আনোয়ারা বিবি কি আজব কিসসা / Trapped inside NRS

শিরোনামটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর বিখ্যাত সিনেমার নাম থেকে ধার করা। কিন্তু ঘটনাটার অনেকটা মিল রয়েছে বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে পরিচালিত এবং রাজকুমার রাও অভিনীত বিখ্যাত ছবি Trapped এর সাথে যেখানে কলসেন্টার কর্মী সূর্য ( রাজকুমার রাও) ভাড়া নেওয়ার জন্য একটি বহুতল আবাসনের ওপরের তলায় ফ্ল্যাট দেখতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ ফ্ল্যাটে প্রবেশের মূল দরজাটা বন্ধ করে ফেলায় ফ্ল্যাটের মধ্যে আটকে পড়ে। এদিকে আবাসনটিতে জমি নিয়ে আইনি জটিলতার কারণে নির্মাণকার্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোন আবাসিক ছিল না। লোক বলতে ছিল একজন মাত্র দারোয়ান যে থাকত নীচের তলায়। বাকি সিনেমাটা জুড়ে ছিল সূর্য তথা রাজকুমার রাওয়ের এই বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসবার লড়াই। ওনার অসামান্য অভিনয় ভূয়সী প্রশংসাও পায় সর্বস্তরে।

কিন্তু আমরা যে ঘটনার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষন করবো সেটি কোন সেলুলয়েডের গপ্পোকথা নয়। চারদিন ধরে সরকারী হাসপাতালের লিফটে আটকে থাকা এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধার হার না মানা লড়াইয়ের বাস্তব ঘটনা। অথচ খবরটা তেমনভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা হল না সংবাদমাধ্যম গুলির পক্ষ থেকে পাছে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারাটা বে-আব্রু হয়ে যায় তাই! মানে সীমা-না পেরিয়ে যতটা পড়লে জানলে পিছিয়ে পড়তে হয় না ঠিক ততটা কভারেজ দিয়ে এগিয়ে পড়া আর কি!

মহিলার নাম আনোয়ারা বিবি। বয়স ষাটের ওপর। বাড়ি বাদুড়িয়ার চন্ডীপুর গ্রামে। গত প্রায় পনেরো-বিশ বছর ধরে উনি ওনার স্নায়ুরোগের চিকিৎসা করাতে কোলকাতার সরকারী হাসপাতালে একা একা যাতায়াত করতেন। সেইমত গত ২৭ শে ডিসেম্বরও আসেন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে আমরা যাকে ছোট করে NRS বলি। সঙ্গে ছিল এক বোতল জল, চিঁড়েভাজার প্যাকেট এবং সামান্য কিছু টাকা। নিয়মমত হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকিট কাটেন। তারপর তিনতলায় ডাক্তার দেখাবেন বলে এগিয়ে যান লিফটের দিকে। দুটি লিফট ছিল। একটি বড় এবং একটি ছোট। উনি ছোট লিফটে ওঠেন সম্ভবত একা যাবেন বলে যাতে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বজায় থাকে। কিন্তু সেই লিফট দোতলা আর তিনতলার মাঝে হঠাৎ খারাপ হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। উনি আটকে পড়েন ভেতরে। অনেক ডাকাডাকি চিৎকার চেঁচামেচি করেও কারোর সাড়া পান নি। এদিকে সন্ধ্যের পর রাতে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। উনি ভেতরে রয়ে যান।

রাতে মহিলা বাড়ি না ফেরায় বাদুড়িয়ার বাড়ির লোকেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। লোকাল থানায় নিখোজ ডাইরি করা হয়। পরদিন বাড়ির লোক আসেন হাসপাতালে খোঁজ করতে। খুঁজে না পেয়ে সেখানেও থানায় রিপোর্ট লেখান।
এভাবে আরও দুদিন কেটে যায়। মহিলা লিফটের মধ্যে অন্ধকারে এক বোতল জল আর এক প্যাকেট চিঁড়েভাজা খেয়ে লড়তে থাকেন আর মাঝেমধ্যে চিৎকার করেন যদি কেউ শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসে এই আশায়। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে বাথরুমের কাজকর্মও করতে বাধ্য হন ঐ বদ্ধ লিফটের মধ্যে। অথচ হাসপাতাল কতৃপক্ষের বা কর্মচারীদের নজরেই পড়ে না একটা লিফট খারাপ হয়ে গত দু-তিন দিন হল দোতলা ও তিনতলার মাঝে আটকে আছে।

এদিকে ৩১ শে ডিসেম্বর ফের বাড়ির লোক হাজির হয় হাসপাতালে খোঁজখবর করতে। তারাই সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে গিয়ে লক্ষ করেন একটা লিফট খারাপ হয়ে দুটো তলার মাঝে আটকে আছে! ডাকাডাকি করতেই ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ আসে। বুঝতে পেরে মেকানিককে খবর দেওয়া হয় এবং লিফট চালু হলে অবশেষে দীর্ঘ চারদিন পর আনোয়ারা বিবি কে উদ্ধার করা হয়।

‘‘আমি তো বুঝিনি লিফট খারাপ হয়ে গেছে। কত চিৎকার করেছি, কেউ শোনে না। একটা জলের বোতল ছিল, একটা চিঁড়ের প্যাকেট ছিল। অল্প অল্প করে জল খাচ্ছিলাম রোজ। ভাবছি, কেউ না কেউ এসে দরজা খুলবে। কেউ আসেনি। কীভাবে বাঁচলাম জানি না।’’ বাদুড়িয়ার চণ্ডীপুর গ্রামের বাড়িতে বসে ওই চার দিনের অভিজ্ঞতার কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন আনোয়ারা বিবি।

সরকারি হাসপাতালের লিফটে চার দিন ধরে আটকে রয়েছেন এক রোগী! কেউ জানতে পারলেন না?

এমনকি রোগীর বাড়ির লোক একজন পেশেন্ট নিখোঁজ রয়েছেন অভিযোগ করবার পরও হাসপাতাল কতৃপক্ষের টনক নড়ল না! শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালের বন্ধ লিফটের থেকে উদ্ধার পেতে হল মূলতঃ তারই বাড়ির লোকের উদ্যোগে!
মানে এভাবে সরকারী হাসপাতালে রোগীদের জন্য বরাদ্দ লিফট খারাপ হয়ে পড়ে থাকলে দেখবার কেউ নেই! সারাবার কোন উদ্যোগও কেউ নেয় না! এক কথায় নজরদারীর বালাই নেই কোন!

হাসপাতাল কতৃপক্ষের তরফে এমন চূড়ান্ত গাফিলতি তাও আবার কোন জেলা হাসপাতাল নয় এক্কেবারে খোদ কলকাতার বুকে প্রথমাসারির সরকারী হাসপাতালে বলতে গেলে নজিরবিহীন।

হাসপাতালের সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। হাসপাতালের এক আধিকারিকের দাবি, বিষয়টি বিস্তারিতভাবে কিছু জানা নেই। তাহলে কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে বিষয়টি খুবই সন্তর্পণে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে? আরও আশ্চর্যজনক হলো, ঘটনাটি কিছু সংবাদ মাধ্যমে সামনে আসবার পর থেকেই হঠাৎ পরিবারের সদস্যদের মোবাইলও বন্ধ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ আসছে! তবে কি পরিবারের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হল ওপর মহল থেকে চাপ দিয়ে উঠছে এই সব প্রশ্নও!

কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলোর মুখ কে বন্ধ করলো! তারাও কি Trapped! বাম আমলে আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ির লোকজন এমনকি তাদের পাড়া প্রতিবেশিদের নিয়েও যে লাইভ টক শো গুলো হত সেগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন! প্রধানমন্ত্রী ফ্লাইওভারে কুড়ি মিনিট আটকে পড়লে সন্ধ্যে বেলা সবকটা চ্যানলে সব মিলিয়ে কুড়ি ঘন্টার টক শো হয়ে যায় দিনের দিন! আর একজন অসুস্থ বৃদ্ধা রোগী ডাক্তার দেখাতে এসে সরকারী হাসপাতালের লিফটে চারদিন আটকে পড়লে তার জন্য কি বরাদ্দ শুধুই চার মিনিট!
জানতে চায় বাংলা!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
c) https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/woman-stuck-in-a-lift-of-nrs-hospital-for-4-days-dgtl/cid/1321636
d) https://bengali.news18.com/news/kolkata/kolkata-woman-stuck-in-nrs-hospital-lift-for-4-days-dd-713775.html
e) https://www.sangbadpratidin.in/kolkata/a-female-patient-allegedly-stuck-into-lift-of-nrs-hospital-for-4-days/
f) https://www.newsncr.com/national/the-shocking-incident-happened-in-bengal-the-woman-was-stuck-in-the-lift-of-the-government-hospital-for-4-days-there-was-no-news-to-anyone/
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-02/202201012335456.jpg&category=0&date=2022-01-02&button=
h) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-02/202201012338281.jpg&category=0&date=2022-01-02&button=