বাংলাভাষী = বাংলাদেশী – একটি গৈরিক সমীকরণ / Alas! Bengali
এনআরসি পরবর্তী পরিস্থিতি, রাজ্যে রাজ্যে :

কেন্দ্রের সরকারের প্রযোজনা ও প্ররোচনায় দেশের নানাপ্রান্তে বাঙালি নিপীড়ন চলছে। তার পেশা, বাসস্থান, নাগরিক অধিকার সংকটে। সৌজন্যে এনআরসি।

এনআরসি কি, কেন, কতটা প্রহসন কতটা প্রয়োজন, এগুলো আলাদা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। এখানে এটুকু শুধু উল্লেখ থাক, আসামে ১২ লক্ষ বাংলাভাষী মানুষ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের কাছে অনাগরিক হয়ে গেছে। আরেকটু সংযোজন – এই বাতিলেরা যথেষ্ট বৈধ কাগজপত্র রাখেন। সামাজিক সমীক্ষাগুলো, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এদের অনেকেই ১৯৭১ সাল কেন ‘৪৭ এর আগে থেকে ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা। অনেকেই দেশের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বা অবসর নিয়েছেন।

আসাম

সংকটের শুরু দেশের সব সমস্যার মূল হিসাবে অনুপ্রবেশকে দায়ী করা দিয়ে। এর সাথে জুড়ে ফেলা হয় মৌলবাদী সন্ত্রাস, বিদেশ থেকে জাল নোটের আগমনের মতো বিষয়গুলোকে। পুরো প্রোডাক্ট তৈরী হওয়ার পর তা মুড়ে ফেলা হয়েছে ইসলামোফোবিয়ার মোড়কে। মোড়ক ছাড়ালে ভেতরের যে মূল ইনগ্রেডিয়েন্ট পাওয়া যাবে তা স্রেফ বাংলাভাষী মানুষজন। বাঙালি। তাকে পিষে পিটিয়েই তৈরী হচ্ছে দেশপ্রেমের নতুন ক্যান্ডি। জনপ্রিয় হচ্ছে প্রোডাক্ট। দেশজুড়ে মোড়ক খোলা হচ্ছে। চুষে চিবিয়ে নিশ্চিন্ত আরাম পৌঁছে যাচ্ছে মগজে মগজে – এ দেশে অনুপ্রবেশ করে শুধুই বাঙালিরা = বাংলাদেশিরা।

অথচ দেশের পাঁচটি রাজ্য বাদে বাকি সবকটাই কোনো না কোনো আন্তর্জাতিক সীমানা ছুঁয়ে আছে অথবা উপকূলবর্তী। অনুপ্রবেশের ব্যাপক সুযোগ চীন, পাকিস্তান, ভুটান, আফগানিস্তান, নেপাল থেকে; বাংলাদেশ থেকেও। তবু কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে অনুপ্রবেশকারী মুসলমান, বাংলাদেশী মুসলমান, বকলমে সমস্ত বাংলাভাষী; যারা নাকি পশ্চিমবাংলা ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যে ঘাপটি মেরে ডেরা বেঁধে রয়েছে।

দেশে অনুপ্রবেশের মাধ্যকে দেশকে ‘অন্দর সে খোকলা’ করে দেওয়ার দায়টা শুধুমাত্র বাঙালির ওপর এসে পড়া মাত্র মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কর্ণাটক – সর্বত্র চলছে অনুপ্রবেশকারি বাঙালি চিহ্নিতকরণ, হেনস্থা, উচ্ছেদ, ব্যবসা তথা জীবনজীবিকার উপর আক্রমণ, জেল জরিমানা। অধিকটাই সিভিলিয়ান উদ্যোগে, কেন্দ্র ও রাজ্যের একই শাসকদলের আন্তরিক সহযোগিতায়। কোথাও সরাসরি সরকারি উদ্যোগে।

