বাঙালির ধনতেরাস / From Gold To Broom
বাংলায় চলছে ধনতেরাস। ছোটবেলা কাটিয়েছি দক্ষিণ কলকাতায়, তখন জানতাম, ধনতেরাস মানে বিশেষত উচ্চবিত্ত বাঙালীদের সোনা, রূপো কেনার উৎসব। আমার ছোটবেলায় অবশ্য বাবার বাড়িতে ধনতেরাসের চল ছিল না, বাবার বাড়ি কেন, তখন পুরো পড়াতেও ছিল না। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এসেও দেখিনি, ধনতেরাস নিয়ে কোনোরকমের মাথাব্যাথা। কিন্তু এক অদ্ভুত সামাজিক পরিবর্তন দেখলাম কাল সন্ধেবেলায়, সংসারের জন্যে টুকিটাকি কিনতে বেরিয়ে।
রাস্তায় বিরাট ভিড়, হাজার হাজার সাদা কালো মাথার মহিলা-পুরুষের ভিড়। আর প্রায় প্রত্যেকের হাতে ঝাঁটা। কালীপুজোর আগে ছোটবেলায় মায়ের সাথে যেমন ঘর পরিষ্কার করেছি, এখনো সেই দায়িত্ব পালন করি শাশুড়ির সাথে। কিন্তু আমার, আমার মায়ের বা শাশুড়ির কোনোদিন মনে হয়নি কালীপুজোর আগে নতুন ঝাঁটার প্রয়োজনীয়তা। সে তখনও পড়ে থাকতো ঘরের এক কোনায়, আজও সেখানেই। কিন্তু বঙ্গ জীবনে ঝাঁটার প্রয়োজনীয়তা গত কয়েক বছরে কিভাবে অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল, তার সঠিক কারণ এই মুহূর্তে আমার মাথায় আসছে না। আমরা কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছি? হারিয়ে ফেলছি কি বাঙালির নিজস্বতা? অবাঙালি সংস্কৃতি কি গ্রাস করছে আমাদের? এমনটা তো কখনো ছিল না। নাহ্, কাউকে কোনোরকম আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার নেই। শুধু মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে কয়েকটা প্রশ্ন তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত, ধনতেরাস উপলক্ষে সোনা-রুপো থেকে ঝাঁটা কেনার প্রয়োজনীয়তা আমার মধ্যে কোনদিনই আসেনি, তাতে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে অসুবিধা হয়নি।
তাহলে? এত ঝাঁটা কেনার ধুম কেনো? একটা সময়ে খবরের কাগজে, বড় বড় হোর্ডিংয়ে গয়নার দোকানের বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন দেখে ধনতেরাসকে সোনা-রুপো কেনার উৎসব বলে মনে হলেও, এই বছর বাজারে বেরিয়ে এই ধারণা আমার সম্পূর্ণ ভেঙে গেলো। মনে হঠাৎ করেই একটা বিশ্বাস জন্মে গেল, ধনতেরাস মানে বাঙালির নতুন ঝাঁটা কেনার উৎসব।
উৎসবের এই পরিবর্তনটা খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, আমার ছোটবেলায় ধনতেরাস ছিল অবাঙালিদের সোনা-রুপো কেনার উৎসব, তারপর সেটা হল বাঙালি-অবাঙালি সবার সোনা-রুপো কেনার উৎসব থেকে যে কোন ধাতু কেনার উৎসব থেকে স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের বাসন কেনা হয়ে, আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ঝাঁটা কেনার উৎসবে। এতে লক্ষ্মী লাভ হবে তো?
সংসারে আয় কমলে, ভালো থাকার জিনিসগুলোর সাথেও কম্প্রোমাইজ করতে হয়, এটা মেয়েদের চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝে বলে আমার মনে হয় না। তাই মানুষের যত আয় কমছে, ধনতেরাসের বাজেটও সেই অনুপাতে কমছে। তাই সোনা রুপো কেনার উৎসব আজ এসে দাঁড়িয়েছে নতুন ঝাঁটা কেনার উৎসবে।
যে দেশে ধর্ষকদের মালা পড়িয়ে বরণ করা হয়, যে রাজ্যে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের চাকরি চুরি হয়, যে রাজ্যের মহিলাদের স্বাবলম্বী না বানিয়ে অবলম্বী হওয়ার উৎসাহ দেওয়া হয়, যে রাজ্যে মহিলা অভিভাবিকা প্রশ্ন করলে বিধায়ক তাকে “বিপ্লবী” বলে চুপ করিয়ে দেয়, তখন বোঝা যায়, এই রাজ্যে ধনলাভের প্রতীক সোনা-রুপো হওয়ার দিন শেষ। কারণ সেই সব “ধন” বর্তমানে রাজনৈতিক সমাজসেবীদের ব্যাঙ্কের লকারে।
অনেকেই ভাবে আমরা ঘরের বউরা সাধারণভাবে খুন্তি ধরি, প্রকাশ্যে কলম ধরি না। কিন্তু বাড়ির বাচ্চাকে শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ তো আমাদেরকেই দিতে হয়। আর তারাই যখন ন্যায্য চাকরি চাইতে গিয়ে গভীর রাতে পুলিশের হাতে নিপীড়িত হয়, তখন খুব রাগ হয়, কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। বাঙালিরা তো লড়াই করতে জানত, ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারত। কিন্তু বারে বারে এমন অসহায় আত্মসমর্পণ কেন? কেন বারে বারে শাসকের সামনে হাতজোর করা? কোথায় গেল সেই নাছোড় মনোভাব? আছে, এখনো আছে, সংখ্যায় কম হলেও আছে। এখনো অনেক মানুষের হৃদয়ের গভীরে আজও লুকিয়ে আছে বাঙালি সত্তা। একে ধ্বংস করতে কি দেওয়া যায়! তাই আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাঙালি সত্তা বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, আপনি কি করবেন, সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ধন্যবাদান্তে,
সুমনা ঘটক
Comments are closed.