মাননীয়ার “ভোলবদল” / The Strange Change

সম্প্রতি দূর্গাপূজা পরবর্তী বিজয়া সম্মেলনীর মঞ্চ থেকে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বরাত আদানী শিল্পগোষ্ঠীকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন এবং সেই সংক্রান্ত সরকারি অনুমতিপত্র তুলে দিয়েছেন সংস্থার কর্ণধার গৌতম আদানীর পুত্র করণ আদানীর হাতে। আদানীর গোষ্ঠীর বন্দর নির্মাণ সংস্থা আদানী পোর্ট এন্ড স্পেশাল ইকনমিক জোন লিমিটেড (APSEZ) এই বরাত পাওয়ার কথা স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেছে। এই গভীর সমুদ্র বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামো তৈরি করতে মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে রাজ্যে। এরফলে ২৫ হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর সহযোগী ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান ধরলে সেই সংখ্যাটা ৫০ হাজার ছুঁতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
পূজো মিটতেই এমন একটা মন ভালো করা খবর নিশ্চয়ই রাজ্যের মানুষের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। আমরা ‘রাইজ অফ ভয়েসেস’ও রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। আমাদের এসব আদানি-আম্বানি শুচিবাই নেই। শিল্পপতি বাদ দিয়ে শিল্প হয় না। তাই কোন বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের আলাদা কোন ভালোবাসা বা সংস্কার নেই। আমরা চাই বাংলায় শিল্প হোক। শিল্পপতিরা আসুন।
আর তাই আজ এমন আবহে মনে পড়ে যাচ্ছে অতীতে কিভাবে এই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীই বিজেপি, কংগ্রেস ও মাওবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলা থেকে শিল্প তাড়িয়েছিলেন। তারই শিকার সেই সময়কার বাংলার একটি বা দুটি প্রজন্ম। তাদের অনেকেই আজ বাধ্য হয়ে প্রবাসে।

টাটা-জিন্দালদের মত প্রথমসারির শিল্পগোষ্ঠীরা তৃণ-কং-বিজেপি-মাওদের দলবদ্ধ ‘জঙ্গি’ জমি আন্দোলনের জন্য বাংলা থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছিল। সিঙ্গুরে টাটাদের ‘প্রায় হয়ে যাওয়া’ গাড়ি কারখানা আজ স্বপ্নের শ্মশানভূমি। প্রতিশ্রুতি মত চাষের জমিকে চাষযোগ্য করে ফেরানো তো দূরঅস্ত, তার এক দশমাংশ জমিতেও এখন আর চাষবাস হয় না। উল্টে এলাকার তৃণমূল নেতারা এখন সেই জমিতে চিংড়ির মাছের ভেড়ি বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। নন্দীগ্রামেও কেমিক্যাল হাব গড়ে ওঠেনি। চাষিরা ফসলের দাম না পেয়ে, সারের কালোবাজারির কারণে লভ্যাংশ হারিয়ে আজ কৃষিবিমূখ। সেখানেও সেই এক ‘বাগদা’ চিংড়ি চাষের গপ্পো। শালবনীতেও হয়নি জিন্দালদের ইস্পাত কারখানা। কারখানার শিলান্যাস করে ফেরবার পথে ২০০৮ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়কে মাও যোগে ল্যান্ডমাইন দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করা হয়। বিস্ফোরণ ঘটলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রাণে বেঁচে যান। স্বভাবতই এমন ঘটনার পর ওখানে কারখানা হবে এমন ভাবাটা পাগলামি। অবশ্য এমন ‘হয়নি’র তালিকাটা লম্বা। তারমধ্যে আমরা আর ঢুকতে চাই না। শুধু বলতে চাই এসবই যে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই সংগঠিত করা হয়েছিল, কোন নীতিগত জোড়ালো অবস্থান থেকে নয়, তা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট।