জাহাঙ্গীরপুরী, দিল্লী

কাছাকাছি সময়ে দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরী বস্তি উচ্ছেদের ঘটনাটাই দেখা যাক। জোর করে উস্কে খেপিয়ে একটা ধর্মীয় বিবাদ খাড়া করা হলো। ওখানে অঢেল ঘুসপেটিয়া বাংলাদেশী রয়েছে, তারাই ‘আনরেস্ট’ তৈরী করছে – এই মতে একমত হয়ে আপ সরকার ও স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের যৌথ প্রযোজনায় চলল বুলডোজার। ভাঙা হল প্রাচীন দোকানপাট, কবেকার বসতবাড়ি। একটা নেকু নেকু সাফাই বাংলায় বসে কেউ কেউ দিচ্ছেন যে ওখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই তো পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব সীমানাবর্তী জেলাগুলোর বাসিন্দা, লব্জে বাংলাদেশের সাথে তেমন একটা ফারাক নেই, তাই … ভুল করে … । না; ব্যাপারটা এমন সরল কিছু নয়. আর জাহাঙ্গীরপুরীর বাসিন্দারাও আজকের বাসিন্দা নয়। গত শতকের সাতের দশকে বাংলার খাদ্যাভাবের সাথে যুঝতে না পেরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক চাষি পরিবারগুলো দিল্লি পাড়ি জমিয়েছিল। বসতি গেড়েছিলো যমুনাতীরে। যমুনাতীরের সৌন্দর্য্য অক্ষুন্ন রাখতে ইন্দিরা গান্ধী তাদের ওখান থেকে সরিয়ে পুনর্বাসন দেন জাহাঙ্গীরপুরী, সীমাপুরি, ত্রিলোকপুরী অঞ্চলগুলোয়। এসব অবশ্যই জানে তাদের অনেকদিনকার প্রতিবেশী আক্রমণকারীরা। মানুষগুলো পঞ্চাশ বছর ধরে ওখানে গায়ে খেটে রোজগার করেছে; তিলেতিলে সঞ্চয় করে নিজের ব্যবসা দিয়েছে। কেউ কেউ একটু প্রতিষ্ঠিত হয়ে গ্রামের বেকার আত্মীয়টিকে ডেকে নিয়ে ওখানেই একটা ডেরা একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। এখন আচমকাই তারা ভারতবর্ষে ঘুসপেটিয়া। পঞ্চাশ বছরের পুরোনো প্রতিবেশী আঙ্গুল তুলে বলছে সেটাই। প্রমান, তার বাংলা জুবান। তার মাতৃভাষা, বাংলা।

এমন বদল, এমন অভূতপূর্ব আক্রমণ নেমে এসেছে কর্ণাটকেও। বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য্য সেখান এনআরসি চায়। ওখানে ওদের আক্রমণের লক্ষ্য সেইসব বাঙালি যারা গৃহভৃত্যের কাজ করে এপার্টমেন্টগুলোতে; যারা ট্যাক্সি চালায়, হকারি করে, কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার, ময়লা কুড়ানি বা ঠিকা শ্রমিক। ২০১৮ তে আসামে এনআরসি’র রব ওঠামাত্র কর্ণাটকেও অনুরণন ওঠে। বেঙ্গালুরুর কোথাও ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের’ কাজে না রাখার নোটিশ জারি হয়ে যায়। হোয়াইট ফিল্ড, ইলেক্ট্রনিক সিটি, আউটার রিং রোডের বহুতলগুলোর গেটে গেটে পুলিশ হানা দিতে থাকে। উদ্দেশ্য, বাংলাভাষী গৃহভৃত্য পাকড়াও করা। তারপর থানায় তুলে নিয়ে হ্যারাসমেন্ট, টাকা আদায়। অনেক এপার্টমেন্টে দেশভক্তদের গ্যাং তৈরী হয়ে যায়। সোশ্যাল পুলিশিং শুরু করে তারা পুলিশকে সাহায্য করার অছিলায়। স্থানীয় বিজেপি এমএলএ অরবিন্দ লিম্বাভালি’র ছত্রছায়ায় হতে থাকে এসব।

বেঙ্গালুরু

বেঙ্গালুরু মিউনিসিপ্যালিটি (বিবিএমপি)’তে হাতে করে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার কাজটা মূলত করত বাঙালি ঠিক শ্রমিকরা। তাদের একদলের চাকরি গেছে। বাকিদের বিবিএমপি র ঠিকাদার রা অর্ধেক মাইনে দিচ্ছে। প্রতিবাদের উপায় নেই; সামান্য ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলেই পুলিশ দিয়ে তুলিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো থাকে। এই করে বেঙ্গালুরুর একাধিক গরিব বাঙালি বস্তি এখন জনশূন্য।

থুবড়াহাল্লি বেঙ্গালুরু থেকে অনেকদূরের এক প্রান্তিক গ্রাম। বাঙালি গ্রাম বলা হয়। প্রায় ১২০০০ বাঙালির বাস। এদ্দিন কোনো ঝামেলা ছিল না। ২০১৮ র পর থেকে চলছে সীমাহীন পুলিশি অত্যাচার। যখন তখন পুলিশি হামলা। পুরুষদের একজায়গায় জড়ো করে নিম্নাঙ্গের বস্ত্র খুলিয়ে ধর্ম নির্ণয়। বারবার কাগজ চাওয়া। বিনা রশিদে আইডেন্টিটি প্রুফ বাজেয়াপ্ত করা। আবার সেই প্রুফ না থাকার অছিলায় তার থেকেই টাকা আদায়।

মেঘালয়

দিল্লি কর্নাটকে যখন এনআরসি ইন্ধন যোগাচ্ছে বাঙালি হেনস্থায়, তখন মেঘালয়ে ঘন মেঘ হয়ে ছেয়েছে সিএএ ভীতি। এখানকার খাসি জনজাতির মানুষ ভয় পাচ্ছে সিএএ হলে বাঙালিদের কাছে জমিজমা রুজি হারাবে বুঝি তারা। অন্ততঃ এইরকমই একটা হাওয়া তুলে খাসি ছাত্র ইউনিয়ন (কেএসইউ) স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নেমেছে বাঙালি তথা বাংলাদেশী ঘুসপেটিয়া অন্বেষণে ও তাদের জমিজমা সম্পত্তি দখলে। মেঘালয়ের ইছামতি অঞ্চল চুনাপাথরের খাদানভরা। অনেক খাদান মালিক বাঙালি। তারা বাধ্য হচ্ছে স্থানীয়দের হাতে খাদান ছেড়ে দিতে। সর্বত্র পোষ্টার পড়ছে ‘মেঘালয়ের বাঙালিরা সবাই বাংলাদেশী’। স্থানীয় বাঙালিদের পড়তে হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রতিরোধের মুখে। আসামের বাঙালির প্রিয় ভ্রমণের জায়গা পাশের বৃষ্টিরাজ্য মেঘালয়। পাহমাওলিন, ২০ মাইল, রি-ভয় জেলাগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়েছে কেএসইউ। বাংলাভাষী বা আসামি-বাঙালি ট্যুরিস্ট দেখলেই গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করছে, ফিরে যেতে বাধ্য করছে। আরেক জঙ্গি সংগঠন হাইনিট্র্যাপ ন্যাশনাল লিবারেশন কাউন্সিল ২০২০ সালে সভা করে সিদ্ধান্ত জানায় – সব বাঙালিকে ইছামতি ও মাজাই অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে বইবে রক্তগঙ্গা। তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক (বর্তমানে জম্মু কাশ্মীরে ‘কর্মরত’) বা বিজেপির কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট কেউই এসব জঙ্গিপনা ও বেআইনি কার্যকলাপের নিন্দা সমালোচনা করেনি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দূর অস্ত।

ত্রিপুরা

ত্রিপুরায় চলছে লড়িয়ে দেওয়ার খেলা। মিজোরাম থেকে গোষ্ঠীদ্বন্ধে উৎখাত হওয়া ব্রু উপজাতির ৩৫০০০ লোক ত্রিপুরা সীমানায় উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছিলো। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে কেন্দ্র আচমকাই ব্রু সমস্যা সমাধানে যত্নবান হয়ে ওঠে। ১৯শে জানুয়ারি কেন্দ্র, ত্রিপুরা ও আসামের সরকারের সাথে (অমিত শাহের উপস্থিতিতে) ব্রু উপজাতি সংগঠনের একটি চুক্তি হয়। সাব্যস্ত হয় ব্রু রা ত্রিপুরার অভ্যন্তরে পুনর্বাসন পাবে। এরপর ওই ৩৫০০০ ব্রু কে বেছে বেছে বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় পুনর্বাসন দেয়া হতে থাকে। বাধে অবধারিত সংঘাত। সম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত বাঙালিদের বাড়িঘর দোকানপাট লুঠ হতে থাকে সহায়সম্বলহীন ব্রু দের হাতে। অন্ততঃ ৩০০০ বাঙালি ঘরছাড়া হয়। একজোট হয়ে যারা প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হচ্ছে, বিজেপি গভর্নমেন্ট তাদেরই উপর নামিয়ে আনছে শাস্তির খাঁড়া। বাড়িঘরে পুলিশ দিয়ে হামলা চালাচ্ছে। ১০ই ডিসেম্বর ২০১৯, একটা প্রতিবাদসভায় পুলিশি গুলিচালনায় একজন আন্দোলনকারী মারাও গিয়েছিলেন।

