এক অন্য চুরির হদিশ / Hocus Pocus

পরিবর্তনের বাংলায় ইদানীং একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি আমরা। আগে ঘরে চুরি হতো। এখন আস্ত ‘ঘরচুরি’ হচ্ছে।

আর এসবই হচ্ছে সরকারের আবাস যোজনাকে কেন্দ্র করে। যাদের নাম আবাস যোজনার তালিকায় থাকবার কথা তাদের নাম থাকছে না। উল্টে এমন কিছু লোকজনের নাম সেই তালিকায় জ্বলজ্বল করছে যারা ইতিমধ্যেই গাড়ি-বাড়ির মালিক। এদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই দেখা যাচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল নেতা বা তৃণমূলের টিকিটে জেতা জনপ্রতিনিধি। অবশ্য তারমধ্যে ইতিউতি কিছু দাপুটে বিজেপি নেতার নামও পাওয়া গেছে সেই তালিকায়!

কিন্তু রাজনীতির রঙ আলাদা হলে হবে কি, এব্যাপারে এঁদের সবারই উত্তর মোটামুটি এক। “চার-পাঁচ বছর আগে যখন আবাস যোজনার সমীক্ষা হয়েছিল তখন আমরা মাটির কুঁড়েঘরেই থাকতাম। তাই তখন নামটা আবাস যোজনার তালিকাতে ঊঠেছিল। কিন্তু এখন আমাদের পাকা বাড়ি হয়ে গেছে। আর আবাস যোজনার টাকা লাগবে না। কতৃপক্ষকে নাম কেটে দিতে বলেছি।” যদিও পাড়া প্রতিবেশীরা বা নিন্দুকেরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে এতো খালি পাকাবাড়ি নয়, যেন বহুতল অট্টালিকা যা দেখে আমাদের মত সাধারণ মধ্যবিত্তের চোখ ট্যাঁড়া হয়ে যেতে পারে।

আর প্রশ্নটা উঠছে এখানেই। বিগত চার-পাঁচ বছরে এনারা কি এমন কাজকর্ম করলেন, যাতে মাটির কুঁড়ে ঘর থেকে সোজা বাহারি প্রাসদোপম অট্টালিকার মালিক হয়ে গেলেন! একটু খোঁজ খবর করতেই জানা গেল এক অদ্ভুত সমাপতনের ছবি। এদের প্রায় প্রত্যেকেই মামুলি স্থানীয় নেতা থেকে গত চার-পাঁচ বছরে কেউ হয়েছেন বিধায়ক, কেউ বা হয়েছেন সাংসদ। কারোর ভাগ্যে আবার জুটেছে মন্ত্রীত্ব। কেউ আবার হয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতি অথবা জেলাপরিষদ সদস্য। আর তারপরেই এঁদের কাউকে আর আবাস যোজনার সরকারি টাকার ওপর নির্ভর করতে হয়নি। নিজেরাই উল্কার গতিতে বাড়ি বানাতে সক্ষম হয়েছেন, গ্যারাজে রাখতে পেরেছেন দামী দু-চাকা/চার-চাকার শকট। সেসব গাড়ি বাড়ির ছবি সহ ফিরিস্তিও বিভিন্ন সংবাদপত্রে এবং সমাজমাধ্যমের দৌলতে সামনে আসছে।

স্বভাবতই আম-জনতার চোখে ভ্রুকুটি। জনপ্রতিনিধি হয়ে কি এমন ভাতা বা সরকারী আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় যার জোরে চালাবাড়ি/কুঁড়েঘরে দিন গুজরান করা লোকজন অট্টালিকা বানিয়ে ফেলছে!

এই যেমন ধরুন হঠাৎই গতকাল বিখ্যাত হয়ে ওঠা শিবঠাকুর মণ্ডলের কথা। কিছু বছর আগেও নাকি ওনার কোনক্রমে চেয়ে চিনতে দিন চলতো। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাবার পয়সাটুকু পর্যন্ত হাতে ছিল না। কিন্তু স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তার আর্থিক উত্থান! বাড়ি-গাড়ি-জমি-জায়গা, আজ কি নেই তার! এমনকি পেল্লাই বাড়িটা সিসিটিভির নিরাপত্তায় মোড়া! কিন্তু কিভাবে হলো এসব! একদা মাও অধ্যুষিত এলাকায় খবরের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো নামজাদা টিভি চ্যানেলের দাপুটে বেপরোয়া সাংবাদিক শিব ঠাকুরকে সামনে পেয়ে আর পাঁচটা রসালো প্রশ্ন করলেও, ভুলেও এমন কোন প্রশ্ন মুখে আনেন না! কারণ এটাই অলিখিত নিয়ম!

কিন্তু আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস! আমাদের সে প্রশ্ন করতে কোন বাধা নেই। তাই যখন জানতে পারলাম বিজেপি বিধায়ক বা বিজেপির টিকিটে জেতা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাড়ির লোকের নাম আবাস যোজনার নামের তালিকায় রয়েছে এবং তৃণমূলের মতই “বিগত সমীক্ষার সময় গরীব ছিলাম, এখন নই” টাইপের উত্তর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন, তখন সেই রুমাল থেকে বেড়াল বানিয়ে ফেলবার এমন সনাতনী পদ্ধতিটি নিয়ে কৌতুহল সম্বরণ করতে পারলাম না।

আসলে ‘ঘরচুরি’ চাপা দিতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই এনারা অন্য আরও বহু চুরির হদিশ দিয়ে ফেলছেন! এটা সেই অনেকটা কম্বলে মুখ ঢাকতে গিয়ে পা বেরিয়ে যাওয়ার দশা! কিন্তু তাও কি বাংলার মানুষ আদৌ সেই অসতর্কতার বশে বেরিয়ে আসা পায়ের আঙ্গুলগুলো দেখতে পাচ্ছেন! পাচ্ছেন অন্য চুরির হদিশ!

জানি না। তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস