সূর্যকান্ত মিশ্রের উদ্দেশ্যে / To Surjyakanta Mishra

মাননীয় সূর্যকান্ত মিশ্র,

আপনাকে লেখা খোলা চিঠিতে প্রথমেই জানাচ্ছি, আমরা ভাবিনি, এই লেখা কোনদিন লিখতে হবে। কিন্তু আজ লিখতে বাধ্য হয়েছি। কারণ বামপন্থীরা বোধহয় একসাথে একাধিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকলে লড়তে পারছে না। মানুষকে বোঝাতে পারছে না, বামপন্থীদের লড়াইটা। তার একটা বড় উদাহরণ সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নির্বাচনগুলি। আর আমাদের কেন জানি মনে হচ্ছে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে ত্রিপুরাতে। তাই আগে থাকতে সাবধান না হলে আরও বড় বিপর্যয় এবং জনবিচ্ছিন্নতা অপেক্ষা করছে দলের জন্য।

একটু পিছনে তাকালেই দেখতে পাওয়া যাবে ২০২১ এর বিধানসভা অথবা ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে, যে তৃণমূল এবং বিজেপি দুটি দলই মানুষের জীবন-জীবিকার বিরুদ্ধে, তথা সার্বিকভাবে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। মিডিয়ার তৈরি বাইনারি অবশ্যই তার একটা বড় কারণ ।

এই মিডিয়া সংগঠিতভাবে গত তিন-চার বছর ধরে ক্রমাগত বামেদেরকে ব্রাত্য করে বা ব্ল্যাক আউট করে রেখে বাংলার একটা বড় অংশের মানুষের কাছে বামেদের কে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে সফল হয়েছেন। তাই যে সমস্ত দলের মাতব্বর/বিশ্লেষকরা বলছেন বাম কিম্বা সংযুক্ত মোর্চাকে অথবা “বিজেমূল” তত্ত্বকে বাংলার মানুষ গ্রহণ করেননি, সেই সব লোকদের আমরা বলতে চাই, বাংলার একটা বিরাট অংশের মানুষের কাছে সাম্প্রতিক নির্বাচন গুলিতে বামেরা ধর্তব্যের মধ্যেই ছিলেন না। ফলে মানুষ বামেদেরকে প্রত্যাখান করেছে, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এই ধরণের সরলীকরণ না করাই ভাল। “যা আমার পাতেই ছিল না, তা আমি খেতে ভালোবাসিনা বা পছন্দ করিনি তাই খাইনি” টাইপের আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে লাভ নেই। আর যে খাবার আমার থালায় নেই, সেই খাবারে নুন-মিষ্টি ঠিক আছে কিনা তা জানবার যেমন কোন দায় থাকে না, ঠিক তেমনই কংগ্রেস-আইএসএফের সাথে জোট করা ঠিক, না বেঠিক তা নিয়ে মানুষের খুব একটা মাথা ব্যাথা ছিল না। ভাইজান মিডিয়ার তৈরি বাইনারি ন্যারেটিভে কমিক রিলিফ (“গাছে বেঁধে পেটাবো ব্যাপারটা বেশ হিট হয়েছিল”) দিয়েছে। আর কংগ্রেস ছিল অনেকটা ফিল্মের এক্সট্রাদের মত যারা পর্দায় থাকে কিন্তু কেউ খেয়াল করে না। কাজেই জোট নিয়ে নিজেদের মধ্যে আকচা-আকচি না করাই ভালো।

কিন্তু “যতদোষ নন্দঘোষ” এর মত, সব দায় মিডিয়ার ঘাড়ে চাপালেও সেটা অন্যায় হবে। তবে মূল কারণ যে এটাই, তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকা উচিৎ নয়। আর এই ক্ষয়টা চলছে “স্লিপারি স্লোপ” নীতি মেনে। অর্থ্যাৎ এখানে মানুষ মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রথমে ভাবছে, বামপন্থীদের তো আজকাল দেখাই যাচ্ছে না; তারা আজ ক্ষয়িষ্ণু; কাজেই তাদের হয়ে কাজ করে কি হবে (সাংগঠনিক বিপর্যয়) ; আর এদেরকে ভোট দিয়েই বা লাভ কি (ভোট বাক্সে বিপর্যয়”)। নেক্সট স্টেপ – যারা শূন্য ( এখন আর কেউ ৭% বলছে না খেয়াল করবেন !) তাদের হয়ে আবার কি কাজ করব (আরও সাংগঠনিক ক্ষয়)। যে দল কোন আসন জিতবে না, তাকে ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করতে যাব কেন (ভোটবাক্সে আরও রক্তক্ষরণ)। আর এটা চলতেই থাকবে। যতক্ষণ না বামপন্থীরা সংগঠিতভাবে বিকল্প মাধ্যমে (আপাতত সোশ্যাল মিডিয়ায়, যদ্দিন না মূল স্রোতের মিডিয়ায় নিজেদের কিছুটা উপস্থিতি ফেরানো যাচ্ছে) পেশাদারি মোড়কে নিজেদের বক্তব্যকে তুলে ধরতে পারবে।

কিন্তু মিডিয়ার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সাধারণ বামপন্থী কর্মী বা নেতা-নেত্রীরা কি গা বাঁচাতে পারে! কজন আছে, যারা বিজেপি ও তৃণমূল দুটি দলকেই একই পঙক্তিতে রেখে লাগাতার রাজনৈতিক আক্রমণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত?

এখানে বামপন্থী হোয়াটসওয়্যাপ গ্রুপ গুলোতেই তর্ক বিতর্ক দেখলে মনে হয়, একদল চায় যেভাবেই হোক এরাজ্যে তৃণমূলকে হারাতে। তাঁদের মূল শত্রু তৃণমূল। আর তাই বিগত লোকসভা/বিধানসভা ভোটে পিসি-ভাইপোকে যেভাবে বামপন্থী কিছু নেতানেত্রী রাজনৈতিক আক্রমণ করেছেন, সে তুলনায় বিজেপিকে ছাড় দিয়েছেন বলা চলে।

পিসি-ভাইপোকে চোর চিটিংবাজ, তোলাবাজ, কাটমানিখোর দশবার বললে সেই পিসি-ভাইপো পার্টির লোকজনদের সারদা-নারদা কেসে মোদী-শাহেরা কেন ছেড়ে রেখেছেন, কেনই বা তাদেরকে আদর আপ্যায়ন করে নিজেদের দলে আশ্রয় দিয়েছেন কিম্বা টিকিট দিয়েছেন-সেটাও যে দশবার একই সাথে একই লাইনে বলতে হবে, সেটা বামপন্থী কর্মীরা বলেছে কি!

তৃণমূলের ভাতা/সোপ রাজনীতির বিরোধিতা করছেন, অথচ বিজেপির ২০২১এর ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতেও যে সেই একই ভাতা/সোপের ছড়াছড়ি সেটাও কি মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে! তৃণমূল বাংলাকে বাংলাদেশ বা মিনি পাকিস্তান বানিয়ে ফেলছে সেটা অনেক নীচুতলার কমরেডরা বিশ্বাস করেছেন ও লোককে বলে বেরিয়েছেন (হ্যাঁ এটাই বাস্তব সত্য)। কিন্তু বিজেপি যে বাংলা বিভাজনকারী শক্তি যেমন – কেপিপি, গোর্খাজনমুক্তি মোর্চা অথবা গ্রেটার কোচবিহারের সমর্থকদের সাথে হাত মিলিয়েছে, সেটা মানুষকে ততটা জোর দিয়ে বলেছে কি!

এবার আসি আরেকদলের কথায়। তারা মনে করেন আমাদের মূল শত্রু বিজেপি। তাকে হারাতেই সব শক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন। এইদলের লোকেরা সিএএ বা কৃষিবিলের মত দানবিক আইনের কথা বলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ টেনে বিজেপিকে আক্রমণ করেছেন ও করছেন – খুব ভালো কথা! কিন্তু তৃণমূলের এবারের ২০২১এর ম্যানিফেস্টো যে সিএএ/ কৃষিবিল নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব, তার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি, সেটা দেখতে ও মানুষকে বলতে এনারা কেন ভুলে গেলেন! আমাদের রাজ্য সরকার কৃষিবিলের মতই ক্ষতিকারক আইন এই রাজ্যে চালু করেছে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল, বলেছেন কাউকে? কজন জানে সেই আইনের কথা (পার্টিক্লাস চালু করে এসব ব্যাখ্যা না করলে দুর্ভোগ অবধারিত)।

তৃণমূলের সংখ্যালঘু তোষণের বিরোধিতাতে কটা শব্দ খরচ করেছি আমরা (এখানে আমাকে উল্লেখ করতেই হবে ভাইজান যতটা সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, আমাদের বাম নেতারা ততটা ছিলেন না)।

