ভাগের মা / The Native Curzons Of Bengal

রাখীবন্ধনের দিন যখন রাজ্য বিজেপির মহিলা নেতৃত্বরা পুলিশদেরকে রাখী পরাতে পথে নামেন, তখন সারাদিন ধরে পুলিশকর্মীদের সাথে তাঁদের একটা অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা চলে। পুলিশকর্মীরা কিছুতেই বিজেপির মহিলা নেতৃত্বের হাতে রাখী পরবেন না, যাতে শাসকদলের গুডবুকে থাকা যায়। আর লকেট-অগ্নিমিত্রারা এনাদেরকে রাখী পরাবেনই! আর এই টানাপড়েনই সারাদিন ধরে দেখাবে বলে শহরের রাজপথে মিডিয়ার ক্যামেরা-বুম হুলুস্থুলু বাঁধিয়ে দেয়।

আমাদের ধারণা, লকেট-অগ্নিমিত্রারা বিলক্ষণ জানেন, রাস্তায় নেমে রবি ঠাকুরের রাখীবন্ধন উৎসব পালনের কথা। কারণ “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতি মেনে ব্রিটিশ ভাইসরয় লড কার্জনের ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে জোড়াসাঁকোর দেবেন ঠাকুরের ছেলে মহানগরের রাস্তায় পায়ে হেঁটে রাখীবন্ধন উৎসব পালন করে সেসময়কার বঙ্গীয় সমাজে যে পরিমাণ আলোড়ন ফেলেছিলেন, তা বাঙ্গালীমাত্র সবাই জানেন। ঠাকুরবাড়ির কেউ ছ্যাকরা গাড়ি ছেড়ে মহানগরের রাস্তায় মানুষের সাথে পা মিলিয়ে পথ হাঁটবে এমনটা সেসময় কল্পনা করাও ছিল যথেষ্ট দুষ্কর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন। তিনি এদ্দিন ধরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভাই-বোনের সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে উপলক্ষ করে পালিত হওয়া রাখী বন্ধনের রেওয়াজকে হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্প্রীতি উৎসবে পরিণত করেছিলেন। পরস্পরের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ দূরে সরিয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সেদিন একত্রিত হয়ে বাঙালী হতে পেরেছিল।

এখন আপনাদের মনে হতেই পারে রাখী বন্ধন তো অনেক দেরী! সেই আগস্ট মাসে। তাহলে হঠাৎ কেন এই অসময় স্মৃতিচারণ! রাইজ অফ ভয়েসেস কি মাস-তারিখ গুলিয়ে ফেলল! উত্তরে জানাই, মোটেই না। আমরা বরং যারা বাংলার বা বাঙালীর সেই গর্বের ইতিহাস গুলিয়ে দিতে পথে নেমেছে তাদেরকে এবং তাদের থেকে জনসাধারণকে সাবধান করতে এসেছি। এনাদেরকে ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট বলে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছি না। বরং গলা তুলে বলতে চাই এরা আদৌ ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট না, বরং বলা যায় এরা ফিক্সড এলিমেন্ট। রাজনীতির সওদাগর। ভোট ব্যাঙ্ক আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য এরা ধর্মীয় উস্কানি কিম্বা বাংলা ভাগ কোনটাতে মদত দিতেই পিছপা নন। এসবের উদাহরণ রয়েছে ভুড়িভুড়ি।

আসুন পিছিয়ে যাই বছর কুড়ি। ২০০১ সাল। সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। তৈরি হয় বাংলা বাঁচাও ফ্রন্ট। নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জোটে তাঁর অন্যতম সহযোগী বিজেপি। তখন বাজপেয়ী/আদবানি/মুরলিমনোহরের জমানা চলছে বিজেপিতে। বাংলায় তাঁদের দূর্গা মমতা। আর সেই ফ্রন্টেই কিনা কামতাপুর পিপলস পার্টি, যারা কোচবিহারের রাজবংশী সম্প্রদায়দের জন্য বাংলা ভেঙ্গে আলাদা কোচবিহার রাজ্য চায়! স্লোগান উঠেছিল “উত্তরে কামতা/দক্ষিণে মমতা”। এই কেপিপি হল আদতে কেএলও বা কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন নামক সশস্ত্র জঙ্গি বাহিনীর রাজনৈতিক মুখ। বাম আমলে এদের কাজ ছিল পৃথকরাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের নামে মূলতঃ উত্তরবঙ্গের বামপন্থী নেতা কর্মীদের হত্যা করা। আর কে না জানে “শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু”, ফলে বছর কুড়ি আগেই তৃণমূল-বিজেপি-কেপিপি-কেএলও বাংলা বাঁচানোর ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলিয়ে ক্ষমতার মোহে একে অপরের হাত ধরে ফেলেছিল। আর আমরা বুঝেছিলাম এই স্বাধীন ভারতেও কিছু দিশি “লর্ড কার্জন” এখনও আছেন, যাঁরা মসনদে বসবার মনস্কামনায় বাংলাকে ভেঙ্গে টুকরো করতে চায়, যারা তাদের হাত ধরেন।

কাজেই আজ যখন কেএলও নেতা জীবন সিংহ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হুমকি দেন এবং প্রত্যুত্তরে তিনি হুঙ্কার ছাড়েন বাংলার জন্য তিনি নাকি রক্ত দিতে প্রস্তুত, তখন ২০০১ সালে এই মমতাদেবীর নেতৃত্বে তৈরি ঘাসফুল-পদ্মফুলের বাংলা বাঁচাও ফ্রন্ট যে আদতে বাংলার ভাগের বিপদ ডেকে এনেছিল বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় কি!

