জালে নিজেরাই জড়িয়ে গিয়ে জেলের ভাত খেয়েছেন বা খাচ্ছেন, এবং এরপরও আগামীদিনে আরও অনেকেই ধরা পড়বেন বলেই বেশিরভাগ মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তাতে তৃণমূল নামক দলটার বিশ্লেষণ করতে গেলে বাঙালি হিসেবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।
কিন্তু শুধু মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে পড়লেই চলবে! তৃণমূল দলটা তো আর আকাশ থেকে পড়েনি। আমরাই তো বছরের পর বছর এসব দেখেও ঢেলে ভোট দিয়ে একের পর এক নির্বাচনে এঁদেরকে জিতিয়েছি। এমনকি “লেসার এভিল” বলে এদের স্বপক্ষে চিল্লেছিও। নিজের সাম্রাজ্য বাচাতে কোনো সুযোগসন্ধানী নেতা-নেত্রী শিবির বদল করলেই “গ্রেটার ইভিল”কে “লেসার ইভিল” বলে তাদের মাথায় তুলে নৃত্য করেছি। কাজেই এখন যত দোষ নন্দ ঘোষ বললে হবে না। স্বীকার করতে হবে, এই দুর্নীতি আসলে বাঙালির সমাজের সার্বিক ব্যর্থতা।
সাধারণত কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের দাবিদাওয়ার বা বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে এবং আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনৈতিক সংগঠন বলা হয়। আর কিছু ধান্দাবাজ, চিটিংবাজরা একত্রিত হয়ে সংগঠিত হলে তাকে চোরেদের সংগঠন বলাই ভালো। যেহেতু তৃণমূল একটি রাজনৈতিক দল, তাই সেই দলে ধান্দাবাজ ছাড়াও কিছু ভালো মানুষ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে যুক্ত হবেই। ফলে কিছু নিপাট সৎ ভালো মানুষ যে তৃণমূলের সাথে যুক্ত রয়েছেন তা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু দলে তাঁরা কি আদৌ সংখ্যাগুরু! এই প্রশ্নটাই জনমানসে গভীরভাবে দেখা দিয়েছে। কারণ যে সমস্ত নেতা-মন্ত্রীদের নাম দুর্নীতির সাথে জড়িয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই একদম প্রথম সারির তৃণমূল নেতা। ইনফ্যাক্ট তৃণমূলের ফার্স্ট বেঞ্চ দেখলে এমন একজন খুঁজে পাওয়া কঠিন, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে যুক্ত থাকবার অভিযোগ নেই। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে রাশি রাশি অভিযোগ। তাঁর পরিবারের লোকজন নাকি শুধু দক্ষিণ কলকাতায় গত এক দশকে ৩০-৩৫টা প্লটের মালিক। ভাইপোর কথা না হয় ছেড়ে দিলাম, তার কেস ইডি/সিবিআই দেখছে, এমনকি কলকাতা পুরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের বউ এর নির্বাচনী হলফনামা বলছে, তিনি একাধারে সমাজকর্মী এবং চার-পাঁচ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি তিনি ও তাঁর পরিবার নাকি রানী রাসমণির ঠিকা প্রজা! ফলে স্বভাবতই ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে বহু মানুষের। খোদ দলনেত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে চিটফান্ড মালিকদেরকে নিজের আঁকা ছবি বাজারের থেকেও চড়া দামে বিক্রির অভিযোগ, যা আদতে চিটফান্ড মালিকদের থেকে ঘুরপথে টাকা আদায়ের নামান্তর। এখন আমরা সবাই জানি তৃণমূল হল মমতাকেন্দ্রিক একটি দল। ফলে দলনেত্রী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে যখন এত অভিযোগের তীর ধেয়ে আসে তখন “তৃণমূল দলটা আসলে চোরের দল” এমন অভিমত একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বস্তুতঃ যেখানে দুর্নীতি বিতর্কের সূত্রপাত ক্ষমতায় আসবার এক-বছরের মধ্যেই। নিয়োগ দুর্নীতির সূত্রপাত কিন্তু ২০১২ সালে। ফলে অনেকের মতে এ যেন সেই অনেকটা দুর্নীতি, চুরি-চিটিংবাজি করবো বলেই ক্ষমতায় আসা। যদিও শুরু হয়েছিল সারদা-রোজভ্যালি চিটফান্ড কেলেঙ্কারি দিয়ে। আর এখানেই প্রথম দুর্নীতির জাল জেলায় জেলায় তৃণমূল স্তরে পৌঁছে যাওয়ার শুরু। অনেকের মতে চিটফান্ড কেলেঙ্কারি এবং কুপন কেলেঙ্কারির কথা তো প্রথম বলেছিলেন সিপিআই(এম) নেতা গৌতম দেব এবং সেটা তৃণমূল ক্ষমতায় আসবার আগে। আর ক্ষমতায় আসবার পর যত সময় গিয়েছে, সেই তালিকাটাই দীর্ঘ হয়েছে। সামনে আসে টেট কেলেঙ্কারি। তারপর একে একে সামনে এসেছে বালি চুরি, পাথর চুরি, গাছ চুরি, পাহাড় চুরি। ইতিমধ্যে পাড়ায় পাড়ায় প্রমোটারি-সিণ্ডিকেট-তোলাবাজি শুরু হয়ে গেছে। পাড়ার খালি মাঠ বা পুকুর কিছুই অবশিষ্ট থাকতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই এসব হচ্ছে রীতিমত সরকার বা সংশ্লিষ্ট পুর-কর্তৃপক্ষ তরফে নোটিস জারি করে। এমনকি পাথরের লোভে আস্ত একটা পাহাড়ও বেচে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে। তারপর সামনে এসেছে রেশনের চাল চুরি, ত্রানের ত্রিপল চুরি। আর এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গরু ও কয়লা পাচার। আর চুরি মানেই কালো কাঁচা টাকার আনাগোনা। “অপা-সপা”দের বাড়বাড়ন্ত। ইদানীং পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলছিল কিছু ভুঁইফোড় তৃণমূল নেতাদের, যাদের বিষয় সম্পত্তি গত এক দশকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই প্রায় প্রাসাদোপম অট্টালিকার মালিক। গ্যারেজে দামি একাধিক এসইউভি।
এখন এই যে সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির বীজ বপনের সাথে সাথে নিজেদের আখের গুছিয়ে বাংলা ও বাঙালি সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল, তার জন্য শুধু কি তৃণমূল নেতা বা কর্মীরা দায়ী? বুকে হাত রেখে বলুন তো আপনিও কি সুযোগ পেলে বা ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে একটা চাকরি বাগিয়ে নেবেন না? চোরাই চাল বিক্রি হলে কম টাকায় কেনবার লোভে কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না? যোগ্যতা ছাড়াই আমাদের এই ছোট ছোট সুযোগ সুবিধা নেওয়ার মানসিকতাই জন্ম দিয়েছে এই তৃণমূলের। তারা তো সমাজের বাইরে নয়। আমার আপনার মধ্যেই তৈরী হয়েছে তৃণমূলের নেতৃত্ব। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ভুঁইফোড় নেতা হয়েছে। আর আমাদের ভুলিয়ে রাখা হয়েছে উৎসব-উদযাপন-মেলা-খেলা দিয়ে।
আসলে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা থেকেই তৈরী হচ্ছে চুরি করার প্রবণতা! ক্ষমতার অপব্যাবহার করে দুর্নীতির কারবার আসলে তারই বহিঃপ্রকাশ! এসব আসলে এক কথায় বললে বলা যায় আমাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা “ক্লেপটোম্যানিয়া”র লক্ষণ। তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে এর মাত্রা হয়তো অস্বাভাবিক রকম বেশি। তাই তাদের কৃতকর্ম বেশি বেশি চোখে পড়ছে।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এই যে টাকার এবং সম্পত্তির পাহাড়, প্রয়োজন অতিরিক্ত হলেও নিজেদেরকে তারই জন্য চৌর্যবৃত্তিতে ডুবিয়ে রেখে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে অবিরত দুর্নীতি করে যাওয়া, এসবের কি প্রয়োজন ছিল? ডিলন ব্রাউনের মেডিকেল রিভিউ এবং এনা গোটারের লেখা থেকে জানা যায়, ক্লেপটোম্যানিয়া হলো কিছু মানুষ যারা উত্তেজনা, চিন্তা ভাবনা, মানসিক চাপ নিয়েও চুরি করবার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং এই ঘুষ নেওয়া, চুরি করার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পান। আবার এমনও কিছু মানুষ থাকেন সমাজে যারা যথেষ্ট সম্পদশালী হওয়ার পরেও এমনকি অপরাধ বোধ জাগলেও একই দুর্নীতি বার বার করতে থাকেন, কার্যত যার উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর যেহেতু এই বিপুল সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাই অদূরে বা সুদূরে তা লুকিয়ে পর্যন্ত রাখেন। কেউ কেউ আবার লুকিয়ে না রেখে তার কিছু বাহ্যপ্রকাশও করে ফেলেন, কারণ বৈভবের প্রকাশ হল সামাজিক প্রতিপত্তি হাসিল করবার সহজ উপায়, যেটা হাসিল করতে পারলে ক্ষমতার অলিন্দে সহজে ঢুকে থাকা যায় এবং আগামীদিনে আরও দুর্নীতি করবার সুযোগ মেলে। আবার আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ পাবেন যাঁরা ভাবেন এদ্দিন ক্ষমতায় থেকে তোমরা অনেক খেয়েছো, এবার আমরা খাবো! যেন খাওয়াটা কোন অপরাধ নয়, অন্য কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে চুরি চিটিংবাজি করে শাস্তি না পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরালে চুরি জিনিষটা স্বাভাবিকভাবে সমাজসিদ্ধ হয়ে যায়! ক্লেপটোম্যানিয়া হলো এই রকম নানা অছিলায় চুরি করার এই প্রবৃত্তি ও পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর অক্ষমতা। মানে সোজা কথায় বর্তমানে রাজ্যজুড়ে যা চলছে, তা হল আদতে একদল ক্লেপটোমানিক মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে পূর্বপরিকল্পনা করে রাজ্য জুড়ে অপরাধমূলক দুর্নীতি ঘটাচ্ছে।
আর আমরা আরেকদল ক্লেপ্টোম্যানিয়াক মানুষ ভাবের ঘরে চুরি করে লেসার এভিল তকমা লাগিয়ে এদেরকে নিয়ে নাচানাচি করছি।
Comments are closed.