মনে রাখতে হবে বামপন্থীদের যদি নির্বাচনে জিততে হয় তাহলে তৃণমূল ও বিজেপি দুটো দলকেই হারাতে হবে। তাই রাজনৈতিক আক্রমণের ক্ষেত্রেও দুটো দলকে কোন রকম ছাড় দেওয়া উচিৎ নয়। আর মন্তব্য করবার সময়ও সচেতন থাকতে হবে। এমন কোন মন্তব্য করা যাবে না যাতে কোথাও গিয়ে কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জন্মায় যে, এই দুটি দলের কোনটির প্রতি বামপন্থীরা ঈষৎ হলেও নমনীয়।

কিন্তু সেই ভুলটাই মানিক সরকারের নেতৃত্বে ত্রিপুরার কমরেডরা করে চলেছেন বলেই দূর থেকে মনে হচ্ছে। যখন অভিষেক ব্যানার্জ্জীর ব্যাটেলিয়নের ওপর বিজেপির হামলার নিন্দা করছেন, তখন সেই একই লাইনে এটাও বলুন, তৃণমূলি গুন্ডাদের দাপাদাপির কাহিনী। গত দশ বছর ধরে তৃণমূল রাজত্বে কিভাবে বাংলা রসাতলে গেছে, তার বিবরণ তথ্য-ছবি-ভিডিও সহ বাংলার কমরেডদের থেকে নিয়ে ত্রিপুরায় মানুষের মধ্যে প্রচার করুন। নাহলে বাংলার মতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন।

এবার আসি বিজেমূল প্রসঙ্গে। মানুষ বামেদের বিজেমূল তত্ত্ব বিশ্বাস করেনি এবং বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে বেছে নিয়েছে এটা সঠিক। বিধানসভা ভোটের ফলাফল দেখলেই এটা স্পষ্ট হয়। কিন্তু তাই বলে বামেদের বিজেমূল তত্ত্ব ভুল ছিল, এমন একটা কথা সর্ব সমক্ষে আনবার আগে আরও আলোচনার সুযোগ ছিল বলে আমরা মনে করি। বিজেমূল তত্ত্ব ভুল ছিল, নাকি মিডিয়ার বাইনারিতে প্রভাবিত হয়ে মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে বেছে নিল সেটা ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়।

এটা অস্বীকার করবার জায়গা নেই মিডিয়া মানুষকে প্রভাবিত করে। সেই মিডিয়া তার মালিকের হয়েই গান গাইবে এটাই বাস্তব। কিন্তু জানবেন তাদের হাতে শিক্ষিত পেশাদার মানুষেরা থাকেন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। বিজেমূল একটি কঠিন বাস্তব যা অদূর ভবিষ্যতে উঁকি মারবেই।

কাজেই তখন যাতে বামেরা মাইলেজ না পেয়ে যায় তার জন্য তাদের দিয়ে বিজেমূল তত্ত্ব ভুল ছিল স্বীকার করিয়ে “বিজেমূল” শব্দবন্ধটিকে কবরে পাঠানো জরুরি। মানে জনসমক্ষ থেকে বিজেমূল তত্ত্বকে একদম ভ্যানিশ করে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে “বিজেমূল” ঝুলি থেকে বেরোলে কেউ চট করে ধরতে না পারে, বা দুইয়ে দুইয়ে চার করতে না পারে । আর এজন্যই তাদের ভাড়া করা কিছু “পলিটিকাল প্রস্টিটিউট” (আমরা যাদের কাউকে কাউকে ইদানিং রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছি) লাগাতার প্রথমশ্রেণীর কাগজে লেখা শুরু করল “বিজেমূল তত্ত্ব” ভুল ছিল। প্রশ্ন জাগে বিজেমূলের পেটোয়া মিডিয়া বাহিনী খামোখা বামেদের ভুল ভ্রান্তি শুধরে দিতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন! টিভিতে ও বিকল্প সমাজ মাধ্যমেও এই ধরণের অনুষ্ঠান চালানো হল এবং এখনও হচ্ছে লাগাতারভাবে। আর এতেই কি আপনার দল বিভ্রান্ত হল? আর তাই তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন “বিজেমূল” তত্ত্ব ভুল ছিল!

বিজেমূল ছিল-বিজেমূল আছে-বিজেমূল থাকবে। এটাই বাস্তব।

কিন্তু সিপিআই(এম) থাকলেই ঐতিহাসিক ভুল – বিভ্রান্তি থাকবে এই বাস্তবটা বদলাবার সময় এসেছে।

ভালো থাকবেন এবং ভালো রাখবেন।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস্