“ছোট ঘটনা”র ছড়াছড়ি / Increasing Rape Cases in Bengal

সে একদিন ছিল। যখন রাজ্যের সবকটি মিডিয়ার বুকে পাটা ছিল। রাজ্যের কোথাও একটি নারী নির্যাতন বা ধর্ষনের ঘটনা ঘটলেই পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা টিভিতে প্রত্যকেটা খবরের চ্যানেলে সালিশি সভা বসিয়ে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এবং তার অধীনস্থ পুলিশ প্রশাসনের ষষ্ঠীপুজো করা হতো। খবরের কাগজগুলোতেও সপ্তাহখানেক ধরে চলত তদন্তমূলক খোঁজখবর বা সাংবাদিকতার নামে শাসক এবং সরকারবিরোধী প্রচার। আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করি যা হত ঠিকই হত। এ নাহলে আর কিসের চতুর্থস্তম্ভ!

কিন্তু ২০১১ সালে পালাবদলের পর শুরু হল “ছোট ঘটনা” র পরম্পরা। সবই নাকি “সাজানো ঘটনা”! পার্কস্ট্রীট বা কামদুনি কাণ্ড নিয়ে তাও প্রথমটায় কিছুটা হলেও হইচই হয়েছিল। কিন্তু তারপর সব কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। গেদে, ধূপগুড়ি ইত্যাদি আরও বেশ কয়েকটি নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও সেভাবে আর সংবাদমাধ্যম গুলোকে মাঠে পাওয়া গেল না। যতটা চোখেচোখ রেখে কথা হওয়ার কথাছিল ততটা হল না। বরং কানেকানে ফিসফিসিয়ে কোন “অন্যকথা” হল বোধহয়! আর তাই এখন বাংলার বুকে কোন নারীনিগ্রহের ঘটনা ঘটলে সেভাবে সংবাদ মাধ্যম উত্তাল হয় না। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় তো নয়ই এমনকি ভেতরের পাতায়ও সেভাবে জায়গা পায় না। “ছোট ঘটনা” হওয়ায় ছোট করে এককোণে দায়সারা করে লিখে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আর তাই আমরা বাংলার খুঁটিনাটিতে গত মাস খানেকের মধ্যে রাজ্যের বুকে ঘটা এমনকিছু ঘটনার কথা আপনাদের সামনে রাখতে চাইছি যেগুলো হয়তো রাজমিস্ত্রী-গৃহবধূর প্রেম-পিরীতের মত মুচমুচে না হওয়ায় অথবা “চাণক্য চূড়ামণি” র সোডিয়াম পটাসিয়াম ওঠা-নামার মত মুখরোচক না হওয়ায় কিমবা “মিসড কল” পার্টির নেতাদের হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় সেভাবে আপনাদের নজর পড়ে নি। এই ঘটনাগুলো এতটাই লজ্জাজনক যে আমরা লিখতেও খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। কিন্তু মূলস্রোতের মিডিয়া হাউস গুলো এব্যাপারে হাত-পা গুটিয়ে নেওয়ায় আমাদেরকে বাধ্য হয়ে লিখতে হচ্ছে।
এরআগে আমরা কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ কলেজের মধ্যে ঐ কলেজেরই দ্বিতীয়বর্ষের এক ছাত্রীর নিগৃহীত হওয়ার ঘটনার কথা বলেছিলাম। এবার আরেকটু আপডেট নিন। অভিযুক্তের নাম তাপস দাস। বাড়ি তুফানগঞ্জ ১ নম্বর ব্লকের জায়গির চিলখানা এলাকায়। গুণধরটি কলেজেরই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন নেতা। কলেজের বর্তমান ছাত্রনেতাদের সাথে তার নিয়মিত ওঠাবসা। আর তাই কলেজে রয়েছে নিত্য যাতায়াত। সেই সূত্রেই গত ৩০ শে নভেম্বর কলেজ লাইব্রেরীর পাশের ফাঁকা ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষন করে বসে ছাত্রীটিকে। শাসক ঘনিষ্ঠতার কারণে কলেজ কতৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রথমটায় ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু ঘটনা সামনে আসতেই শাসকদলের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় চাপানো উতর। গোষ্ঠীদন্দ্ব। তার রেশ কলকাতার সংবাদ মাধ্যমে না পৌছালেও স্থানীয় জনমানসে প্রভাব ফেলে। তখন খানিকটা চাপে পড়েই বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করে অভিযুক্তকে। এখন এটা যদি বাম আমল হত আর অভিযুক্ত যদি এসএফআই করত তাহলে কি হত বুঝতে পারছেন ! ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পাওয়াদের বুক ঠুকে সীমা-না পেরিয়ে যাওয়ার হুড়োহুড়ি পড়ে যেত! কিন্তু সেরকম কিছু হয়েছে কি! আপনারা বলুন! আমাদের অন্তত চোখে পড়েনি।

