রক্তাক্ত রেড ভলেন্টিয়ার্স / Attack on Red Volunteers

মহামারী যখন সরকার বাহাদুরের বদান্যতায় আমাদের ঘরে পুরে ফেললো, সামাজিক দূরত্বের নামে আমরা নিজেদের মধ্যে যখন এক অন্য আত্মকেন্দ্রিক “আমি”কে খুঁজে পেলাম, মহামারী আক্রান্ত স্বজন-প্রতিবেশীর আর্ত চিৎকারে বিন্দুমাত্র কর্নপাত না করে আমরা যখন ডালগোনা কফি বানানোর রেসিপি কিম্বা পোষ্যদের সাথে সেলফি আপলোড করছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ায় আর লাইকের সংখ্যা গুনছিলাম, হাসপাতালে বেড-অক্সিজেন না পাওয়া ছুটে বেড়ানো আক্রান্ত পরিচিতদের পাশে না দাঁড়িয়ে আমরা যখন বারান্দা থেকে গাড়িঘোড়াহীন দূষণমুক্ত লকডাউন মোড়া পৃথিবীকে উপভোগে ব্যস্ত, এমনকি মহামারীতে স্বজন-হারানো পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনের পাশে গিয়েও দাঁড়াচ্ছিলাম না; পাছে “ভাইরাস” ধরে এই ভয়ে, ঠিক তখন একদল “বাপে তাড়ানো মায়ে খ্যাদানো” ছেলেমেয়ে “মৃত্যুভয়”কে ফুঁকে দিয়ে দরজা খুলে রাস্তায় নেমেছিল। ওষুধ-অক্সিজেন-খাবার নিয়ে পৌঁছেছিল সামজিক ভাবে “বয়কট” হয়ে যাওয়া মহামারী আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে। লকডাউনে কাজ হারানো “দিনআনি দিনখাই” মানুষ গুলোর মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে পাড়ায় পাড়ায় শুরু করেছিল শ্রমজীবী ক্যান্টিন। সবাই যাতে সুলভে ফল-সব্জি পায়, তার জন্য অলিতে-গলিতে চালিয়েছিল শ্রমজীবী বাজার। সোচ্চারে স্লোগান দিয়েছিল –“কেউ খাবে কেউ খাবে না /তা হবে না তা হবে না”। এই ছেলেমেয়ে গুলোই রেড ভলেন্টিয়ার্স। রাজ্য জুড়ে এমন কমবেশি কয়েক লক্ষ ছেলেমেয়ে আজ এগিয়ে এসেছে রেড ভলেন্টিয়ার্স হয়ে।

আর হ্যাঁ। লুকোচুরির কোন ব্যাপার নেই। এরা সিপিআই(এম)। আর এটাই বোধহয় এদের একমাত্র অপরাধ! তাই প্রথমদিন থেকে শুরু হল রাজনৈতিক মদতপুষ্ট লুম্পেনদের দাপাদাপি। প্রথম শুরু হল সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা। বলা হল এরা এনজিও/ক্যাটারিং সার্ভিস। তাতে পাত্তা না দেওয়ায় শুরু হল তরুণী-যুবতী ভলেন্টিয়ার্সদের ফোন করে অশ্লীল হুমকি। পুরুষ ভলেন্টিয়ার্সদের বাড়ির মা-বোন-বউদের শাসানি। কিন্তু এতেও থামছে না দেখে শেষে, ইদানীং লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে অলি-গলি-পাড়ার গুন্ডা মস্তানদের। সাইক্লোনের খবর করতে দীঘা-শঙ্করপুর সী-বিচে পৌছে যাওয়া মিডিয়া অবশ্য এই সব খবর খুজে পায় না। কিন্তু করোনা মহামারীর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে “মস্তানি” করা রেড ভলেন্টিয়ার্সদের এভাবে থামানো যায় না। আর সেটা জানাতেই রাইস অফ ভয়েসেস এর আজকের প্রতিবেদন।

সাম্প্রতিকতম আক্রমণের ঘটনাটি ঘটেছে রানাঘাটে। গত রবিবার, ২৮শে নভেম্বর, রানাঘাট কোর্ট মোড়ে রাত ১১টা নাগাদ, বেশ কিছু মদতপুষ্ট প্রভাবশালী দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হলেন রেড ভলেন্টিয়ার্সের অন্যতম যুগ্ম কনভেনার শুভঙ্কর বসু সহ আরও চারজন কমরেড, শুভায়ন গুহ, সোমশুভ্র চট্টোপাধ্যায়, অরিজিৎ দত্ত এবং জয় সরকার। রেড ভলেন্টিয়ার্সদের অন্যান্য সদস্য এবং রানাঘাট থানার আইসির তৎপরতায় আক্রান্ত ৫ জনকে উদ্ধার না করা হলে আক্রান্তদের প্রাণ সংশয় হতে পারত, জানালেন রানাঘাট অঞ্চলের রেড ভলেন্টিয়ার্সের অপর যুগ্ম কনভেনার সুভাষ রায়।

কিন্তু “অন্যায় যখন নিয়ম হয়, প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়”। আর তাই পরদিন, অর্থাৎ ২৯শে নভেম্বর রেড ভলেন্টিয়ারদের ওপর এই বর্বরোচিত আক্রমণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল গোটা রানাঘাট। পৌরসভার সামনে থেকে বিকালে শুরু হয় এক বিশাল মৌন মিছিল। মিছিলে পা মেলান রানাঘাট শহরের বুদ্ধিজীবী, নাট্যজগত এবং শিক্ষা জগতের বিভিন্ন দিকপালরা। দুষ্কৃতীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এই মিছিল শহর পরিক্রমা করে, কোর্ট মোড় হয়ে থানার সামনে এসে সংক্ষিপ্ত সভার মাধ্যমে শেষ হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়িকা রমা বিশ্বাস, বিশিষ্ট আইনজীবী দেবাশীষ চক্রবর্তী এবং গণআন্দোলনের নেতৃত্ব কমল ঘোষ । সমগ্র সভা পরিচালনা করেন গণআন্দোলনের নেতৃত্ব ও রেড ভলেন্টিয়ারদের স্থানীয় আহ্বায়ক সুভাষ রায়।

কিন্তু তারপর?

সেই প্রভাবশালী দুষ্কৃতীরা এই মুহূর্তে জামিনে মুক্ত। রেড ভলেন্টিয়ার্সরাও করে চলেছে তাদের চিরাচরিত কাজগুলো। কিন্তু এই দুষ্কৃতীদের ক্ষমতাচ্যুত করা এখন আমার-আপনার মত মানুষের কাজ !

পুনঃশ্চঃ আজকের ঘটনার কোন তথ্যসূত্র আমাদের কাছে নেই। কারণ বাংলার কোনও সংবাদ মাধ্যমে এই খবরটা বড়-ছোট কোন আকারেই আমরা দেখতে পাই নি। সিপিআই(এম) ডিজিটালে গতকাল আপলোড হওয়া একটি ভিডিও দেখে, আক্রান্ত রেড ভলেন্টিয়ার্সদের স্থানীয় যুগ্ম কনভেনর কমরেড সুভাষ রায়ের সাথে রাইস অফ ভয়েসেস এর তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে, ফোনে যা জানালেন তার ভিত্তিতেই এই খবর আপনাদের সামনে আনলাম।