উপনির্বাচন গায়েব! মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্র / Maniktala Bypoll

পূজোর আনন্দ উৎসবের মধ্যে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস কোন রাজনৈতিক কচকচানি চাইনি। বরং চেয়েছি বিগত দু’বছর মহামারীর কারণে পুজোর আনন্দ থেকে ব্রাত্য আট থেকে আশি উৎসবের আমেজ চেটেপুটে নিক। আর আপনাদের হয়ে আমরা চোখ রেখেছি দেশ ও রাজ্যের ঘটে চলা রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাক্রমের ওপর যাতে উৎসব মিটলে তা যথাযথ তথ্যসহ মানুষের কাছে তুলে ধরা যায়। পাশাপাশি আপনারা যাঁরা রাইজ অফ ভয়েসেস-এর নিয়মিত পাঠক, তাঁরা এও জানেন আমরা সাধারণত সেইসমস্ত খবরগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরি যা মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে যায়। আর পূজোর মরশুমে এমনিতেই খবরের কাগজ বন্ধ থাকে। আর টিভিতে খবরের চ্যানেল গুলো সঙ্গত কারণেই এই সময় ব্যস্ত থাকে রাজ্য জুড়ে চলা উৎসবের ফুটেজ ও কভারেজ নিয়ে। ফলে পূজোর সময়গুলোতে রাইজ অফ ভয়েসেসের মত অনাম্নী নিউজ প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়িত্ব কিছুটা হলেও বেড়ে যায়। আর সেই দায়িত্ববোধ থেকেই বর্তমান প্রতিবেদনটির অবতারণা।

গত ৩ তারিখ মানে মহাষ্টমীর দিন দেশের নির্বাচন কমিশন ছয়টি রাজ্যের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে। এই উপনির্বাচন হতে চলেছে আগামী ৩রা নভেম্বর। কিন্তু সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই। অথচ খোদ কলকাতা শহরের বুকে মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রটি তা প্রায় আটমাস হতে চলল প্রাক্তন ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের মৃত্যুতে জনপ্রতিনিধিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। গত ২০ শে ফ্রেব্রুয়ারী ফুসফুসের সমস্যার কারণে মুম্বাইতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের মৃত্যু হয়।
যদিও তারপর থেকেই আমরা দেখছি কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ উপনির্বাচন নিয়ে শাসক তৃণমূল বা খাতায়-কলমে প্রধান বিরোধীদল বিজেপির কোন হেলদোল নেই। কিন্তু কেন? কেন দেশের অন্যান্য রাজ্যের জনপ্রতিনিধিহীন বিধানসভা কেন্দ্রগুলোতে নিয়মমাফিক উপনির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হলেও মানিকতলার বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দা ও নির্বাচকমন্ডলী ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন! দেশের নির্বাচন কমিশনই বা কেন মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের নোটিস জারি করছেন না! এই সব নানা কারণেরই তত্ত্ব-তল্লাস করবো আমরা আজকের প্রতিবেদনে।

প্রথমেই জানিয়ে রাখি নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে আইনগত কারণেই তাঁরা মানিকতলা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের নোটিস জারি করতে পারছেন না। কারণ একুশের বিধানসভা ভোটে বিজেপির পরাজিত প্রার্থী কল্যাণ চৌবে নির্বাচনে কারচুপি করে তৃণমূল জিতেছে এই অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। সেই মামলাটির নিষ্পত্তি এখনও অধরা! নির্বাচন কমিশন এই মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নতুন উপনির্বাচনের নোটিস জারি করে আইনি জটিলতা বাড়াতে চায় না। আর তাছাড়া যদি এই মামলার রায় কল্যাণ চৌবের পক্ষে যায় সেক্ষেত্রে নতুন করে উপনির্বাচনের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না। আর এজন্যেই আপাতত মানিকতলা অঞ্চলের বাসিন্দারা জনপ্রতিনিধি পেতে আপাতত আদালতের দিকে তাকিয়ে। এটা হল আইনি দিক।

কিন্তু প্রশ্নটা উঠছে অন্যদিক থেকে। বিজেপি যদি সত্যিই শাসক তৃণমূলের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়, যদি মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচক মণ্ডলীর ওপর বিজেপির আদৌ আস্থা থেকে থাকে বা তাঁরা যদি আদৌ চাইতেন, মানিকতলা অঞ্চলের বাসিন্দারা একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পান, তাহলে বিগত নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীর মৃত্যুতে এই মামলাটি তুলে নিয়ে উপনির্বাচনের রাস্তা প্রস্তুত করে দেওয়াই সমীচিন হত নাকি!

এখন প্রশ্ন কেন তাঁরা সেপথে হাঁটছেন না। কারণটা খুব স্পষ্ট! এমনিতেই একুশের বিধানসভা ভোটের পর থেকেই বঙ্গ বিজেপি হল একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। যেসব শাসক তৃণমূলের নেতারা বেড়া টপকে বিজেপিতে ঢুকে তাদের রাজনৈতিক পালে হাওয়া দিয়েছিলেন, দু-চারজন বাদে তাঁদের প্রায় সবাই একে একে ফের শাসক তৃণমূলে ফিরে গেছেন। কলকাতা পুরসভা (মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রটি কলকাতা পুরসভার মধ্যে পড়ে) সহ সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্য জুড়ে হওয়া ১০৮ টি পুরসভার নির্বাচনে বিজেপি প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে চলে গেছে বামেদের পিছনে। তাদেরকে পেছনে ফেলে দ্রুত উঠে আসছে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট।

এমনকি বিগত মাস দুয়েকের মধ্যে জেলায় জেলায় সংগঠিত বামেদের মিটিং-মিছিলগুলো ধারে ও ভারে শাসক তৃণমূল ও তাদের পুলিশ বাহিনীকে রীতিমত চোখে চোখ রেখে টক্কর দিয়েছে। তাদের ঝাঁজের সামনে শাসককে কিছুক্ষেত্রে বেশ অসহায় ঠেকেছে, তারমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল বর্ধমান শহরের আইন অমান্য কর্মসূচী এবং ২০ শে সেপ্টেম্বর কলকাতার বুকে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে আয়োজিত ‘ইনসাফ সভা’। সেখানে তারপাশে বিজেপির বলার মত আন্দোলন বলতে নবান্ন অভিযান তা যতটা না জনমানসে দাগ কাটতে পেরেছে তার থেকে অনেক বেশি হাসির খোরাক হয়েছে। অভিযানের ভারপ্রাপ্ত নেতারা শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়ে কার্যত বিনা প্রতিরোধে লালবাজারে চলে গিয়ে যেরকম হাসি-ঠাট্টার মেজাজে চা-জল-কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে ফেসবুক লাইভ করেছেন তাতে ফুটেজখোর থেকে ফুটেজ সোলজার হতে তাঁদের যে অনেক সময় লাগবে এমন একটা সুস্পষ্ট বার্তা পেয়ে গেছে বাংলার জনগণ। ফলে রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশের মতে খাতায় কলমে প্রধান বিরোধী বিজেপি হলেও কার্যক্ষেত্রে মাঠে ময়দানে এই মুহুর্তে শাসক তৃণমূলের আসল প্রতিপক্ষ হল বামেরাই। আর তাই এমন সন্ধিক্ষণে বিজেপি অবশ্যই মানিকতলার মত উপনির্বাচন এড়াতে চাইবে। তারা চাইবে মামলাটা চলুক। “তারিখ পে তারিখ” চলতে থাক। কিন্তু এই মুহুর্তে কিছুতেই নির্বাচন যেন না হয়। হলেই পুরসভা নির্বাচনের পর ফের একবার বামেদের পেছনে ‘থার্ড বয়’ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আর একবার তা হলে বিজেমূল বাইনারি ধ্বসে যাবে। আগামী পঞ্চায়েত ভোটে যার প্রভাব পড়বে অবধারিত ভাবে। আর ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে সেক্ষেত্রে বাংলা থেকে কোন আসন আদৌ জুটবে কি না নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কাজেই আদালত জিন্দাবাদ! বিজেপির উদ্দেশ্য পরিষ্কার বোঝা গেল!

কিন্তু শাসক তৃণমূল। তাদের একজন দাপুটে বিধায়ক তথা মন্ত্রীর মৃত্যুতে মানিকতলা আজ জনপ্রতিনিধিহীন। অথচ তাদেরও কি আদৌ উপনির্বাচনে যাওয়ার গরজ আছে ? একবারও তাদের তরফে কেউ কি বলেছে যে বিজেপি চায় না মানিকতলায় নির্বাচন হোক? আসলে এই মুহুর্তে শাসকদলও বেকায়দায়! তাদের নেতা-মন্ত্রীরা যে আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তারই এক ঝলক বাইরে চলে এসেছে পার্থ-অর্পিতা কান্ডে। বঙ্গবাসী দেখে ফেলেছে দুর্নীতির সেই কদর্য রূপ। তারওপর গরু পাচার কেসে দোর্দন্ডপ্রতাপ কেষ্ট মণ্ডলকেও দুবেলা জেলের ভাত খেতে হচ্ছে। কয়লা পাচার কেসে দলের নাম্বার -টু সপরিবারের সিবিআই/ইডির সমন পাচ্ছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজাম প্যালেসে যাতায়াত চলছে তাঁদের। ফলে যত দিন যাচ্ছে জনমানসে তৃণমূল সম্পর্কে একটা অসচ্ছ দুর্নীতিগ্রস্ত ছবি গেঁথে বসছে। এতে দলের কর্মী সমর্থকদের অনেকেরই মনোবল ভাঙতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে উপনির্বাচন সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। এমনকি এসব ক্ষেত্রে ভোট কমলেও সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে এমন প্রচার গতি পেয়ে যায়। আর বিগত পুরসভা ভোটগুলোর মত জোর জবরদস্তি ছাপ্পা মেরে ভোটে জেতা মানে ফের একরাশ মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করা! কাজেই আপাতত নির্বাচন না হওয়াই মঙ্গল। তারওপর মানিকতলা বিধানসভা ক্ষেত্রটি যে উত্তর/মধ্য কলকাতার অন্তর্গত, সেখানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সুবিদিত। কিছুদিন আগেই দূর্গাপূজার উদ্বোধনে সামান্য ফিতে কাটাকে কেন্দ্র করে সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যে এই এলাকার দুই নেতার ধাক্কাধাক্কি-কাজিয়া সামনে এসেছে। কাজেই এমন পরিস্থিতিতে এই বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী নির্বাচনও শাসকের কাছে যথেষ্ঠ মাথা ব্যাথার কারণ। ফলে মানিকতলা উপনির্বাচন নিয়ে শাসক শিবিরের মুখেও কুলুপ।

