একটা মেরুদণ্ডের জন্য / In search of a straight spine

আমরা তো বাংলার খুঁটিনাটি লিখি।

আমাদের চোখ রাখতে হয় কোন খবরটা আপনাদের জানা জরুরি হওয়া সত্বেও, তা মূলস্রোতের কোনো সংবাদমাধ্যম দেখালো না বা সেভাবে কভার করলো না, তার ওপর। আর এসব করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই আমাদের হাতে আসে বামপন্থীদের বিভিন্ন কর্মসূচির খবর এবং ছবির ক্লিপিংস। বলতে দ্বিধা নেই খুব সচেতন ভাবেই সেগুলো আমরা এড়িয়ে যাই। কারণ সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির খবর আমরা করি না।

কিন্তু সেদিন মানে ৩১ শে আগস্ট যা ঘটলো এবং সংবাদমাধ্যমে যা বেরোল তারপর আমাদের কয়েকটা কথা না লিখলেই নয়। সেদিন সিপিআই(এম) এর নেতৃত্বে হুগলী, বর্ধমান, পুরুলিয়া এবং ঝাড়্গ্রাম এই চার জেলায় আইন অমান্য কর্মসূচীতে ব্যপক জনসমাগম হয়। অনেকেই বলছেন জনজোয়ার। টিমের সদস্যদের তরফে কেউ কেউ বলছেন সংবাদমাধ্যম সেভাবে দেখাচ্ছে না, বাংলার খুঁটিনাটি লেখা হোক। সমাজমাধ্যম থেকে এই সংক্রান্ত মেসেজ ও ভিডিও ক্লিপিংস তুলে তুলে ব্যক্তিগত হোয়াটসওয়্যাপ নম্বরে ক্রমাগত এসে যাচ্ছে একের পর এক অনুরোধ। এর মধ্যে রাইজ অফ ভয়েসেস-এর কিছু অত্যুৎসাহী পাঠকও আছেন।

এদিকে যিনি এই প্ল্যাটফর্মের বেশিরভাগ লেখার বয়ান বানান তিনিও নাছোড়! না লিখব না। কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও তার কর্মসূচীকে তুলে ধরা আমাদের কাজ না। সরকার ও খাতায় কলমে প্রধান বিরোধীদলের বক্তব্য বা তাদের কাজকর্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণই মূলত আমরা করে থাকি। কাজেই একদিকে চুপচাপ বসে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ভাবছি কি করা যায়, আর অন্যদিকে টিমের বামপন্থী সদস্যদের থেকে এন্তার গালমন্দ খাচ্ছি।

আর ঠিক এমন কঠিন সময় তিনি এলেন, আমাদেরকে উদ্ধার করলেন। “মাননীয়া” তো আর এমনি এমনি বলি না! যদিও অনেকের মতে বামেদের কর্মসূচির বেশি খবর যাতে না হয়, তাই জন্যেই তাঁর এমন অকাল আবির্ভাব। তা সে যাইহোক, একদম ঝাড়া ৩০-৩৫ মিনিটের ঝোড়ো সাংবাদিক সম্মেলন। আর বলাই বাহুল্য, সব সংবাদমাধ্যমের ফোকাস সেদিকে।

ছোটবেলা কেটেছে বাম শাসনের বাংলায়। তখন দেখতাম সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কাকে বলে! সাংবাদিকরা একদম ওঁত পেতে থাকতেন কখন আলটপকা দু-এক পিস বেরোবে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য কোন দোর্দন্ডপ্রতাপ বাম নেতা-মন্ত্রীর মুখ থেকে। বেরোলেই পরদিন সেটাই কাগজে কাগজে হেডলাইন হয়ে যেত।

যেমন – বানতলা ধর্ষনকান্ড। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলে বসেন “এগুলো কাম্য নয়, বাট ইট হ্যাপেন্স” আর পায় কে? তখন তো এখনকার মত ঘরে ঘরে টিভি-সোশ্যালমিডিয়া ছিল না। সংবাদ মানে তখন রেডিওর সান্ধ্যখবর আর পরদিন খবরের কাগজ। এখনও মনে আছে পরদিন প্রায় সবকটা প্রথমসারির খবরের কাগজে জ্যোতিবাবুর সমালোচনা।