কিন্তু আজও বাংলাভাগকারী এই শক্তির সাথে তৃণমূল-বিজেপির এমন সখ্যতা হৃদ্যতা কি আদৌ ঘুচেছে! এই কুড়ি বছরে সেই বন্ধুত্বে কি আদৌ কোন রদবদল এসেছে! না। কোনটাই হয়নি। যদিও খাতায় কলমে এই মুহুর্তে রাজ্যে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। প্রথমজন ক্ষমতায় এবং দ্বিতীয়জন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু তাদের কামতাপুর প্রীতি আজও অটুট!

এ প্রসঙ্গে জানাই, কুড়ি বছর আগেকার সেই কেপিপি ভাঙন, পুনর্গঠন, সংযুক্তিকরণ ইত্যাদি নানাবিবিধ ক্ষমতা কেন্দ্রিক প্রবাহমানতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ মূলতঃ দু তিনটি দল এবং উপদলে বিভক্ত, যাদের মূল উদ্দেশ্য রাজবংশী ভাষাভাষীদের জন্য বাংলা ভেঙ্গে কামতাপুর নামক আলাদা ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন। এমনই একটি গোষ্ঠী হল গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন যার নেতা হলেন বংশীবদন বর্মন। আর আরেকটি গোষ্ঠী হল কামতাপুর প্রোগ্রেসিভ পার্টি যার নেতা হলেন অতুল রায়। এঁরা দুজনেই বর্তমানে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ। বংশীবদন এবং অতুল দু’জনেই রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কমিটি বা বোর্ডে রয়েছেন। বংশীবদন রাজ্যের রাজবংশী উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি এবং রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমিতে রয়েছেন। অতুল কামতাপুরী ভাষা অ্যাকাডেমির সহ সভাপতি। এছাড়াও এঁদের বাইরে রয়েছে আরেকটি গোষ্ঠী। যার নেতা অনন্ত মহারাজ। এনারও দাবী বাংলা ভেঙ্গে পৃথকরাজ্য। ইনি নিজেকে কোচ রাজবংশের বংশধর হিসাবে দাবী করে থাকেন। এনার সাথে আবার বিজেপির ওপর মহলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আপাতত ইনি বাংলা থেকে ‘বিতাড়িত’ হয়ে বিজেপি শাসিত আসামের বাসিন্দা। ইনি নরেন্দ্র মোদীকে সহযোগী মানেন। তাই এনার সাথে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে এসে একান্তে প্রাতঃরাশ করে গেছেন। এমনকি ইনি উত্তরবঙ্গে বিজেপির সভায় অনুগামীদের পাঠিয়ে ভিড় জমাতেও সাহায্য করেন বলে জানা যায়। মাঝেমধ্যে বিজেপির সভামঞ্চে নিজে সশরীরে উপস্থিতও থাকেন। মানে সোজা কথায় কামতাপুরীদের সাথে ভাজপা এবং মমতা উভয়েরই যাকে বলে লতায়-পাতায় সম্পর্ক।

আর বাংলা ভেঙ্গে “গোর্খাল্যান্ড” গঠনের মদতদাতা নেতারা মানে গুরুং-তামাং রা এতবার ঘরবদল করেছেন, যে এই মুহুর্তে তাঁরা তৃণমূল না বিজেপি কার সাথে আছেন, নিশ্চিত করে বলা যায় না। একমাত্র শিয়রে ভোট এলে এনাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়। যেমন ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার গঠনের শুরুর সময় থেকে এনারা ছিলেন তৃণমুলের সাথে। মাঝখানে ২০১৭ সালে মান-অভিমান ঘাত-প্রতিঘাতে বিদ্ধ হয়ে ফের পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবীতে সোচ্চার হন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট আসতেই ঝুঁকে পড়েন বিজেপির দিকে। কিন্তু ২০২০ সালের শেষদিকে মানে গত বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে আগে বিজেপি ছেড়ে ফের চলে আসেন তৃণমুলের ঘরে। সেই থেকে আপাতত চুপ আছেন। ২০২৪ এর লোকসভা ভোট আসা পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে এনাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।

