শাহজাহান, বাড়ি আছো? / Where are you?

“হেলে ধরতে পারে না, গেছে কেউটে ধরতে।”

যাঁর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল তিনি সসম্মানে পাম অ্যাভিনিউর ছোট্ট ফ্ল্যাটে বয়সের ভারে শয্যাশায়ী। দলমত নির্বিশেষে যাঁরাই ওনার সাক্ষাৎপ্রার্থী হন, প্রত্যেকে বেরিয়ে এসে মিডিয়ার বুম-ক্যামেরার সামনে জানাতে ভোলেন না যে, তেনার সাথে দেখা করে এলাম! তাদের চোখেমুখে থাকে মূল্যবোধের রাজনীতির এক বিগ্রহের সম্মুখে দাঁড়াতে পারার তৃপ্তি।

আর যিনি বলেছিলেন তিনি সবার আগে নাম লিখিয়েছিলেন কেউটের দলে, তারপরে এখন জলঢোঁড়া হয়ে বিলাপ বকছেন। লোকে বলে তিনি আপাতত ছিন্নমূল। তাঁর নিজের দক্ষিণ ২৪ পরগণায় জেলায় তাঁরই নাকের ডগায় এখন কেউটের দল কিলবিল করছে। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একই অবস্থা দেশের দুই অত্যন্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই এবং ইডির। তারাও এই জেলারই সন্দেশখালিতে এক কেউটের খোঁজে এসে দিশাহারা। ঘটনাচক্রে সেই কেউটের নাম শেখ শাহজাহান, মানে তিনি সংখ্যালঘু। তাতে অবশ্য গপ্পোটা বিশেষ পালটায় না। শুধু ‘রোহিঙ্গা’ বলে দেগে দেওয়া যায় আর ভোটবাজারে কিছু এক্সট্রা ভোট কুড়নো যায়। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে শেখ না হয়ে ‘ব্যানার্জ্জী’র মত সংখ্যাগুরু ‘সততার প্রতীক’ ব্রাক্ষণ হলে আদৌ ধরতে যাওয়াটাই বোধহয় একটা কষ্ট কল্পনা হয়ে দাঁড়ায়! ঐ মাঝেমধ্যে নেমতন্ন করে সিজিও কমপ্লেক্সে নেমতন্ন করে ডেকে পাঠানো! এলে ভালো, না এলে আবার পরবর্তী তারিখের অপেক্ষা। মানে উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট! ভোট আসবে, ভোট যাবে আর তার সাথে যাতে ‘হচ্ছে-হবে’ ব্যবস্থাটা জারি থাকে, সেটা সুনিশ্চিত করা!

তা যাই হোক, সেটা অন্য প্রসঙ্গ! আজ আমরা আপাতত সন্দেশখালি আর শাহজাহানে থাকি। কারণ সংখ্যালঘু মুখ থাকলে বেশ একটা ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ ভাব আসে। বেশ একটা ‘ঘুঁসকে মারেঙ্গে’ টাইপ মেজাজ পরিলক্ষিত হয় বাসে-ট্রামে, পাড়ার চায়ের দোকানে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই জনতাকে কিছুটা হলেও হতাশ হতে হয়েছে। কারণ ‘ইডি’ সন্দেশখালিতে নিয়োগ দুর্নীতি কান্ডে শেখ শাহজাহানের বাড়ি তল্লাশি চালাতে ঘুঁসে’তো ছিল ঠিকই, কিন্তু উল্টে পাল্টা মার খেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে এসেছে। আর তারপর দু সপ্তাহ অতিক্রান্ত। ইডি’কে পিটিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া সন্দেশখালির শাহজাহান এখনও ‘বেপাত্তা’। এর মধ্যে সদর্থক পদক্ষেপ বলতে আদালতে ছোটাছুটি করে ইডির হাতে যেটা এসেছে সেটা হলো একটা ‘সিট’। ঠিক হয়েছে রাজ্য পুলিশ ও সিবিআই এর এসপি পদমর্য্যাদার দুজন অফিসারের নেতৃত্বে বিশেষ টিম বা ‘সিট’ শাহজাহানকে খুঁজবে! যদিও আপাতত আমাদের কাছে যা খবর, তা হল সিবিআই এই মুহুর্তে ‘সিট’ এর জন্য অফিসার খুঁজছে।

রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপি সন্দেশখালি কান্ডে প্রথমে দু এক দিন সাধ্যমত প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করেছে। টাইমিং এর কথা যদি ওঠে তাহলে বলতেই হয় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি তাদের প্রতিপক্ষ অপর বিরোধীদল বামেদের মানে সিপিআই(এম)র থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে। বামেদেরকে সন্দেশখালি কান্ডে এখনও পর্যন্ত স্থানীয় স্তরে কোন মিটিং-মিছিল করতে দেখা যায়নি। অথচ ঘটনার একদিনের মাথাতেই সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা বাইক মিছিল করে স্থানীয় ন্যাজাট থানা অভিযান করেছে। সঙ্গে ছিল শুভেন্দু অধিকারীর ‘রোহিঙ্গা’ ট্যুইট ও ট্যুইস্ট। বিজেপি ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম ও ইউটিউবারের দলও ইডি-সিবিআই শাহজাহানকে ‘এই ধরল বলে’, ‘আজ রাতেই শাহজাহানের খেলা শেষ’,‘কেন্দ্রীর বাহিনী-সিআরপিএফ-বিএসএফ এমনকি বাংলাদেশে ভারতের গোয়েন্দারাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে’ গোছের সব আজগুবি থ্রিলার চালিয়ে চালিয়ে কয়েকদিন বাজার গরম রেখেছিল। কেউ কেউ তো রাত বারোটার সময় ‘এই মাত্র খবর পেলুম’ গোছের লাইভও করেছে ফেসবুক-ইউটিউবে। মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী মহাশয়ও প্রথম দিকে তাঁর এক সময়কার দলীয় সহকর্মী শাহজাহানের সাঙ্গপাঙ্গদের হদিশ, গোপন আস্তানার ঠিকানা প্রভৃতি গড়্গড় করে সংবাদমাধ্যমে জানাচ্ছিলেন। কিন্তু দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে এনারা সবাই একরকম ‘হেদিয়ে গিয়ে শাহজাহান কান্ডে ক্ষ্যামা দিয়েছেন। আর তাই জনমানসে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে হাজারো প্রশ্ন! রাজ্য পুলিশ না হয় শাসক তৃণমূলের ‘দলদাস’, তৃণমূলী শাহজাহান কে লুকিয়ে রেখেছে! কিন্তু এত কিছু জানবার পরেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ও তাদের বিভিন্ন বাহিনী কেন শাহজাহানকে খুঁজে পাচ্ছে না? তবে কি সেটিং! মানে সবকিছু জেনে শুনেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থা ইচ্ছে করে শাহজাহানকে ধরছে না! আর আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর তিনটে ‘কর্ম’দিবস কেটে গেলেও সিবিআই এর তরফে সিটের জন্য অফিসার মনোনয়নে গড়িমসি সেই জল্পনাতেই ঘি ঢেলেছে।

আর এসব হট্টগোলের মধ্যেই ‘শূন্য’ বামেদের ইদানীং অতি সক্রিয় হয়ে ওঠা সোশ্যাল মিডিয়া সেল শেখ শাহজাহানের সাথে ‘তৃণমূল নেতা’ শুভেন্দু অধিকারীর একটি হলায় -গলায় ছবি ভাইরাল করে দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে তথাকথিত ‘রোহিঙ্গা’র সাথে আজকের বিজেপির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলে থাকাকালীন কি করছিলেন! কারণ যিনি ২০২৪ শে ‘রোহিঙ্গা’, তিনি ২০২০ এর আগেও তাই ছিলেন। আর তাতেই বিজেপি ও শুভেন্দু শিবির ঘেঁটে ‘ঘ’। ভাগ্যিস ‘অযোধ্যা-রামমন্দির’ এসে গেলো, তাই শুভেন্দু অধিকারীরা ঝাঁটা-ন্যাতা-বালতি হাতে একছুটে মন্দিরে পালিয়ে বাঁচলেন। না হলে কপালে দুঃখ ছিল।

যদিও এরপরও তৃণমূল ও বিজেপি শিবিরের অস্বস্তি যাচ্ছে না। যত দিন গড়াচ্ছে ততই সেটা বাড়ছে। ইতিমধ্যেই এক জনপ্রিয় বাংলা নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক শেখ শাহজাহানের ডেরায় ঢুকে সন্দেশখালি কান্ডে প্রধান অভিযুক্তদের একজন তথা শেখ শাহজাহানের ‘ডানহাত’ এর সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন শেখ শাহজাহান সন্দেশখালিতেই আছেন। এমনকি সন্দেশখালির প্রাক্তন সিপিআইএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দারও শেখ শাহজাহান কোথায় কিভাবে গিয়েছেন, কোথায় আছেন, কোথায় যেতে পারেন সব ধরে ধরে বলে দিচ্ছেন। আর এতকিছুর পরও রাজ্য সরকারের পুলিশ আর কেন্দ্রীয় এজেন্সি, কিছুই করতে পারছে না এটা মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন!

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস বিশ্বাস করি, হেলে হোক বা কেউটে, চাইলে পুলিশ প্রশাসন সবই ধরতে পারে। শুধু শাসকের ইচ্ছে’টা থাকা চাই। আর সন্দেশখালিকান্ডে শুধু শাহজাহান নয়, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় শাসকের শাহজাহানকে ধরবার সেই সদিচ্ছাটাও মিসিং!

এভাবে আর বেশিদিন চললে রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসক তৃণমূলের ও বিজেপির সৌজন্যে এমন ‘রাম’ময় মুহুর্তেও “না আছে সেই রাম, না আছে সেই অযোধ্যা” এই পুরানো আপ্তবাক্যটাই জাঁকিয়ে বসবে বাংলার জনমানসে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস