ডিএ বনাম মেয়ে / Dearness Allowances In Bengal

সম্প্রতি আমরা দেশের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছি। মুদ্রাস্ফীতিতে। খুচরো বাজারের ক্রেতামূল্য সূচকের নিরিখে দেশের ২৮ টি রাজ্য ও ৮ টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে দশ গোল দিয়ে, এপ্রিল ও মে, এই দুই মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৮.৮৫% এবং ৯.১২%। এর মধ্যে আবার দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধির হার শহরাঞ্চলের থেকে বেশি এবং সেটা ঘোরাফেরা করছে ১০% এর ওপরে।

এদিকে এই মুদ্রাস্ফীতির সাথে লড়াই করে বাঁচবার জন্য যে মহার্ঘ্যভাতা বা ডিয়ারনেস অ্যালোয়েন্স, যাকে চলতি ভাষায় আমরা ডিএ বলে থাকি, রাজ্য সরকারী কর্মচারীরা পেয়ে থাকেন, তা আমাদের রাজ্য সরকার কিছুতেই দিতে রাজী নয়। এমনকি একটা সময় বর্তমান সরকার জানিয়ে দিয়েছিল এই ডিএ দিতে সরকার নাকি আইনত বাধ্য নয়। ডিএ দেওয়াটা কোষাগারের সামর্থ্য অনুযায়ী সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। যদি মনে করে, তবে দেবে, যদি না মনে করে, তবে দেবে না। যদি সামর্থ্য থাকে দেবে, যদি কোষাগারে যথেষ্ট টাকাপয়সা না থাকে, তাহলে দেবে না। যদিও বিগত বাম সরকারের আমলে ২০০৯ সালের বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাস (রোপা) নিয়মানুসারে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় হারে রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা দিতে বাধ্য।

আর এই কথাটাই সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট ফের একবার মনে করিয়ে দিয়ে বলেছে, মহার্ঘ্যভাতা পাওয়াটা সরকারী কর্মচারীদের আইনি অধিকার। এটা কোন দয়ার দান নয়, যা বর্তমান সরকার মনে করে। এমনকি কোর্টের রায়ে একথাও বলা হয়েছে, যেহেতু সম্মানজনক জীবনযাপনের জন্য মূল্যবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে মহার্ঘ্যভাতা দেওয়া হয় এবং সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকারটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত, তাই মহার্ঘ্যভাতা পাওয়ার অধিকারটি শুধুই আইনি অধিকার নয়, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারও বটে।

কিন্তু এতকিছুর পরও সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্যসরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা দিতে নিমরাজি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বা বলা যায়, সর্বোচ্চ স্তর থেকে যে ধরণের বিভ্রান্তিমূলক প্রচার বশংবদ মিডিয়াকে হাত করে লাগাতারভাবে চালানো হচ্ছে, তাতে রাইজ অফ ভয়েসেসের মনে হয়েছে এব্যাপারে কয়েকটি কথা বলা জরুরি। তাই আমরা চেষ্টা করছিলাম বিভিন্ন রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের সাথে কথা বলতে। নাম না প্রকাশ করবার শর্তে তাঁদেরই কেউ কেউ আমাদের সামনে মুখ খুলেছেন এবং সেই কথাবার্তারই একটা সারমর্ম আপনাদের জন্য বাংলার খুঁটিনাটিতে।

বিভিন্ন খবরের কাগজে এবং সমাজ মাধ্যমে মহার্ঘ্যভাতা না দেওয়ার পেছনে প্রথমেই যে যুক্তিটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা হল সরকারী কোষাগারে টাকা বাড়ন্ত, তাই “ডিএ” র টাকা দেওয়া যাবে না। আসলে এর অদৃশ্য কারণ হল, “ডিএ”র টাকা দিতে গেলে জনপ্রিয় সামাজিক প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো চালানো যাবে না।

এই প্রসঙ্গে আমরা যে উত্তরগুলো পেয়েছি তার সারমর্ম হল এইরকম।

গত বাজেটে সরকারের তরফে যে হিসাব পেশ করা হয়েছিলো তাতে অনেক রাজস্ব বৃদ্ধি ও কোষাগারের স্ফীত অবস্হা দেখানো হয়েছিলো। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের দাবি ছিল, যদি সরকার তবুও মনে করে, ডিএ দিতে গিয়ে টাকার সংকুলান হবে না, তবে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের নেতৃত্বের সঙ্গে খোলাখুলি রাজ্য বাজেটের হিসাব নিয়ে আলোচনায় বসুক। নেতৃত্ব সঠিকভাবে সরকারকে এবিষয়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত।