আর এই ঘটনার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই এবার শিরোনামে ঐ কোচবিহার জেলারই শীতলকুচি। এবার শীতলকুচি কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের একছাত্রীকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কলেজ যাওয়ার পথে গাড়িতে তুলে নেয় দুজন যুবক। এদের একজন মেয়েটির পূর্ব পরিচিত এবং ঐ একই কলেজের ছাত্র। এরপর একটি ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত ছিল তৃতীয় দুষ্কৃতী। এরপর ছাত্রীটিকে গণধর্ষন করে তিনজন। নিগ্রহের কারণে ছাত্রীটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শীতলকুচি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে ফেলে পালিয়ে যায় তিনজন। এটি ২২ শে ডিসেম্বরের ঘটনা। এক্ষেত্রেও ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের একাংশ প্রতিবাদে সরব হয়। ফলে খানিকটা বাধ্য হয়েই পুলিশ তৎপর হয় এবং গ্রেপ্তার করে অভিযুক্তদের।

মানে একই জেলায় কুড়ি বাইশ দিনের ব্যবধানে নিগ্রহের শিকার দুই কলেজছাত্রী! আর আমাদের রাজ্যে নাকি মহিলারা দারুণ নিরাপদে আছেন।

এবার চলে আসি কলকাতার উপকন্ঠে। পয়লা জানুয়ারী। শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা আদান প্রদানে ব্যস্ত সকলে। সেই উপলক্ষে দক্ষিণ ২৪-পরগণার ঘটকপুকুর এলাকা থেকে ২৫-৩০ জনের একটা দল টাকিতে যায় পিকনিক করতে। পিকনিক সেরে সন্ধ্যেবেলা ফেরবার পথে কলকাতা-বাসন্তী হাইওয়েতে মিনাখাঁর কাছে এই দলটি পরে দুষ্কৃতীদের খপ্পরে। মিনাখাঁর দুষ্কৃতীদের দলটিও পিকনিক করে ফিরছিল। প্রথমে শুরু হয় দুই গাড়ির মধ্যে রেষারেষি। আবার অন্য একটি মতে পিকনিক করতে গিয়েই প্রথমে ঝামেলা হয় দুই দলের মধ্যে। রেষারেষিটা এই ঝামেলারই রেশ। তারপর একসময় গাড়ি থামিয়ে শুরুহয় বচসা-হাতাহাতি। শেষে মিনাখাঁর দলটির মধ্যে কয়েকজন মদ্যপ ঘটকপুকুরের দলটির এক গৃহবধূকে এবং এক যুবককে জোড় করে নিজেদের গাড়িতে তুলে নিয়ে চম্পট দেয়। কুমারজোলের কাছে একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালায় এবং গণধর্ষন করে ঐ গৃহবধূটিকে। ভরসন্ধ্যেবেলা একজন গৃহবধূকে পিকনিক দলের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষনের ঘটনা সামনে আসায় স্তম্ভিত হই আমরা। পরে খোঁজ-খবর করতে স্থানীয়সূত্রে জানা যায় পিকনিক করতে আসা দলগুলি ইদানীং প্রায়ই এমন দুস্কৃতিদের শিকার হচ্ছেন । অথচ প্রশাসন নীরব। এক্ষেত্রেও প্রথমদিকে পুলিশের তরফে মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে গরিমসি চলছিল। সূত্রের খবর মূল অভিযুক্ত মিনাখাঁর ব্লক সভাপতির ঘনিষ্ঠ। কিন্তু কোন কারণে ঘটনার খবর চাউর হয়ে যাওয়ায় পুলিশ একরকম বাধ্য হয়ে গ্রেপ্তার করে ৬ জনকে।