দেশভাগের সময়

‘৪৭ এর দেশভাগে উদ্বাস্তু হয়েছে বাঙালি। তারপর বারবার উদ্বাস্তু হয়েছে স্বাধীন ভারতে। গোষ্ঠীগতভাবে আক্রান্ত হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে দেশের ভেতরেই। আসামে ১৯৬০ এ বঙ্গাল খেদা, গোরেশ্বর গণহত্যা; ‘৮০ র দশকে খয়রাবাড়ি, সিলাপাথর, নেলীর গণহত্যা। ত্রিপুরায় মান্দাই গণহত্যা। আলাদা আলাদা প্রেক্ষিতে ঘটে গেছে এসব। কিন্তু কখনো এরকম সাধারণ ষড়যন্ত্র, এরকম কেন্দ্রীয় প্রযোজনায় ঘুসপেটিয়া অনুসন্ধানের নামে দেশজুড়ে শ্রমজীবী থেকে ব্যবসায়ী, বাঙালিমাত্রেরই জীবনজীবিকা বাসস্থান বিপন্ন করার চেষ্টা হয়নি।

যেটুকু যা প্রতিরোধ :

তা এতো কিছু হয়ে চলেছে, পশ্চিমবাংলার শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এমন নীরব নিশ্চেতন নিরুদ্বিগ্ন কেন? সমস্তকিছু এতো প্রতিরোধ প্রতিবাদহীন কেন? প্রথম প্রশ্নটায় পরে আসছি। দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তরে বলা যায়, না, একবারে নিস্প্রতিবাদে এসব মেনে নেয়নি আক্রান্তরা। জাতিসত্ত্বা ভাষাসত্ত্বা চেতনায় মিলেমিশে একাকার যাদের, তারাও গড়েছে প্রতিরোধ।

অন্ততঃ দুটো বাঙালি মিলিট্যান্ট গ্রূপের অস্তিত্ব জানা যায়। একটা ত্রিপুরা ভিত্তিক আরেকটা মেঘালয়ের। ত্রিপুরায় কাজ করছে ইউনাইটেড বেঙ্গলি লিবারেশন ফ্রন্ট (ইউবিএলএফ) সেই ‘৯৫ সাল থেকে। মেঘালয়ের টা আরো পুরোনো, ‘৭৯ সালে তৈরী। ইউনাইটেড বেঙ্গলি লিবারেশন আর্মি। এদের মিলিটারি ফ্র্যাকশনটার নাম ‘বঙ্গসেনা’।

মূলধারার একটি রাজনৈতিক দল রয়েছে। ত্রিপুরায়। প্রভাত রঞ্জন সরকারের তৈরী দলটার নাম ‘আমরা বাঙালি’ । এরা এখনো টিকে আছে কয়েকটা পঞ্চায়েতে। ‘৮০ র দশকে ত্রিপুরা বিধানসভায় সিটও পেয়েছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালিদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে এদের যথেষ্ট ভূমিকা আছে।

এর বাইরে রয়েছে কতগুলো ছোট ছোট অরাজনৈতিক বা বলা ভালো ভোটে দাঁড়ায় না এরকম দল বা গোষ্ঠী। এদের মধ্যে ‘বাংলাপক্ষ’ বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। আইএসআই’এর শিক্ষক গর্গ চ্যাটার্জি’র তৈরী এই দলটা রাজ্যের সব সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা বা রাজ্যের সব সংস্থায় বাঙালি কর্মীর অনুপাত বাড়ানোর জন্য লড়ছে বললে কম করে বলা হবে। ত্রিপুরায় ব্রু বসতি তৈরির ফলে বাঙালির বিপন্নতার প্রতিবাদে কাঞ্চনপুর নাগরিক সুরক্ষামঞ্চ র সাথে জোট বেঁধে আন্দোলনে নেমেছে এরা। একবার তো ৩০০০০ মানুষের জমায়েত খাড়া করেছিল এই ইস্যুতে।