তা না হলে বামফ্রন্ট সরকারের যে ‘এসইজেড’ পলিসিকে দু-বেলা গাল না পেড়ে একসময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকালে জলগ্রহণ করতেন না, যিনি ২০১১ তে ক্ষমতায় আসবার পর বামফ্রন্ট সরকারের ‘এসইজেড’ পলিসি বাতিল করে দিয়েছিলেন, আজ সেই তিনি এই তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পটিকে ‘এসইজেড’-র মর্যাদা দিতেন না। আসলে দুঃসময় এলে সাপে ছুঁচো গেলে! ‘এসইজেড’ নিয়ে ওনার অবিমিশ্রকারিতার জন্যই ইনফোসিস, উইপ্রোর মত প্রথমসারির প্রযুক্তি সংস্থার বিনিয়োগ থেকে রাজ্য একসময় বঞ্চিত হয়েছে।
কিন্তু অতীতে তো আর বাঁচা যায় না। বর্তমানকে স্বীকার করে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে হয়। তবেই সেই বাঁচাটা ইতিবাচক হয়। আর তাই আমরাও ভালো দিক খুঁজছি। ভালোদিক হল মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন তাঁর এই ‘শিল্পতাড়ুয়া’ ভাবমূর্তিটা বদলানোর সময় এসেছে। এখন আর ‘এসইজেড’ নিয়ে সরকার ও দলের সেই ‘পলিসিগত’ অসূয়া নেই জেনে ভালো লাগছে। এভাবে ভুল শুধরে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন।
কিন্তু খারাপ দিক হল বাংলার সংবাদমাধ্যম তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটিকে যে ‘এসইজেড’ র মর্য্যাদা দেওয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব রয়ে গেল! কোন বাধ্যবাধকতা থেকে প্রায় সবকটি ‘সবজান্তা’ সংবাদমাধ্যমের তরফে এমন ‘অর্ধসত্য’ পরিবেশিত হল আমরা জানি না।
তা কি মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের এমন আমূল ‘পলিসিগত’ ভোলবদলকে লুকিয়ে ফেলতে, নাকি শাসককে অপ্রিয় প্রশ্ন থেকে বাঁচিয়ে স্বস্তি দিতে, তার বিচার আপনারা পাঠকরা করুন। অর্ধসত্য কি মিথ্যা! নাকি তার থেকেও বেশি কিছু! বিবেচনার দায়িত্বও আপনাদেরকেই দিতে চাই।
একইসাথে সিপিআই(এম) সহ বিগত বামফ্রন্ট সরকারের দলগুলির কাছে আমাদের আবেদন, শিল্প স্থাপনে বর্তমান সরকারকে আপনারা সব রকমভাবে সহযোগিতা করুন। আর রাজ্য বিজেপি ও কংগ্রেস যারা বাম আমলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ‘শিল্পতাড়ুয়া’ জোটে সঙ্গী ছিলেন, তাঁদের দিল্লির সর্বময় কর্তাদের আদানি আনুগত্য এখন সর্বজনবিদিত। কাজেই তাদের কাছে আমাদের আলাদা করে কোন আবেদন নেই।
বাংলার ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে এখন কয়েক কদম অতিরিক্ত হাঁটা জরুরি।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্র
a) https://www.business-standard.com/article/companies/bengal-government-hands-over-letter-of-award-for-tajpur-port-to-adani-ports-122101201271_1.html
b) https://aaroananda.com/social/article/3182430
c) https://www.thehindu.com/news/national/other-states/mamata-scraps-sez-policy/article3449879.ece
d) https://www.indiatoday.in/india/east/story/mamata-banerjee-we-cannot-change-our-anti-sez-stand-100457-2012-04-26?utm_source=washare&utm_medium=socialicons&utm_campaign=shareurltracking
e) https://www.livemint.com/Politics/RN7lpYiUldXqvc8fxLTuZN/Mamata-Banerjee-says-no-to-Wipro-on-SEZ.html?utm_source%3Dshare%26utm_medium%3Dsocial%26utm_campaign%3Dshare_via_amp
f) https://theprint.in/politics/nandigram-singur-farmers-are-angry-with-mamata-but-trinamool-still-expected-to-hold-sway/219514/
g) https://www.anandabazar.com/west-bengal/fisheries-are-being-created-in-singur-bjp-attacks-tmc-dgtld/cid/1326388
Prabir Chatterjee.
এক অতি তিক্ত সত্যকে মধুমাখা আবরণে পরিবেশন খুব ভালো লাগলো। খুব ভালো, খুব ভালো। ❤🙏