এরপর মেদিনীপুরের শালবনী। ঘটনাটা যদিও ঘটে ৩১শে ডিসেম্বরের আশপাশে এবং ওখানকার মানুষ জানতে পারেন ১লা জানুয়ারি । কিন্তু আমরা জানতে পারি তারও এক দুদিন পর। শালবনীর জঙ্গলে এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবতীর অর্ধনগ্ন আধপোড়া দেহ দেখতে পান জঙ্গলে ডাল-পাতা কুড়োতে যাওয়া স্থানীয় গ্রামবাসীদের একটি দল। অভিযোগ গণধর্ষন করে খুন করা হয় এবং প্রমান লোপাটের জন্য পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যুবতী বাইরের এলাকার নন এমনটাই জানান এলাকাবাসী। স্থানীয় মানুষ জানান এমন গণধর্ষন করে খুনের ঘটনা এই জেলায় এরা আগেও ঘটেছে। শালবনীতেই নাকি সাম্প্রতিক অতীতে এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে স্বীকার একজন স্কুল পড়ুয়া এবং একজন গৃহবধূ। এছাড়া জেলার পিংলা ঘাটাল ডেবরা চন্দ্রকোণা ইত্যাদি অঞ্চলে এরকম ঘটনা ঘটেছে মোট সাতটি। আপনারা কেউ জানতে পেরেছেন !! আমরা পারি নি!!

সবশেষে আসি পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায়। আমরা ঘটনাটার কথা জানতে পারি ৬ই জানুয়ারী। ঘটনাটি ঘটে ৫ইজানুয়ারি। এখানকার ২ নম্বর ব্লকের দুবদা এলাকায় এক বছর আটত্রিশের দুঃস্থ দিনমজুর মহিলাকে গণধর্ষন করে খুনের অভিযোগ সামনে এসেছে । ত্রিপলের ছাউনিতে একাই থাকতেন উনি। স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিখোঁজ। বছর চোদ্দোর এক ছেলে মুম্বাইতে গয়নার দোকানে কাজ করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ স্থানীয় একদল দুষ্কৃতী মদ্যপ অবস্থায় এই ঘটনা ঘটিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মদ্যপদের দাপট চলছে। প্রাশাসনের তরফে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

হয়তো আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে যা সামনে আসে নি বা আমরা জানতে পারি নি। কিন্তু রাজমিস্ত্রী-গৃহবধূদের প্রেমে মনস্তত্ববিদ সমাজকর্মীদের নিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার ছায়া খুঁজে বেড়ানো আমাদের মহামহিম সংবাদমাধ্যমগুলিতে “এই ঘটনাগুলো নিয়ে” কেন কোন হইচই হল না জানি না! এই নীরবতা কি শুধুই ব্যবসা ও বিনোদনের দৌড়ে ন’পরাজিত থাকবার জন্য। যদি তাই হয় তবে চোখ মেলে দেখুন, নপরাজিতদের একটা সময় পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

কাজেই নতুন বছরে শুধু ব্যবসার খাতায় নয় সংবাদ মাধ্যমগুলির মাথায়ও যাতে অক্সিজেন যায় এই কামনা করি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-05/202112042208441.jpg&category=0&date=2021-12-05&button=
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60682_2489373_4_71_03-01-2022_0_i_1_sf.html
c) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60710_34137741_4_71_04-01-2022_6_i_1_sf.html
d) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60707_33832847_4_71_04-01-2022_3_i_1_sf.html
e) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-01/2021123121331911.png&category=0&date=2022-01-01&button=
f) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-03/202201022336593.jpg&category=0&date=2022-01-03&button=
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-03/202201022307551.jpg&category=0&date=2022-01-03&button=
h) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-04/202201032311428.jpg&category=0&date=2022-01-04&button=
i) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-06/202201052316433.jpg&category=0&date=2022-01-06&button=
j) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-06/202201052321029.jpg&category=0&date=2022-01-06&button=
k) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-06/202201052159212.jpg&category=0&date=2022-01-06&button=