বাংলাপক্ষ থেকেই একটা অংশ আলাদা হয়ে তৈরী করেছে জাতীয় বাংলা সম্মেলন। রবীন্দ্র সরোবর ও সুভাষ সরোবর এ ছটপূজোয় পরিবেশ দূষণ হয়, এই মর্মে মামলা ঠোকে তারা গতবছর। আদালত দুই জায়গাতেই ছটপুজো বন্ধের নির্দেশ দেয়। যদিও রাজ্য সরকার অবাঙালি ভোট ব্যাংকের দিকে নজর রেখে কোর্টের রায় অগ্রাহ্য করে দুটো সরোবরই ছটপুজোর জন্য খুলে দেয়।

এদের বাইরে রয়েছে আরো কিছু স্থানীয় মঞ্চ। বাংলাভাষা বাঁচাও কমিটি। বাংলা ঐক্য মঞ্চ। বাংলাভাষা বাঁচাও সমিতি। জনজাগরণ মঞ্চ।

স্থায়ী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মত বলশালী নয় এরা কেউই। প্রত্যেকেরই কিছু জনভিত্তি থাকলেও পুরো বিষয়টি জনগণের, বাঙালির সমক্ষে এনে প্রধান ইস্যু হিসাবে উপস্থিত করে সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তোলা এদের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব কোনো মূলধারার বড় রাজনৈতিক দল ইস্যুটিকে গ্রহণ করলে। করেছে কি? সবচেয়ে বড় বিরোধী দল কংগ্রেস কখনোই করেনি বা করবে না। একে তো ‘৪৭ সালের পর কোনো সামাজিক বা গণআন্দোলন তাদের হাতে গড়ে ওঠেনি, বরং বহু গণআন্দোলনের তারাই ছিল প্রতিপক্ষ। আর বিজেপির আগে তারাই ছিল হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান এর দুর্বল সংবাহক। বাংলা কংগ্রেস আলাদা কিছু নয়। শক্তিশালী তো নয়ই। তৃণমূল কংগ্রেস? সাম্প্রতিক অতীতে ‘ছিছিক্যাক্যা’ জাতীয় কিছু ডাডাইস্ট উক্তি ছাড়া সিএএ এনআরসি নিয়ে আর কিছুই করতে তাদের দেখা যায়নি তাদের। বিস্তৃত বক্তব্যও কখনো পাওয়া যায়নি। সুদূর অতীতে, বাজপেয়ী সরকারের আমলে মমতা অনুপ্রবেশ বিরোধী যেসব কথা বলেছিলেন তার সাথে অসমের বাঙালি বিরোধী গোষ্ঠীর বক্তব্যের কয়েকচুলের বেশি পার্থক্য নেই। তাছাড়াও এরকম একটা গভীর সমাজতাত্ত্বিক বিষয় কে, আজীবন ঘোলাজলে মাছধরার রাজনীতি করা দলটি ট্যাকেল করতে পারবে, এটা ভাবা মুশকিল। সিপিআইএম কিন্তু বিষয়টিতে বারবার প্রবেশ করেছে।

মহম্মদ সেলিম

কোর্ট অর্ডার হাতে জাহাঙ্গীরপুরী র বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বৃন্দা কারাত। অনলাইনে ক্যাম্পেনিং চলছে # স্টপ বুলডোজিং ইন্ডিয়া। পশ্চিমবঙ্গের সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম একাধিক বিবৃতি দিয়েছেন দিল্লির ঘটনার প্রেক্ষিতে। অতীতে আর একবারই পূর্ণ সময়ের জন্য ক্ষমতায় এসেছিলো বিজেপি। ১৯৯৯-২০০৪। এই টার্মের সময়েও তাদের বাঙালি বিদ্বেষ যেখানে যেখানে সম্ভব প্রকট হয়েছে। আসাম, ত্রিপুরা বা মেঘালয়ের ধিকি ধিকি বাঙালি বিদ্বেষের আগুনে ঘি দেয়ার মত বিস্তৃতি তখনও অর্জিত হয়নি। নিজেদের সাংস্কৃতিক রাজধানীতে চালিয়েছিল বাঙালি নিপীড়ন। উত্তরপ্রদেশের গৌতমবুদ্ধ নগর পুলিশ স্টেশনের নয়ডায় বাস করা হাজার হাজার বাঙালির জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিলো। তারা এমনই হয়ে পড়েছিল ঘুসপেটিয়া। একইভাবে চলেছিল উলঙ্গ করে ধর্ম নির্ধারণ, মারধর, পুলিশি হেনস্থা, এরেস্ট, টাকাকড়ি কাগজ সব কেড়ে নেয়া। পুলিশি রিপোর্টে হিন্দু নামের সাথে ইসলামিক উপাধি যোগ করে বাংলাদেশী প্রমান করা। আর তখন সংসদের ভেতরে থাকা সিপিআইএম প্রতিবাদ করেছিল। হান্নান মোল্লা চিঠি লেখেন লোকসভার স্পিকারকে। সোমনাথ মুখোপাধ্যায় প্রতিবাদপত্র পাঠান তৎকালীন হোম মিনিস্টার এলকে আডবাণী’কে।