এমনকি সাম্প্রতিক রাজ্যজুড়ে বামশক্তির উত্থানে তৃণমূল শিবিরও যে যথেষ্ট চিন্তিত, তা তাদের নেতা-মন্ত্রীদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট। কোথাও কোথাও স্থানীয় স্তরে কেউ কেউ প্যানিক অ্যাটাকের মত এক্সট্রা বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ পূজোর মধ্যেই রাসবিহারী মোড়ে সিপিআই(এম)র বুকস্টল ভেঙ্গে দেওয়া। ঐ একই ভুল কাজ হাওড়াতেও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব করেছে। করেছে দিনহাটাতেও। মানে উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র একই চিত্র। আর এমন পরিস্থিতিতে কোন শাসক চায় উপনির্বাচনে যেতে! যদি সত্যি বিজেমূল বাইনারি ধ্বসিয়ে দিয়ে বামেরা উঠে আসে তাহলে আগামী পঞ্চায়েত ভোটে পস্তাতে হতে পারে! কাজেই উপনির্বাচন নিয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়!

এদিকে বামেরাও কিন্তু মানিকতলা অঞ্চলে এই ইস্যুটাকে সামনে এনে সেভাবে মুখ খুলছে না! বা খুললেও আমাদের চোখে অন্তত পড়েনি। তাঁরা কি জল মাপছেন ? নাকি আত্মবিশ্বাসের অভাব ? আমরা জানি না।

আর বাংলার সংবাদমাধ্যম তো দেশের বাকি ছয়টা রাজ্যে যে উপনির্বাচন হচ্ছে সে খবরটা পর্যন্ত বঙ্গবাসীকে জানাতে ভুলে গেছে। ফলে মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে কেন উপনির্বাচন হচ্ছে না এমন প্রশ্ন তারা তুলবে এমনটা আশা করাও বাতুলতা মাত্র!

কাজেই আমাদের সবদিক দেখে যা মনে হচ্ছে তা হল আপাতত মানিকতলায় উপনির্বাচন হচ্ছে না।
শাসক এবং বিরোধী কোন পক্ষই উপনির্বাচনের জন্য সেভাবে ঝাঁপাচ্ছে না।

ফলে মানিকতলার কোন জনপ্রতিনিধিকে আপাতত রাজ্য বিধানসভায় দেখা যাবে না।
তাই মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দাদের বলবো ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি চাই’ এই দাবিতে নিজেদের মধ্যে জনমত গড়ে তুলতে। দাবি সনদ পেশ করতে নির্বাচন কমিশনের কাছে, শাসক ও বিরোধী দলগুলোর কাছে।

একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকা গণতান্ত্রিক দেশের সব নাগরিকের অধিকারের মধ্যে পড়ে। এভাবে রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না। আর আদালতকেও অনুরোধ জানাবো দেখতে যাতে জনপ্রতিনিধিবিহীন মানিকতলার মানুষ যেন অনতিবিলম্বে সুবিচার পায়।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.livemint.com/news/india/ec-announces-bye-elections-in-6-states-on-3-nov-full-schedule-here-11664794614222.html
b) https://bengali.abplive.com/district/maniktala-by-election-might-get-deferred-until-hc-gives-verdict-on-pending-case-says-election-commission-source-906583
c) https://bangla.hindustantimes.com/bengal/kolkata/maniktala-assembly-election-notification-announced-soon-31658829055055.html
d) https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/ec-may-not-hold-maniktala-bypoll-now/articleshow/93149718.cms