“এগিয়ে বাংলা”র ইতিবৃত্ত / Egiye Bangla

আজকে আর কোন ভ্যানতাড়া নয়! একদম নম্বর কথা বলবে। আমাদের বুঝিয়ে দেবে কে এগিয়ে আর কে পিছিয়ে!

ঘটনার সূত্রপাত দশ-পনেরো দিন আগে। হঠাৎ একটা মেসেজে চোখ আটকে গেল! কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির নিরিখে কলকাতা নাকি ১০০ তে মাত্র ৩ পেয়ে সারা ভারতে লাস্ট হয়েছে। স্বভাবতই একজন বাঙালী হিসেবে যাকে বলে প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন! তেড়েফুঁড়ে খোঁজ-খবর শুরু করলাম। যে শহরের আনাচে কানাচে এগিয়ে বাংলা, বিশ্ববাংলার ঢাউস ঢাউস হোর্ডিং, উন্নয়ন যেখানে অলিতে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকে তাকে কি না ১০০ তে মাত্র ৩ দেওয়া। পাক্কা কোন বাংলা বিরোধী শক্তির কারসাজি! কিন্তু খুঁজতে গিয়ে আসল সত্যিটা যখন সামনে এল তখন বুঝলাম মোবাইলে আসা মেসেজটা আসলে ছিল হিমশৈলের চূড়া মাত্র!

কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষমাত্রাকে সামনে রেখে ১৭ টি সূচক নির্দিষ্ট করেছে। এরমধ্যে রয়েছে দারিদ্র, ক্ষুধা, স্বাস্থ্য , শিক্ষা, লিঙ্গ বৈষম্য, পরিশ্রুত পানীয়জল এবং নিকাশি ব্যবস্থা, দূষন মুক্ত বিদ্যুৎ-এর ব্যবহার ও যোগান, কর্ম সংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিল্পায়ন -উদ্ভাবন -পরিকাঠামোর বিকাশ, সামাজিক বৈষম্য, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, পণ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং অপচয় রোধ, দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন , জলজ এবং স্থলজ প্রাণ সংরক্ষন , শান্তিপূর্ন পরিবেশ-বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গুলির কার্যকারিতা এবং সবচেয়ে শেষে উন্নয়নের লক্ষে পারস্পরিক সহযোগিতা।

আর এই সূচকগুলির নিরিখেই গত নভেম্বর মাসের ২৩ তারিখ দেশের ৫৬ টি শহরের মূল্যায়নের একটি তালিকা নীতি আয়োগ প্রকাশ করেছে। আর সেই তালিকাতেই আমাদের শহর কলকাতা কর্ম সংস্থান এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে সত্যি সত্যি ১০০ তে মাত্র ৩ পেয়েছে। শুধু তাই নয় দারিদ্র ও ক্ষুধার সূচকেও লাল কালির দাগ। এছাড়া লাল কালির দাগ রয়েছে শিল্পায়ন উদ্ভাবন ও পরিকাঠামোর বিকাশেও। আর স্বাস্থ্য , সামাজিক বৈষম্য এবং দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন সূচকগুলিতে যাকে বলে কানঘেঁষে পাশ। যে শহরে ডাবল ডাবল চাকরির প্রতিশ্রুতি ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই কলকাতার যুবক-যুবতীদের সিঙ্গল-সিঙ্গল চাকরির স্বপ্নও কি বাস্তবায়িত হচ্ছে না তাহলে! অন্তত নীতি আয়োগের সূচক তাই বলছে!

এটা দেখে আমার মতো শহুরে মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীদের মাথায় সবার প্রথমে যে চিন্তা আসবে তা হল তাহলে কি আমরা কলকাতাবাসী দিনকে দিন গরীব হয়ে যাচ্ছি! খেতে-পড়তে পাবো না আর কদিন পর! আর যদি খোদ কলকাতার এই অবস্থা হয় তাহলে রাজ্যের অন্যান্য গ্রাম-গঞ্জের অবস্থা তো আরও শোচনীয় হওয়ার কথা! আর সেটা খুজতে গিয়েই নীতি আয়োগের ওয়েবসাইট থেকেই হাতে এল আরও দুটি সমীক্ষার রিপোর্ট।

প্রথম যেটির কথার বলবো সেটি হল গত জুন মাসে প্রকাশিত নীতি আয়োগের ঐ উপরিল্লেখিত ১৭ টি সূচকের নিরিখে সমগ্র ভারতবর্ষের ২০২০-২১ সালের রাজ্যওয়ারি খতিয়ান। এই রিপোর্টে যা রয়েছে তা হল জলজ প্রাণ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের লক্ষে পারস্পরিক সহযোগিতা এই দুটি সূচককে এবারের মত বাইরে রেখে বাকি ১৫ টি সূচকের নিরিখে দেশের ২৮ টি রাজ্য এবং ৮ টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। আর তাতে চোখ বুলিয়ে আমি তো অবাক! ঐ ১৫ টি সূচকের মধ্যে ১০ টি সূচকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্ত নম্বর দেশের জাতীয় গড়ের থেকে কম। এর মধ্যে দারিদ্র, ক্ষুধা, শিক্ষা, পানীয়জল থেকে শুরু করে নিকাশি ব্যবস্থা, লিঙ্গ বৈষম্য কি নেই! সঙ্গে কর্ম সংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং শিল্প -উদ্ভাবন ও পরিকাঠামোর বিকাশ সূচক দুটি তো আছেই। গোদের ওপর বিষফোড়ার মত দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতায়ও আমরা দেশের জাতীয় গড়ের নীচে। দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে আমাদের স্থান ১৮। আর সঙ্গে দশটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মুল্যায়ন যোগ করলে আমরা গিয়ে দাঁড়াবো ২৫ এ। এই হল মোটের ওপর “এগিয়ে বাংলা” র আসল রূপ!

এবার আসি সেই দুটি রাজ্যের কথায় যাদের নেতারা কিছুদিন আগে পর্যন্ত “সোনার বাংলা” গড়তে আকাশ পথে আমাদের রাজ্যে প্রায় বলা যায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতেন । একটি হল উত্তরপ্রদেশ এবং অন্যটি মধ্যপ্রদেশ। ঘটনাচক্রে এই দুটি রাজ্যও ঠিক বাংলার মতন ১৫ টির মধ্যে ১০ টি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে দেশের জাতীয় গড়ের পিছনে। সার্বিক মূল্যায়নের নিরিখে উত্তরপ্রদেশ রয়েছে বাংলার অনেক পিছনে ২৫ নম্বরে আর মধ্যপ্রদেশ রয়েছে বাংলার গায়ে গায়ে একধাপ ওপরে ১৭ নম্বরে। আর গুজরাট মডেলের বুক বাজানো সমর্থকদের জানাই ক্ষুধা, শিক্ষা এবং সামজিক বৈষম্যর মত গুরুত্বপূর্ণ সূচক সহ মোট ৫ টি ক্ষেত্রে গুজারাটও কিন্তু জাতীয় গড়ের নীচে রয়েছে। সার্বিক উন্নয়নের ভিত্তিতে তালিকায় ১০ নম্বরে ঠাঁই হয়েছে।

তুলনায় দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি রাজ্য বাকি ভারতের রাজ্যগুলির থেকে বলা যায় অনেকটাই এগিয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশ হল সেই রাজ্য যারা সব কটি সূচকে জাতীয় গড়ের ওপরে রয়েছে। সর্বভারতীয় তালিকায় পেয়েছে চতুর্থ স্থান। তামিলনাড়ু হল আরেকটি রাজ্য যার আয়তন ও জনসংখ্যা আমাদের রাজ্যের সাথে তুলনীয় বলা যায়। তারাও ১৩ টি সূচকে জাতীয় গড়ের ওপরে রয়েছে। সার্বিক উন্নয়নের নিরিখে পেয়েছে তৃতীয় স্থান। কর্নাটক মাত্র একটি সুচকে জাতীয় গড়ের নীচে। সার্বিক উন্নয়নের নিরিখে পেয়েছে ষষ্ঠ স্থান। তেলেঙ্গানার মত সদ্যজাত রাজ্যও পাল্লা দিচ্ছে গুজরাটের সাথে। রয়েছে একাদশতম স্থানে। আর সার্বিক উন্নয়নের নিরিখে দেশের মধ্যে প্রথম বাম শাসিত কেরালা

এবার আসা যাক দ্বিতীয় সমীক্ষার রিপোর্টে। এটি হল ২৪ শে নভেম্বর ঐ নীতি আয়োগের তরফেই প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্রসূচকের নিরিখে দেশের ২৮ টি রাজ্য এবং ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মূল্যায়ন। বহুমাত্রিক সূচক কারণ এখানে অপুষ্টি, শিশু ও কৈশোর অবস্থায় মৃত্যু , মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, স্কুলে হাজিরা, জ্বালানী, পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবহার , বিদ্যুৎ সংযোগ, কাঁচা-পাকা বাড়ি, শৌচাগারের উপস্থিতি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ব্যবহার এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ- এই এক ডজন মানদণ্ডের ভিত্তিতে দারিদ্রতার সংজ্ঞাকে একটা সার্বিকরূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আর এই রিপোর্টেও বলা যা সেই একই অভিজ্ঞতার জলছবি। বাম শাসিত কেরলায় দারিদ্রতার হার সর্বনিম্ন। মাত্র ০.৭১ শতাংশ। যথারীতি দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি বাকি ভারতবর্ষের থেকে অনেক এগিয়ে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেই তামিলনাড়ু। আকারে ও জন সংখ্যায় আমাদের বাংলার সমতুল এই রাজ্যে দারিদ্রতার হার মাত্র ৪.৮৯% । সেখানে আমাদের বাংলায় দারিদ্রতার হার ২১.৪৩% । আরও জানলাম বাংলার প্রায় ৩৩% মানুষ ঠিক মতন দুবেলা খেতে পায় না। অপুষ্টির স্বীকার। প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিবারের পাকা বাড়ি নেই। আর ৩২ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব শৌচাগার নেই।

এপ্রসঙ্গে এটাও জানিয়ে রাখি ১৯৭৭ সালে বামেরা যখন পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় এসেছিল তখন কমবেশি ৬৫% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করতেন। আর বামেরা যখন ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছিল ২০% এর আশপাশে । অর্থ্যাৎ গত একদশকে অনেক প্রত্যাশা জাগিয়ে ক্ষমতায় এসেও বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে মানব সম্পদ উন্নয়নের নিরিখে বাংলার তেমন কোন সার্বিক উন্নতির লক্ষণ অন্তত সূচকগুলিতে চোখ বোলালে এই মুহুর্তে চোখে পড়ছে না। বরং পশ্চাতগমনটাই ক্রমশঃ প্রকট হচ্ছে। আর কেরালার বাম সরকারের সাফল্য কোন অস্বাভাবিক অঘটন নয়। এটা একান্তই বাম বিকল্প অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন যা এর আগে বাংলাতেও ঘটেছে।

পরিশেষে বলি, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি নিয়ে একদিন একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথার বিনুনি বুনে বাংলার মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমগুলি যথাযথ বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা এড়িয়ে না গেলে আমরা আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম। “রাইস অফ ভয়েসেস” টিমের পক্ষ থেকে সাধ্যমত তথ্যগুলি নীতি আয়োগের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করে আপনাদের সামনে রাখলাম। যা যা লিখলাম আপনারা নিজেরাও নীতি আয়োগের ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখে নিতে পারেন। তাই আলাদা করে তথ্যসূত্র দিচ্ছি না।

লেখাটি যদি ভালো লাগে, শেয়ার করে অন্যকে পড়বার সুযোগ করে দেবেন।