কুড়মিনামা / The Kudmi Files

তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, শুনলাম হেড স্যারের ঘরের পাশের ঘরে নাকি কি সব ফর্ম ফিল আপ হবে, আর ফিল আপ করলেই আসবে টাকা। স্কুল জীবনে বাড়ি থেকে হাতে টাকা পেতাম না, তাই সেদিন আরও পাঁচটা বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম লাইনে। নাহ্, কোনো লাভ হয়নি, সেদিন আমায় লাইন থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। স্কুল থেকে বলেছিল, আমি টাকা পাব না, কারণ আমি নাকি “প্রভিলেজড ক্লাস”, আমি নাকি আমার অন্য বন্ধুদের মতন না। আমি আলাদা, ওরা আলাদা। সেদিন কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, আমি কেন আলাদা, আমরা তো এক স্কুলে পড়ি, একসাথে খেলি, একসাথে টিফিন ভাগ করে খাই, তাহলে আমি কেন ওদের মত নই? সেদিন প্রথমবারের মত রাষ্ট্র দ্বারা আমার শিশুমনের ওপর “ডিভাইড এন্ড রুল” অ্যাপ্লাই হয়েছিল। বুঝতেই পারিনি।

আজও কুড়মি জনজাতির আন্দোলন চলছে, কিন্তু এই সুসংগঠিত এবং শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন ভাঙতে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের সুযোগ্য সহযোগী হয়েছে, বাংলার সংবাদমাধ্যম, যাকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। সবাই মিলে একসাথে প্রয়োগ করছে “ডিভাইড এন্ড রুল”। তাতে অজিত প্রসাদ মাহাতো’র নির্দেশে আন্দোলন সাময়িকভাবে থেমে গেলেও, কুড়মিদের আন্দোলন থামেনি। ছাইয়ের নিচে চাপা আগুন হয়ে তা আজকেও জ্বলছে কুড়মিদের বুকে।

হাতে কলম থাকলেই, যা কিছু লেখা যায়! এই মুহূর্তে সেটাই করেছে “ভগবানকে ছাড়া কাউকে ভয় না পাওয়া” সংবাদপত্র। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, “একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে” কুড়মি বিক্ষোভে মাওবাদী যোগের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। তাদের মতে, সেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা “একটি গোপন সূত্র” থেকে এই তথ্য জানতে পেরেছে। বাহ্ রে মিডিয়া। একটা বঞ্চিত জনজাতির বঞ্চনার গণআন্দোলনকে মাওবাদীদের সাথে কি অবলীলায় জুড়ে দিলেন ওনারা।

এই সবের মধ্যে খড়্গপুরের সাংসদ এবং বিজেপি সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ”কুড়মি সমাজকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।” খেমাশুলিতে যেখানে আজও কুড়মীরা বসে আছেন, তাদেরই সাংসদ তিনি।

আর পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ, জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো’র ফেসবুক প্রোফাইলে এই আন্দোলন নিয়ে একটিও শব্দ এখনো অবধি দেখা যায়নি। এই সাংসদ নিজেও কুড়মি। কিন্তু তিনি সম্পূর্ন নীরব।

এবার আসি রাজ্য সরকারের কথায়। খেমাশুলি অঞ্চলের বিধায়ক দিনেন রায়, এই প্রসঙ্গে সম্পূর্ন নীরব। অনগ্রসর শ্রেণী উন্নয়ন এবং আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রী বুলু চিক বারাইক’ও কুড়মিদের আন্দোলন নিয়ে সম্পূর্ন ভাবে নীরব। তবে আন্দোলন শুরুর পাঁচদিন পর রাজ্য সরকারের মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভূঁইয়া অবশেষে জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন কুড়মি সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণভাবে এই অবরোধ তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আর রাজ্যের শাসক দলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, কুড়মি আন্দোলনের সব দায়িত্ব ঠেলে দিয়েছেন কেন্দ্র সরকারের দিকে।

তাই অত্যন্ত কৌশলে কিছু সংবাদমাধ্যম দায়িত্ব নিয়ে কুড়মিদের এই আন্দোলনকে সুত্র মারফত জড়িয়ে দিয়েছে মাওবাদীদের সাথে। কিন্তু এখনো অবধি বঙ্গবাসী ঠিকমতো জানে না, কুড়মিদের এই আন্দোলন কেন? আজ রাইজ অফ ভয়েসেস সেটাই জানাবে আপনাদেরকে।

কুড়মি কারা?

কুড়মিরা ভারত এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠী। অন্যান্য গোষ্ঠীর মত কুড়মিদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা (কুড়মালী) ও পরিচিতি, নিজস্ব ধর্ম (সারনা), সামাজিক রীতি-নীতি, আচার ও কৃষ্টি, বর্ণ পরিচয় এবং সামাজিক বৈচিত্রতা যা তাদেরকে একটি নিজস্ব জাতিসত্ত্বা হিসেবে পরিচিতি দান করেছে। মুলত ঝাড়খণ্ড, উড়িশ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গে (পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর) প্রধানত এদের বসবাস।

কুড়মিরা হঠাৎ করে আন্দোলন করছে কেন?

নাহ্, এই আন্দোলন হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এদের আজকের আন্দোলন বহু প্রজন্ম ধরে জমে থাকা পুঞ্জিভূত ক্ষোভের ফল। সাধারণভাবে সংবাদমাধ্যমে যা বলা হচ্ছে, এই আন্দোলন কুড়মি জনজাতিদের ওবিসি-বি থেকে এসটি’তে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আন্দোলন। কিন্তু এই তথ্য আংশিক। সম্পূর্ণ কারণ জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ ভারতে।

১৮৬৫ সালের ইন্ডিয়ান সাকশেসন অ্যাক্ট অনুযায়ী কুড়মিরা ছিল নোটিফাইয়েড ট্রাইব, আর ১৯৩১ সালে তাদের প্রিমিটিভ ট্রাইব বা আদিম উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই সময় কুড়মি জনজাতির মধ্যে শিক্ষার প্রসার সেভাবে না থাকায়, তারা হারিয়েছিল তাদের ধর্ম পরিচয়। আজকের দিনেও কোনো সরকারি ফর্ম ভরতে গেলে, তাদের লিখিতে হয় হিন্দু। কিন্তু তারা কেউ হিন্দু নয়, তাদের ধর্ম সারনা।

তাদের ধর্ম হারানোর মূলে আছে মুলত ব্রিটিশ ভারতের জনগননা বা সেন্সাস। কারণ যে সব আধিকারিকরা কুড়মিদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তাতেই হয়েছিল আসল গন্ডগোল। রিলিজয়ন বা ধর্মের কলামে কোথাও লেখা হয়েছিল ‘ট্রাইবাল হিন্দু’ কোথাও বা ‘ক্ষত্রিয়’। পুরোটাই হয়েছিল সরকারি স্তরে, আর সেই সময় কুড়মিদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার না থাকায়, এই নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদের কথাও শোনা যায়নি।

সরকারী স্তরে এমন কান্ড হলে, শিক্ষিত সমাজও এই নিয়ে কতটা কি প্রতিবাদে নামে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আধার কার্ডের তথ্য যখন নেওয়া হয়েছিল, তখন অনেক জায়গাতেই ফোন নাম্বারের তথ্য ঠিকঠাক সংগ্রহ করা হয়নি, কোথাও কোথাও ডামি নম্বর দিয়ে ফর্ম ভরেছিল সরকার নিযুক্ত সংস্থাগুলো। যার ফলে অনেকের বিস্তর অসুবিধা হয়েছিল, আধারের সাথে নতুন করে মোবাইল নম্বর যোগ করতে। কিন্তু তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাক্তিগত ভাবে ক্ষোভ থাকলেও, তা কোনোদিন আন্দোলন হয়ে সরকারের ওপর আছড়ে পড়েনি। কুড়মিদের সারনা থেকে হিন্দু হয়ে যাওয়ার গল্পটাও অনেকটা এই রকমই।

১৯৪১ সালের সেন্সাসের পর উড়িশ্যার ময়ূরভঞ্জে কুড়মিদের আখ্যা দেওয়া হয়, ‘ট্রাইবাল হিন্দু’ আর দেশের অন্যান্য জায়গায় ‘ক্ষত্রিয়’ রূপে। আর তাতে কুড়মিরা হারায় তাদের ধর্ম। সারনা ধর্মকে স্বীকৃতি দিতে হবে, এই দাবি আজও তাদের পূরণ হয়নি। কুড়মিদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে এটিও একটি দাবি যে, “সারনা” ধর্মের জন্যে অবিলম্বে কোড চালু করতে হবে।

১৯৪১-এ ধর্মীয় পরিচয় হারানোর পর ১৯৪৬ সালের মৌলিক অধিকার, সংখ্যালঘু এবং উপজাতি সম্পর্কে গঠিত অ্যাডভাইসরি কমিটি যে রিপোর্ট তৈরি করে, তাতে বাদ যায় কুড়মিদের নাম। আর সেই কারণেই ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ ভারতের ১৩ টি উপজাতির মধ্যে একটি মাত্র উপজাতির নাম বাদ যায়, তারা কুড়মি। আর আগেও এই নিয়ে বহুবার আন্দোলন হলেও, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনোরকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০০৪ সালে ঝাড়খণ্ড সরকার কুড়মিদের ওবিসি-বি তালিকা থেকে এসটি তালিকাভুক্ত করার আবেদন করলে, তৎকালীন ভারত সরকারের ট্রাইবাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর বিরোধিতা করে বলে, কুড়মিরা আসলে পশ্চিম ভারতে বসবাসকারী কুনবিদের একটি সাব-কাষ্ট। ফলস্বরূপ কুড়মিদের দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।