তাছাড়া ডিএ এর বিষয়টাও তো সরকারী কর্মীদের আইনগত অধিকার এবং কর্মীরা যেহেতু এই সমাজেরই অংশ, তাই ডিএ দেওয়াটা ও সামাজিক কাজ নয় কি? কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, যেমন রাজ্যের লোকেরা পায় তেমনি ডিএ-ও তো রাজ্যের লোকেরাই পাবে, যারা সরকারী কর্মী। সরকারী কর্মীরা কি এরাজ্যের লোক নয়? তাহলে সামাজিক প্রকল্পে যদি রাজ্যের লোক উপকৃত হয়, তবে ডিএ দিলেও রাজ্যের লোকেরই তো উপকার হবে। বরং ডিএ পেলে কর্মীদের সাথে সাথে তার পরিবারের লোকজনও উপকৃত হবে। সরকারী কর্মীরা তো রাজ্যের অন্য সাধারন লোকেদের থেকে আলাদা কেউ নন। তাছাড়া দুয়ারে সরকার, স্বাস্হ্যসাথী বা সকল সামাজিক প্রকল্প যেগুলো সরকার সাফল্য বলে দাবী করছে, সেগুলো মাঠে ঘাটে রাস্তায় অফিসে গিয়ে কাজ করে সফলভাবে রূপায়ন করছে তো সরকারী কর্মীরাই। তাই সমাজের যে অংশটার সার্বিক ভূমিকার জন্য সামাজিক প্রকল্পগুলোর সাফল্য সরকারকে উজ্জ্বল করে তুলছে, সেই সরকারী কর্মচারী অংশটাকেই দীর্ঘ বঞ্চনার মধ্যে রেখে দেওয়া কি আদৌ যুক্তিসঙ্গত? সরকারী কর্মচারীরা যদি পারদর্শী না হতো বা নেতিবাচক হতো তবে কোনো সরকারী প্রকল্পেরই সার্থক রুপায়ণ এবং বাস্তবায়ন সম্ভব হত না।

কাজেই সাধারন জনগন থেকে সরকারী কর্মীদের এভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করে, সরকার তাদের প্রতি বৈমাতৃসুলভ আচরণ করছে। এমনকি সরকারের তরফে জনমানসে সরকারী কর্মচারীদের প্রতি বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই আর্থিক বঞ্চনার বৈধতা খোঁজার একটা সুচারু প্রয়াস চালানো হচ্ছে।

আর এপ্রসঙ্গেই এসে যাচ্ছে দ্বিতীয় প্রোপ্যাগান্ডাটি, যেটা বিগত এক দশক ধরে সরকারী কর্মচারীদের নেতিবাচকভাবে রাজ্যের মানুষের সামনে তুলে ধরছে, আর সেটি হল সরকারী কর্মীরা কাজ করেনা। আর ইদানীং তারা বছরে প্রচুর ছুটি পাচ্ছে। কর্মীরা কাজ না করে এতো ছুটি পেলে তাদের “পুষতে” সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে ডিএ দেবে কেনো?

এখানেও আমরা অত্যন্ত মনোজ্ঞ উত্তর পেয়েছি সরকারী কর্মচারীদের কাছ থেকে।

সরকারী কর্মীরা যে এতো ছুটি পাচ্ছে সেটা ২০১১ সালে সরকার বদল হয়ে নতুন সরকার আসার পর শুরু হয়েছে এবং এইসকল ছুটি বিজ্ঞাপিত হওয়ার জন্য কোনো সরকারী কর্মী সংগঠন দাবী করেনি। সরকারী কর্মীরা এতো কাঁড়ি কাঁড়ি ছুটি চায় না। সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই যে ছুটির সুবিধা কর্মীরা দাবী করেননি, সরকার নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেক করেছেন, সেই ছুটি উপভোগ করার দায়ে সরকারী কর্মীদের অভিযুক্ত করা যায় কি? তাছাড়া সরকার কর্মীদের ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে, তাদের ডিএ দেবে না এমনটা করা যায় কি! ছুটি থাকুক আর না থাকুক, পেট ভরাতে আমাদের সবাইকেই থলে হাতে বাজারে যেতে হয়। সেখানে আমি সরকারী কর্মচারী এবং ছুটি পাই বলে এবং মহার্ঘ্যভাতা পাই না বলে, আমার জন্য চাল-ডাল-আলু-পটলের এক রকম দাম আর জনসাধারণের জন্য আলাদা বর্ধিত দাম হয় কি? কাজেই সরকারী কর্মীরা ২০১০ সাল অবধি যে সরকারী নির্দেশাবলী অনুযায়ী যতোগুলি (অনেক কম — as per WBSR) ছুটি উপভোগ করতেন সেগুলোই বরং তাদের প্রাপ্য করে দেওয়া হোক, কিন্তু ছুটি বাড়িয়ে দিয়ে ডিএ না দেওয়া চলতে পারে না। সরকারী কর্মীদের ছুটি বাড়লে পেট ভরবে না, কিন্তু ন্যায্য ডিএ এবং আর্থিক সুবিধা পেলে তাদের সংসার চলবে।

