পেনশন টেনশন / KMC Pension Stopped

মাস দেড়েক আগেকার কথা। কলকাতার “দশ দিগন্ত” জুড়ে প্রতিশ্রুতির ঘুড়ি ওড়ানো হাকিম সাহেব লুঠের ভোটে ফের একবার মেয়রের চেয়ারে বসতে না বসতেই, পুরসভার নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে গেল। ফলে আমরা যারা ভোটের দিন দুষ্কৃতীদের অবাধ দাপাদাপির মধ্যে ভোট দিতে গিয়ে হুজ্জুতি এড়াতে লাইন দিয়ে মাংস কিনে বাড়ি ফিরেছিলাম এবং তাদের মধ্যে যারা আজ সকালে চা-বিক্কু খেতে খেতে সর্বাধিক বিক্রিত দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা “শেষ কথা তিনিই” পড়ে আস্বস্ত হয়েছিলাম, তাদেরকে জানাতে চাই কলকাতা পুরসভার “খালি” কোষাগার হাত তুলে দিয়েছে!

পুরসভার পেনশন বিভাগ নোটিশ ঝুলিয়ে জানিয়ে দিয়েছে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে যে সমস্ত পুরকর্মীরা অবসর নিয়েছেন তাদেরকে আপাতত পুরসভার বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের কারণে পেনশন এবং অন্যান্য অবসরকালীন আর্থিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি কবে দেওয়া হতে পারে তারও কোন সুর্নিদ্দিষ্ট উল্লেখ নেই। এমন নজিরবিহীন ঘটনা আর আগে কলকাতা পুরসভার ইতিহাসে ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।

বিভিন্ন সংবাদ সংস্থাসূত্রে যা জানা যাচ্ছে তা হল গত প্রায় মাস চারেক ধরে ৭০০-৮০০ জনের মত অবসর নেওয়া পুরকর্মী প্রায় প্রতিদিন দফায় দফায় সকাল বিকেল পেনশনের খোঁজ খবর করতে আসায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে, পেনশন বিভাগের কতৃপক্ষের তরফে একেবারে নিরুপায় হয়ে এমন সাদা পাতার নোটিশ পেনশন বিভাগে ঝোলানো হয়েছে। কারণ তাদের কোষাগার খালি।

একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের হিসেব অনুযায়ী এই মুহুর্তে কলকাতা পুরসভাকে কর্মচারীদের মাইনে বাবদ মাসে ১৫০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। আর পেনশন খাতে মাসিক খরচ ৫০ কোটি টাকার মত। পুরসভার যা আয় তা দিয়ে যে এই ব্যয়ভার বহন করা যাচ্ছে না তা এই নোটিস বা বিজ্ঞপ্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

এমনকি বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে যা সামনে আসছে তা হল, এই মুহূর্তে কলকাতা পুরসভায় যে ২৬ হাজার অস্থায়ী ঠিকা কর্মী কাজ করেন, তাদের বেতনও আটকে রয়েছে। তাদের কিছু কিছু প্রাপ্য বকেয়া টাকা নাকি ৭-৮ মাস ধরে বাকি রয়েছে।

জরুরি বিভাগে বার্ষিক ছুটির দিন গুলিতে কাজ করা কর্মীদের এই দিনগুলিতে কাজ করবার টাকাও বকেয়া রয়েছে বিগত ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে। এছাড়া ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে উৎসবের দিনগুলিতে জরুরি পরিষেবা প্রদানের কাজ করা কর্মীদের টাকাও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এছাড়াও ২০১৬ সাল থেকে অবসর নেওয়া পুরসভার কর্মচারীরা ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুযোগ সুবিধাও পাননি। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ডামাডোল পুরসভার অন্দরে।

এদিকে পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার নোটিসটি যে আসলে হিমশৈলের চূড়া মাত্র, তা মাসখানেক আগে মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই স্বয়ং হাকিম সাহেবের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি তখন জানান এই মুহুর্তে পুরসভার মাথায় ঋণের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা। সেই সময় রাজ্য সরকারের থেকে ৭০০ কোটি টাকা ধার করে এবং এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাঙ্কের থেকে ২০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে অবস্থা সামলাবার বন্দোব্যস্ত হয়। এখন এটাকেই আবার কিছু শাসক অনুগত সংবাদমাধ্যম তুরুপের তাস হিসেবে হাতে নিয়ে মেয়রকে “ম্যায় হুঁ না” র শাহরুখ খান বানাতে চাইছে! কিন্তু মাস ঘুরতে না ঘুরতেই কিভাবে আর্থিক সঙ্কটের নোটিস পড়লো তার উত্তর খুঁজতে চাইছে না।

এমনকি মেয়রও নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন এমন কোন নোটিস দেওয়ার কথা তার অজ্ঞাত ছিল। তিনি ও তার দলের তরফে এটিকে পরোক্ষভাবে অন্তর্ঘাতের ঘটনা হিসেবে তুলে ধরবার চেষ্টা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এব্যাপারে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশও নাকি দেওয়া হয়েছে বলে সূত্রের খবর। যদিও এই নোটিসের মধ্যদিয়ে ভোটের বাজারে আলামারিতে লুকিয়ে ফেলা কলকাতা পুরসভার আর্থিক কঙ্কালসার চেহারাটা বেয়াব্রু হয়ে পড়েছে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি কলকাতা পুরসভা ২০১০ সালে যখন বর্তমান শাসকদলের হাতে এলো, তখন কিন্ত কোষাগারে ৫০০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল, এমনটাই খবর রয়েছে আমাদের কাছে। কিন্তু তার পরবর্তী সময় সীমাহীন দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অবিমিশ্রকারিতার কারণেই আজকের এই দুর্গতি বলে পুরসভার শ্রমিক কর্মচারী মহলে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাদের বক্তব্য কোটিপতি মেয়র-মেয়র পারিষদদের ভিড়ে, আপনি পুরসভার অলিন্দে বিলাস বহুল অ্যাস্টন মার্টিন গাড়ি চড়া কোটিপতি পুরপ্রতিনিধি বা কাউন্সিলরদের দেখা পেয়ে যেতে পারেন কিন্তু পেনশন পাবেন না বা এখন পুরসভা ধার দেনা করে দিয়ে দিলেও কদ্দিন পাবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। তার ওপর এই রাজ্যের মাননীয়া রায়গঞ্জের প্রশাসনিক সভায় মাসখানেক আগে বলেছিলেন, “দু বছর কিছু চাইবেন না”।

যদিও অর্থনীতিবিদদের মতে এমনটা হওয়া কিছু আশ্চর্যের নয়। কারণ সমগ্র রাজ্যের অর্থনীতির মেরুদণ্ডটাই প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রদেয় তথ্য অনুযায়ী স্বয়ং রাজ্য সরকার গত একমাসে এক-দুবার নয় তিনবার বাজার থেকে টাকা ধার করেছে। গত একমাসে রাজ্য সরকারের ধারের পরিমাণ ৬৫০০ কোটি টাকা। মানে গড়ে দৈনিক ধার ২০০ কোটি টাকার বেশি। পশ্চিমবঙ্গের মত জনবহুল এবং সমতুল আর কোন রাজ্য এত টাকা ধার করেনি।

কাজেই এতকিছু জানবার পরও আমরা যারা ভাবছি রাজ্যের সর্বত্র সর্ব বিষয়ে “শেষ কথা তিনিই” তাদের জানাই কোন “তিনি” নয় বরং বাজারে আমরা বাঙ্গালীরা ক্রমশঃ “ঋণী” হয়ে পড়ছি। কাজেই এখন থাকতে সচেতন এবং সাবধান না হলে আগামী দিনে সেই ঋণ মেটাতে “আপনার-আমার” নীল-সাদা চপ্পলের স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যেতে পারে!

তথ্যসূত্র
a) https://epaper.anandabazar.com/imageview_61139_470684_4_71_28-01-2022_11_i_1_sf.html
b) https://bangla.asianetnews.com/kolkata/pension-blocked-for-retired-employee-of-kmc-due-to-lack-of-money-bmm-r6ehld
c) https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/kmc-could-not-pay-pension-to-their-former-employees-due-to-lack-of-income/cid/1325894
d) https://www.sangbadpratidin.in/kolkata/kolkata-municipal-corporation-announces-not-to-release-pension-fund-due-to-economic-crisis/
e) https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/kmc-suspends-pension-payout/articleshow/89167499.cms
f) https://www.deccanherald.com/national/east-and-northeast/kolkata-municipal-corporation-stops-pension-payments-to-employees-who-retired-after-september-2021-1075520.html
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-28/202201272350065.jpg&category=0&date=2022-01-28&button=
h) https://www.anandabazar.com/west-bengal/kolkata/firhad-hakim-says-prob-has-been-stated-on-kmc-notice-dgtl/cid/1326042