কিন্তু ইতিমধ্যে বিগত বছর খানেক হল শুরু হয়ে গেছে নতুন উৎপাত। হঠাৎই রাজ্য বিজেপির মধ্যে থেকেই উঠতে শুরু করেছে পৃথক রাজ্যের দাবি। বিজেপির টিকিটে নির্বাচিত সাংসদ-বিধায়করা মাঝেমধ্যেই বাংলা ভাগের কথা বলতে শুরু করেছেন। কেউ চাইছেন উত্তরবঙ্গ ভেঙ্গে আলাদা রাজ্য, কেউ চাইছেন জঙ্গলমহলকে বাংলা থেকে আলাদা করে পৃথক রাজ্য। সৌজন্যে জন বার্লা, জয়ন্ত রায়, সৌমিত্র খাঁ’দের মত কিছু জনপ্রতিনিধি। তাতে প্রচ্ছন্ন মদত জুগিয়ে গেছেন রাজ্য বিজেপির একটা বড় অংশ। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বিজেপির তরফে উত্তরবঙ্গে কি ধরণের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন এব্যাপারে মতামত চেয়ে উত্তরবঙ্গের নির্বাচিত বিজেপির সাংসদ ও বিধায়কদের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। এমনকি সেই একই চিঠি পাঠানো হয়েছে জীবন সিংহ, বিমল গুরুং ও অনন্ত মহারাজদের মত বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের কাছেও। আর অনেকটা এই কারণেই বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে লকেট-অগ্নিমিত্রাদের রাখী হাতে রাস্তায় দেখা যায় না।
সম্প্রতি অবশ্য নাড্ডা সাহেব যিনি একসময় গুরুং গ্যাং-কে পারিবারিক অনুষ্ঠানে পাত পেরে খাইয়েছিলেন তিনি আপাতত এই সমস্ত দলীয় লর্ড কার্জনদের বাংলা ভাগ নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারছি। যদিও তারপরেও কার্সিয়াং বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক এসব নিষেধাজ্ঞা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। আসলে ভোট অতি বিষম বস্তু। ২০২৪ লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে বাংলার লর্ড কার্জনরা সবাই একে একে আবার সক্রিয় হবেন। আবার ভোট কুড়োবার জন্য জাতিসত্তার ধোঁয়া তুলে বাংলা ও বাঙালীকে ভাগ করবার চেষ্টা হবে। ভোটের জন্য রাজনীতির সওদাগররা কার্জনদের সাথে প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষ জোট বাঁধবেন । ভাড়া করা মিডিয়া এই জোটগুলোকে এক একটা মাস্টারস্ট্রোক বলে প্রচার করবে। আর আমরা অনেকে সেটাই বিশ্বাস করব। চাণক্য খুঁজবো।

কিন্তু এরাই যে আদতে আসল “টুকরে টুকরে গ্যাং” সেটা কি আমরা বুঝতে পারবো! জোটবেঁধে এই রাজ্য ভাগাভাগির রাজনীতি কি আদৌ রুখতে পারবো!

আর সবশেষে, যারা রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্য এবং অনুন্নয়নের কথা বলে পরোক্ষে বাংলা ভাগের খেলায় মদত যোগাবার চেষ্টা করবেন তাদের জানিয়ে রাখি আমাদের দেশের কম বেশি দুই তৃতীয়াংশ মানুষ আজও দারিদ্রের শিকার। তাদেরকে রুটি-রুজি ভাত কাপড়ের অনিশ্চয়তার মধ্যেই এখনও প্রতিটা দিন কাটাতে হয়। শিক্ষা-স্বাস্থ্যর মত ন্যুনতম সরকারী পরিষেবা তাদের কাছে অমিল। তা এই বৃহৎ জনসংখ্যার দেশবাসী যদি দেশের মধ্যেই নিজের নিজের রাজ্য থেকে বেরিয়ে আলাদা আলাদা রাজ্য গঠন করতে শুরু করে তাহলে দেশটার সার্বভৌমত্ব বলে কি আদৌ কিছু অবশিষ্ট থাকবে! তখন আবার রাষ্ট্রদ্রোহী/রাজদ্রোহী বলে এদেরকে গাল পাড়বেন না তো!

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://indianexpress.com/article/lifestyle/art-and-culture/how-rabindranath-tagore-used-raksha-bandhan-as-means-to-prevent-1905-bengal-partition-4785042/
b) https://bengali.indianexpress.com/west-bengal/history-and-significance-of-rakshabandhan/
c) https://en.wikipedia.org/wiki/Bangla_Bachao_Front
d) https://en.wikipedia.org/wiki/Kamtapur_People%27s_Party
e) https://www.telegraphindia.com/west-bengal/kamtapur-liberation-organisation-leader-releases-video-with-statehood-demand/cid/1819073
f) https://www.anandabazar.com/west-bengal/gcpa-and-kpp-allied-for-bigger-protest-to-fulfill-their-demand-1.1027423
g) https://newslivetv.com/amit-shah-meets-cooch-behar-royal-family-descendant-anant-rai-in-assam/
h) https://www.thehindu.com/news/national/other-states/shah-may-meet-exiled-bengal-leader-in-assam/article33805524.ece
i) https://www.anandabazar.com/west-bengal/bjp-mla-bishnu-prasad-sharma-again-vocal-for-separate-state-dgtl/cid/1349715
j) https://www.anandabazar.com/west-bengal/jp-nadda-massage-to-state-bjp-not-to-demand-partition-of-bengal/cid/1349608
k) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-06-11/202206102148432.jpg&category=0&date=2022-06-11&button=