আর সরকারী কর্মীরা কাজ না করলে এই এতএত সরকারী কাজকর্ম চলছে কি করে! এপ্রসঙ্গে মনে রাখতে বলব এই মুহুর্তে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে যেখানে নিয়োগ বন্ধ। ফলে প্রত্যেক সরকারী কর্মচারীর ওপর কাজের চাপও বাড়ছে। উদাহরণ স্বরূপ এই মুহুর্তে শুধু শিক্ষাদপ্তরেই শূন্যপদ আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। পুরসভা, দমকল, পুলিশ, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন ইত্যাদি প্রায় সর্বত্র একই অবস্থা।
অনেক জায়গায় সিভিক ভলেন্টিয়ারদের মত অস্থায়ী কর্মীদের মাধ্যমে এই সমস্ত শূন্যপদের কাজ করাবার চেষ্টা চলছে, যাদের না আছে অভিজ্ঞতা, না আছে দায়িত্ববোধ। এমনকি এসব নিয়োগও হচ্ছে অসচ্ছ পদ্ধতিতে। শাসক ঘনিষ্ঠদেরই কোন রকম দক্ষতা বা যোগ্যতা না বিচার করেই কাজে নেওয়া হচ্ছে, যার ফলস্বরুপ বহুক্ষেত্রেই স্থায়ী সরকারী কর্মীদের সম্পর্কে মানুষের বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে।

কাজেই সরকারী কর্মচারীরা অফিসে কাজ করে না আর গাদাগাদা ছুটি পায় আর এই যুক্তিতে ডিএ দেব না, এটা আদৌ যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

এবার আসা যাক শেষ পয়েন্টে। রাজ্য সরকারের মতে, কেন্দ্রের সরকার প্রাপ্য টাকা সময় মত দিচ্ছে না। তার ওপর বাম আমলের ২ লক্ষ কোটি টাকা ধারের বোঝা, যার সুদ গুনতেই নাকি সব টাকা চলে যায়। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তাই নাকি ডিএ দেওয়া যাচ্ছে না।

আর এই প্রসঙ্গে কর্মচারীদের বক্তব্য, সরকারী মন্ত্রীরা কি আর্থিক অবস্থার দূর্বলতার জন্য নিজেদের খরচ কমিয়েছেন? আমলারা কি নিজের নিজের অফিস খরচ কমিয়েছেন? এমনকি আইএএস/আইপিএস র‍্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ রাজ্য সরকারী আমলারাও কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের সমান হারে ডিএ পান। যত বৈষম্য শুধুই সাধারণ কর্মচারীদের বেলায়। সরকার কি খেলা-মেলা-দুর্গাপূজা বা ক্লাব খয়রাতির মত খরচ বন্ধ করার কথা ভেবেছে? প্রায় ১২০০-১৩০০ কোটি টাকার ওপর খরচা হয়ে গেছে এই সমস্ত জনতুষ্টিকরণ স্কিম বা অনুষ্ঠানে। তাছাড়া এই যে মুখ্যমন্ত্রী জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করছেন, বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে সেই প্রতিটি বৈঠক পিছু তার এলাহি আয়োজনের পেছনে সরকারের কত কোটি কোটি টাকা খরচা হচ্ছে কেউ কি হিসেব করে দেখেছে!

আর সরকার যদি সত্যি সত্যি রাজ্যের ঋণের পরিমাণের ব্যাপারে আদৌ সচেতন হতেন, তাহলে কি সেই ঋণের পরিমাণ এভাবে বিগত এক দশকে বাড়তে বাড়তে সাড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছাত! আর কেন্দ্রীয় সরকার আজকাল কোন রাজ্যকেই সময়ে প্রাপ্য টাকা দেয় না। তাদেরও হাঁড়ির হাল। বিভিন্ন সরকারী সম্পত্তি বেচে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ডিভিডেন্ড নিয়ে, পেট্রপণ্যের ওপর কর বাড়িয়ে, বাজার থেকে ধার করে কোনরকমে চলছে তাদের। এই মুহুর্তে এমন কোন রাজ্য নেই যার কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে টাকা বকেয়া নেই। কিন্তু সারাদেশে বাংলা আর ত্রিপুরা ছাড়া এমন কোন রাজ্য নেই যারা সরকারী কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা বা ডিএ দিতে এভাবে অস্বীকার করছে।

কানাঘুষো শোনাযাচ্ছে যে সরকার নাকি কলকাতা হাইকোর্টের এই ডিএ সংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে যাবার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ভাবছে। আর তাই রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করে সরকারের উপরতলা হলো কর্মীদের অভিভাবক — তাই সন্তানসম কর্মীদের বিরূদ্ধে এভাবে একের পর এক আইনি লড়াই চালিয়ে তাদের মহার্ঘ্যভাতা পাওয়ার লড়াইটাকে দীর্ঘায়িত করলে সরকারেরই মুখ পুড়বে। এ যেন বাংলার মেয়ে “ডিএ” র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বলে মনে হতে পারে।

কাজেই তা না করে বরং সরকারী কর্মচারী সংগঠনগুলির সাথে বসে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বকেয়া মহার্ঘ্যভাতা দেওয়ার পথ খোঁজাটাই অনেক বেশি জরুরি। এতে সরকারের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র

a) https://epaper.anandabazar.com/imageview_63404_4532260_4_71_21-05-2022_0_i_1_sf.html
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_63414_4122818_4_71_21-05-2022_6_i_1_sf.html
c) https://epaper.anandabazar.com/imageview_63414_41224819_4_71_21-05-2022_6_i_1_sf.html