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

তা এটিকে প্রধান একটি রাজনৈতিক ইস্যু করল না কেন সিপিআইএম? কেন আরো ব্যাপক প্রচার ও প্রতিরোধের দিকে এগোলো না? উত্তর টি প্রথম করা প্রশ্নটির উত্তরের মধ্যেই আছে।

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশ এমন নীরব নিরুদ্বিগ্ন কেন?

মূলত আক্রান্তদের শ্রেণী চরিত্রের কারণে। উত্তর বা দক্ষিণ ভারতে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে যে বাঙালির ওপর আক্রমণ নেমে আসছে, তারা প্রান্তিক বাংলা আসাম ত্রিপুরা থেকে যাওয়া কায়িক শ্রম করা ‘নিচু কাজ করা’ মানুষ। মুসলমান, শূদ্র, নমশূদ্র সম্প্রদায়ের লোক। বাঙালি বর্ণাশ্রম বিশেষ না মানলেও একটি শ্রেণীভেদ কঠোরভাবে মানে। ভদ্রলোক আর ছোটোলোক। ভদ্রলোকের বাড়ির কাজের লোকের পরিযায়ী শ্রমিক ছেলে বা মেয়েটির সমস্যা তার কাছে গোষ্ঠীগত সমস্যা নয়। মার খাওয়া ছোটোলোকগুলোর বিপ্রতীপে তার ঘরের পরিযায়ী শ্রমিকটি স্কিলড, হোয়াইট কলার। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করছে না ঘুসপেটিয়া সন্ধানীরা। ব্যাস সংবাদপত্রে মিডিয়ায় মতামত জাহির করা, সেমিনার করা বাঙালি নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত। হালকা পাতলা সান্ধ্য লিকার চায়ের মতো সাবলাইম কিছু প্রতিবাদেই সাফ বিবেক। নিজে পশ্চিমবাংলার নিরাপত্তায় বসে আগেও সে বঙ্গাল খেদা, নেলীর গণহত্যা র কথা জেনেছে। জেনেছে উত্তরপূর্বে বাঙালির বাস্তুচ্যুতি বিপন্নতা গণহারে নিহত হওয়ার কথা। সেখানে ভদ্রলোক বাঙালিও আক্রান্ত, জেনেও খুব সে নড়ে বসেনি। সম্ভবত জাত্যাভিমান তৈরী হওয়ার মত প্রাচীন জাতি বা ভাষাগোষ্ঠী নয় বাঙালি। তাই। সিপিআইএম ও বর্তমানের জ্বলন্ত এই সমস্যাটাকে নিজস্ব আন্দোলনের ইস্যুর অভাব পূরণে ব্যবহার করছে না; মতাদর্শিক লয়ে ক্ষয়ে বয়ে এখন পার্টিটি নিখাদ মধ্যবিত্ত নির্ভর। নেতৃত্বের শ্রেণী উত্স ও আন্দোলনের বিষয় নির্বাচন দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। (দলিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করলেই যেমন শাসক শ্রেণী দলিত সমব্যাথী হয়ে ওঠেনা, এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই ) ।

বাঙালির এই সংকট তাই অদূর ভবিষ্যতেও একটি প্রধান রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠবে না। অরাজনৈতিক মঞ্চগুলি যদি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করার পরিস্থিতিতে আসে ও সার্বিক প্রচারের মাধ্যমে বাঙালির একটা অংশ কে অন্ততঃ সচেতন করতে পারে তাহলে হয়ত অন্যরকম কিছু ঘটতেও পারে।