অথবা ধরুন গিয়ে কাঁকুড়গাছির শিশু হাসপাতালে একদিনে ১০ জন শিশুর মৃত্যু ঘটায় সাংবাদিকদের ট্যারা-ব্যাঁকা প্রশ্নবাণ সামলাতে গিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বলে বসেছিলেন “অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে।” ব্যস, পরদিন কাগজে কাগজে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাপান্ত করে প্রথম পাতায় বড় বড় কলম।

এমনকি বামেদের দলীয় বা মন্ত্রীসভার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কে কি বলেছে “নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক” বা “গোপনসূত্রে” তকমা চাপিয়ে লিখে দেওয়া হত। তারমধ্যে যেমন “আমি চোরেদের মন্ত্রীসভায় থাকবো না” ছিল, তেমনই সম্প্রতি শোনা “খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার” গানও আছে।

কিন্তু ৩১শে আগস্ট দেখলাম আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা কেমন বাধ্য ছেলেমেয়ের মত বসে বসে একতরফা মাননীয়ার “মন কি বাত” শুনে গেলেন! মুখে কোন প্রশ্ন বা “রা” নেই। আর তারপর সেকি নিপুণতার সঙ্গে আলটপকা “মণিমুক্ত” বেছে বেছে বাদ দিয়ে সবথেকে নিরামিষ শব্দগুচ্ছ নিয়ে টিভিতে খবর করলেন এবং পরদিন খবরের কাগজে ছাপালেন! এসব দেখে বেশ একটু লজ্জাই লাগছিল। কিন্তু পরে ভাবলাম লজ্জা পেয়ে লাভ নেই, বরং লেখাটা জরুরি।

তাই মাননীয়ার সেরকমই কিছু আলটপকা উক্তি আপনাদের জন্য যা সংবাদমাধ্যমে অনায়াসে হেডলাইন করতে পারতো, কিন্তু হয়নি।

“একধরণের ব্ল্যাকমেলিং পলিটিক্স শুরু হয়েছে।”

এই মন্তব্যের উপর তো বাম আমলের সংবাদপত্রের সম্পাদক মহাশয়রা শুধু দৈনিক সম্পাদকীয় নয়, সাপ্তাহিক প্রবন্ধ লিখে ফেলতেন। সেকালের ‘হিং টিং ছট’/‘বাবুরাম সাপুড়ে’রা কি মরে গেল! কারণ প্রশ্ন একটাই। আমি যদি গোপনে বা লোকচক্ষুর আড়ালে কোন অপরাধ বা লজ্জাজনক কাজ না করে থাকি তাহলে ব্ল্যাকমেলিংটা হচ্ছে কি করে! মাননীয়াকে তাঁর বা তাঁর দলের কোন গুহ্য কাজের জন্য ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে! ধামাচাপা পড়ে যাওয়া চিটফান্ড কেলেঙ্কারি? নারদা স্টিং? নাকি এখনকার নিয়োগ দুর্নীতি, গরু-পাচার, কয়লা পাচার কাণ্ড!
জানতে পারিনি। কারণ কোন সাংবাদিক বন্ধু এমন কোন প্রশ্ন করে উঠতে পারেননি।

“গরু-কয়লা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আন্ডারে। আমাদের দায়িত্ব নয়।”

মানে গরু পাচার কয়লা পাচার এসব বন্ধ করবার দায়িত্ব বিএসএফ / সিআরপিএফ-এর। একদম ঠিক। এসবই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতা। এটাও সত্যি। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন হতেই পারত গরু পাচার, কয়লা পাচার কান্ডে যাঁরা অভিযুক্ত, যাদের নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তির হদিশ দিচ্ছে স্বয়ং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, তাঁদের অনেকেই তো মাননীয়ার আন্ডারে! দলে অথবা মন্ত্রীসভায়!

না। সংবাদমাধ্যম এক-দুবার ব্রেকিং নিউজ করে ছেড়ে দিয়েছে। সাংবাদিকরাও পাল্টা কোন প্রশ্ন করেননি।

“আমি সেটিং করি না। আমি একাজে ফিটই নই। আমি যেখানে নিজেকে ফিট করতে পারি না আমি সেখানে কিভাবে সেটিং করবো।”

“আরএসএস খারাপ আমি বিশ্বাসই করি না।”

এখানে দুটো মন্তব্য পরপর রাখলাম। আপনারা পাঠকরা বিচার করবেন ‘সেটিং’ কিভাবে হয় তার আভাস পেলেন কি পেলেন না!

সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা কিন্তু পাননি। তাই কোন প্রশ্নও নেই।

ভূ-ভারত জানে আরএসএস এর রাজনৈতিক মুখ হল বিজেপি। বিজেপির সাংগঠনিক চালিকাশক্তি এদের হাতে। প্রধানমন্ত্রী মোদী স্বয়ং আরএসএস প্রচারক ছিলেন। কাজেই আরএসএস এর প্রশংসা যে ঘুরিয়ে সেটিং বার্তা নয় তার নিশ্চয়তা কোথায়! বিরোধীরা তো প্রশ্ন করবেই। এমনকি “লেসার এভিল” ভেবে “আমি অন্য কোথাও যাব না, আমি এই দেশেতেই থাকবো” গান গাওয়া সুধীজনদের একাংশকেও ভাবাবে আজকে মাননীয়ার এই মন্তব্য। কিন্তু বাংলার সংবাদমাধ্যমকে ভাবাতে পারেনি! তাঁরা একদম নির্বিকল্প সমাধিতে। এরা ভাবতেও চায় না, কোন প্রশ্ন করতেও চায় না । কিন্তু কেন? জানতে হলে প্রতিবেদনের বাকিটা পড়তে হবে।

“সরি। আমি একটু আউট স্পোকেন। সামনে মিটিং-এই বলি। আপনারা সংবাদমাধ্যম কোন সুত্র-তথ্য ছাড়া অসত্য কুকথা বলেন। যাকে তাকে চোর বানিয়ে দিচ্ছেন। কলুষিত করবার চেষ্টা করছেন।”

আপনারা জানলে অবাক হবেন এই কথা শুনে সংবাদমাধ্যমের কোন প্রতিনিধি একটা “রা” কাটেন নি। বাম আমলে রাইটার্স বিল্ডিং এর অলিন্দ থেকে জ্যোতিবাবু শুধু প্রেসবক্স নীচে নামিয়ে দিয়েছিলেন বলে, কাগজে কাগজে বিপ্লব হয়ে গিয়েছিল। অথচ আজ মৌন থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা একপ্রকার ঘুরিয়ে মেনে নিলেন তাঁরা অসত্য কুকথা বলে বেড়ান। সবকিছু দেখে মনে হল এনাদের শিরদাঁড়াটা আর কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারছে না। যদিও ঠিক কি কারণে সাংবাদিক বন্ধুরা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন সাংবাদিক সম্মেলনের শেষ বেলায় পৌঁছে মাননীয়া তাঁর একটা আভাসও দিয়ে রাখলেন। কি সেই কথা তা দিয়েই শেষ করবো আজকের এই প্রতিবেদন।

“আমরাও একটা করে ভিডিও করে ছেড়ে দি, কোন কোন সংবাদমাধ্যমে কে কে বিদেশে গেছে কোন কোন চিটফান্ডের টাকায় বা আর কোন কোন ব্যাপার আছে দি…”

মারাত্মক অভিযোগ!

এতো মুখ্যমন্ত্রী নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে সংবাদমাধ্যমকে কার্যত ঘুরিয়ে প্রকাশ্যে ব্ল্যাকমেল করে ফেললেন!

এটাই কি সেই “একধরণের ব্ল্যাকমেলিং পলিটিক্স!

সংবাদমাধ্যমকে কব্জা করে তাদের দিয়ে পজিটিভ শাসক বন্দনা! খেলা হবের খেলা।

এর জবাব যেমন মুখ্যমন্ত্রীকে দিতে হবে বলে আমরা মনে করছি, ঠিক তেমনই বাংলা সংবাদমাধ্যমও পাঠক/শ্রোতাদের কাছে এই প্রশ্নের জবাবদিহি করতে বাধ্য।

এক বাঙালি কবি নিজের খেয়ালে লিখে ফেলেছিলেন ‘কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’।

আমাদের সংবাদমাধ্যম এবং তাঁদের ‘চোখে চোখ রেখে কথা বলা’ ‘ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পাওয়া’ ‘এগিয়ে থাকা এগিয়ে রাখা’ সাংবাদিককুল ঠিক কিসের জন্য মেরুদন্ডকে তাচ্ছিল্য করলেন জানতে চায় বাংলা।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস