ক্লাব খয়রাতি / Funded Club Culture

সমস্ত শাসকই তার ভোটিং মেশিনারি তৈরি করে। যে যখন ক্ষমতায় থাকে, সে তখন স্বাভাবিক ভাবেই চায়, ক্ষমতা ধরে রাখতে। তার জন্যে পাড়ার মস্তান সমাজবিরোধীদের আশ্রয় দেয়। সব্বাই! কেউ কম, কেউ বেশি। তবে সেটা তারা মূলতঃ করেন, নিজস্ব কোষাগারের কড়ি খরচা করে এবং প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমাদের বাংলার শাসকদল যে কাজটি করেছেন এবং করে চলেছেন বিগত সাত আট বছর ধরে, তেমনটি বেশ বিরল! এঁরা পাড়ার বিভিন্ন ক্লাব গুলিকে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে আমার আপনার ট্যাক্সের টাকায় অনুদান দিয়ে চলেছেন! সারা বাংলা জুড়ে প্রায় ২৬০০০ ক্লাব পিছু ৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে কিস্তিতে-কিস্তিতে। মোট খরচ ১৩০০ কোটি টাকা। এছাড়াও যে সমস্ত ক্লাব দূর্গাপুজো করে, তাদের কে প্রতি বছর অনুদান দেওয়া হয়। সেটাও কোন বছর ১০,০০০ টাকা তো কোন বছর ২৫,০০০ টাকা। এবছর তো করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সেই অনুদানের অঙ্ক গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০,০০০ টাকায়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে যা জানা যাচ্ছে তা হল গত এক দশকের শাসনকালে তৃণমূল সরকার এই ক্লাব-খয়রাতির পেছনে ব্যয় করেছে কম বেশি ১৪০০ কোটি টাকা। এভাব ক্রীড়া,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশের উদ্দেশ্যে ক্লাব সংস্কৃতি প্রতিপালনের আড়ালে শাসকের আসল উদ্দেশ্য যে নিজেদের ক্যাডার-কাম -মস্তান বাহিনী বানানো যারা ভোটের দিন “ভোট করে” দলকে জেতাবে তা আমরা সকলেই আমাদের বিগত নির্বাচনগুলির অভিজ্ঞতা থেকেই জানি।

সামনের কলকাতা পুরসভার নির্বাচনেও যে ঐ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে, তা আমরা এখন থাকতেই বেশ টের পাচ্ছি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা সূত্রে যা খবর তা হল কলকাতা এবং তার আশপাশের শহরতলির প্রায় ১০০০ ক্লাবকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাদের সাথে এব্যাপারে গোপনে মিটিং -শলা পরামর্শ চলছে। হচ্ছে টাকার আদান-প্রদাণ। তার প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে আমরা শহরে ঘুরলেই দেখতে পাবো শাসকদলের প্রার্থীর সমর্থনে ক্লাবগুলির পক্ষ থেকে টাঙানো বিশাল বিশাল ব্যানার এবং হোর্ডিং। মানে ব-কলমে আমার আপনার গ্যাঁটের টাকায় শাসকের প্রোপ্যাগান্ডা চলছে।

আমার আপনার করের যে ১৪০০ কোটি টাকা এইভাবে পাড়ায় পাড়ায় বিলিয়ে শাসক তার ভোট মেশিনারি বানিয়েছে এবং শানিয়েছে, সেই টাকায় কলকাতা পুরসভায় যে ২৮,০০০ শূন্যপদে নিয়োগ পয়সার অভাবে বন্ধ রয়েছে, সেগুলিতে লোক নিয়োগ করা যেত। এতে শুধু কর্মসংস্থান বাড়ত তাই নয় পাশাপাশি বেহাল পুরপরিষেবারও খানিকটা হাল ফিরত।

অভিযোগ, পুরসভা পরিচালিত বহুস্কুলে পয়সার অভাবে, মহামারীকে অজুহাত খাড়া করে, মিড-ডে মিল বন্ধ করা হয়েছে বা সীমিত পরিমাণে দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, যার ফলে শহরের প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা পর্যাপ্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর আগে আমাদের একটি লেখা “এগিয়ে বাংলার ইতিবৃত্ত”তে নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক সমীক্ষার রিপোর্ট উল্লেখ করে আমরা দেখিয়েছি, আমাদের শহর কলকাতা ক্ষুধার সূচকে দেশের ৫৬ টা শহরের মধ্যে ১০০ তে মাত্র ২৭ পেয়ে নীচের দিক থকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কাজেই ঐ ক্লাবে বিলিয়ে দেওয়া বিপুল অর্থ পুরসভার স্কুল পরিচালনায় খরচ করলে, এমন লজ্জার হাত থেকে আমাদের ভালোবাসার শহর হয়ত কিছুটা হলেও মুক্তি পেত। এছাড়াও শহরের বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারেও ঐ টাকা ব্যবহার করা যেত। খরচ করা যেত বস্তি উন্নয়নে। বস্তিবাসীদের জন্য বানানো যেত এক-দু কামরার পাকা বাড়ি, যা দক্ষিণ ভারতের কেরালা-তেলেঙ্গানার মত রাজ্যে আজ বাস্তব। বস্তুত দশ দিগন্তের নামে এই মুহুর্তে স্বপ্নের মত যা ফেরি করা হচ্ছে শহর জুড়ে, তার অনেক কাজই এই পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে বিলিয়ে দেওয়া টাকায় সম্পন্ন করা যেত বিগত বছর গুলিতে।

কাজেই হোর্ডিং বা ব্যানার দেখে নয় কাজ দেখে ভোট দিন। আর স্থানীয় সমাজবিরোধী-মস্তানদের কাছে আত্মসমর্পন না করে, নিজের ভোট নিজে দিন। মনে রাখবেন ভোট চোররাও কিন্তু চোর। তারাও আমার আপনার টাকাই চুরি করছে। শুধু সে টাকা শাসক চালিত সরকার, আমার আপনার পকেট থেকে নিয়ে ওদের হাতে তুলে দিচ্ছে, আমার আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে। তাই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা জরুরি।

পুনশ্চ: যখন এক শতাব্দী প্রাচীন ক্লাব তার জনৈক কর্মকর্তার (শাসকদলের বিগত পুরসভার মেয়র পারিষদ এবং এবার পুরসভা ভোটেও প্রার্থী) সমর্থনে, শহরের রাজপথে ব্যানার-হোর্ডিং-গেট দিয়ে ভরিয়ে দেয়, তখন জানতে ইচ্ছে করে ক্লাবটা কি আর আমাদের মত সমর্থকদের আছে, নাকি পাড়ার টুকাই-টুম্পাইদের পৈতৃক সম্পত্তি হয়ে গেছে! বাগানে ঘাস থাকে, কিন্তু বাগান কর্তাদের মাথায় এভাবে ঘাস গজাতে দেখে অবাক লাগলো!

তথ্যসূত্র:
a) https://www.newsclick.in/West-Bengal-TMC-Govt-Spent-1%2C300-Crore-Clubs-While-Unemployment-Continues-Rise
b) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-15/202112142337594.jpg&category=0&date=2021-12-15&button=
c) https://www.livemint.com/Politics/4oCm9fvJxh7qQifauFjdcN/How-Kerala-plans-to-give-free-houses-to-homeless-people.html