এরপরে ২০১৫, আবারও একবার ঝাড়খণ্ড সরকারের দাবি প্রত্যাখ্যাত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। বারে বারে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তাই কুড়মিরা এবার দলবদ্ধভাবে নেমেছিল নিজেদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় আদায়ে। কিন্তু সেই দাবি এবারেও থেকে গেল অধরা।

উল্টে সংবাদমাধ্যম এদের সাথে মাওবাদীদের সাথে যোগাযোগের ইঙ্গিত করলো, এলাকার বিজেপি সাংসদ তাদের কুকুরের সাথে তুলনা করলো, শাসক দলের মুখপাত্র, সমস্ত দায় কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে ঠেলে দিলো আর রাজ্য সরকার সরকারি স্তরে আলোচনার আছিলায় তাদের নেতাকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিল, ঠিক যেভাবে শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক মইদুল ইসলামকে সরিয়ে দিয়েছিল আন্দোলন থেকে, যেভাবে শাহিদুল্লার সাথে আলোচনা করে এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিল, ঠিক সেই এক কাব্য এবারেও পাঠ করা হল, যার নাম “ডিভাইড এন্ড রুল”।

এই আন্দোলন সম্বন্ধে অবশ্য সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন,

“এটা কোন সাময়িক বিষয় নয়, দীর্ঘদিন ধরে কুড়মি মাহাতো সহ বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, জনগোষ্ঠী, যারা প্রান্তিক তাঁদের অভাব অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের ভাষা সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দাবি রয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্বের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিতে সব বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা হচ্ছে। আমরা সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, প্রত্যেকটা জাতিগোষ্ঠী, জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য আছে, তাঁকে মর্যাদা সহ রক্ষা করতে হবে, স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তার উন্নতির উদ্যোগ নিতে হবে।”

এরপরে লেটেস্ট আপডেট এটাই, যে গত শনিবার কুড়মি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের ভিডিয়ো কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বৈঠকের পর অবরোধ তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন কুড়মি সংগঠনের উপদেষ্টা, অজিত প্রসাদ মাহাতো। কিন্তু তার পরেও আন্দোলনকারীদের একাংশ রেলপথ ও সড়ক থেকে সরতে চাননি। যেমন-পুরুলিয়ার কুস্তাউর আর পশ্চিম মেদিনীপুরের খেমাশুলিতে রেল অবরোধ বন্ধ করেনি আন্দোলনকারীরা। তাদের অভিযোগ ছিল, সরকারের আশ্বাসে বেশ কিছু ফাঁক রয়েছে। সেসব নিয়ে রাতে ফের পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসকের সঙ্গে কুড়মি সংগঠনের নেতাদের কথা হওয়ার পর রবিবার সকালে আপাতত অবরোধ তুলে নেন আন্দোলনকারীরা। যদিও এঁদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, কুড়মি আন্দোলনের নেতা অজিত প্রসাদ মাহাতোর উপর। তাদের মতে এর আগেও অজিত মাহাতো বেশ কয়েকবার আন্দোলন ছেড়ে মাঝপথে বেরিয়ে গিয়েছেন। আর যে আন্দোলন তিনি ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন, সেগুলো থেমেছে সেখানেই। সেটা কখনো গাঁজা কেসের আন্দোলন, কখনো আবার প্রাইমারি নিয়োগের আন্দোলন শুরু করে মাঝ পথে ছেড়ে দেওয়া। এদের মধ্যে নবতম সংযোজন বর্তমান জাতিসত্তার আন্দোলন থেকে সরে আসা।

কিন্তু অজিত মাহাতো, মইদুল ইসলাম বা শাহিদুল্লার মত শাসকের হাতের পুতুলে পরিণত হবেন কি না তা ভবিষ্যৎ বলবে! কিন্তু যা বাস্তব পরিস্থিতি, তাতে চাপা ক্ষোভ এখনো দেখা যাচ্ছে কুরমি সমাজে। প্রতিশ্রুতি মত তাদের দাবি না মানা হলে তারা আবারো নামতে পারে রাস্তায় এবং আরো সুসংগঠিতভাবে। আর সেক্ষেত্রে তারা পাশে পেতে পারে বামপন্থীদের। অবশ্য যদি চায়। ইদানীং তো আবার রাজনৈতিক পতাকা বিহীন আন্দোলনের চল হয়েছে! কাজেই….

ধন্যবাদান্তে,
সুজয় ঘটক