ইনসাফের রেলগাড়িটা… “মীনাক্ষী এক্সপ্রেস” / Minakshi Express

বিগত প্রতিবেদনে আমরা লিখেছিলাম মীনাক্ষী মুখার্জ্জীকে সামনে রেখে ৩ রা নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া দু’মাসব্যাপী কোচবিহার থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাম ছাত্র-যুবদের পদযাত্রার কথা, যার পোশাকি নাম ‘ইনসাফ যাত্রা’। কারণ সে সময় প্রথমসারির মিডিয়া বা সংবাদপত্র কোন এক “অজ্ঞাত কারনে” বা “সঙ্গত কারনে” তা ‘খবর’ করেনি।

কিন্তু এরপর যত দিন গড়িয়েছে মিছিলের বহর বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের মত বিজেপি অধ্যুষিত এলাকাতে যে বিপুল সাড়া ও অভ্যর্থনা পেয়েছে মীনাক্ষীরা, তা আমরা ইতিমধ্যেই আগের প্রতিবেদনে লিখেছি। উত্তরবঙ্গ সফর সেরে মালদা-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম হয়ে আপাতত ইনসাফ যাত্রা এসে উপস্থিত হয়েছে বর্ধমানে। মালদা-মুর্শিদাবাদ- বীরভূম -বর্ধমান এই চার জেলাতেও ইনসাফ যাত্রা নিয়ে উন্মাদনা ছিল চোখে পড়বার মত। একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যত দিন যাচ্ছে ইনসাফ যাত্রা ধারে ও ভারে পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলের ‘নম্বর-টু’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নবজোয়ার’কে টেক্কা তো দিচ্ছেই এমনকি কোথাও কোথাও ছাপিয়েও যাচ্ছে। আর মুর্শিদাবাদে যা হয়েছে বা এই মুহুর্তে পূর্ব বর্ধমানে যা চলছে তাকে জনজোয়ার বললে অত্যুক্তি হয় না। ফলে গত এক সপ্তাহে বেশ কিছু প্রথমসারির সংবাদপত্র ও চ্যানেল একপ্রকার বাধ্য হয়েই বিক্ষিপ্তভাবে হলেও ইনসাফ যাত্রার কিছু ছবি ও খবর সামনে এনেছে।

কিন্তু জনজোয়ারের ছবি বা ড্রোন ক্যামেরার খন্ডচিত্র দিয়ে ইনসাফ যাত্রাকে মাপতে গেলে ভুল হবে। একটা দল বিগত বারো বছর ক্ষমতায় তো নেই-ই, এমনকি এই মুহুর্তে বিধানসভা বা লোকসভাতে রাজ্য থেকে তাদের নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ‘শূন্য’। আর সেই ‘শূন্য’ পার্টির যুব সংগঠনের এক ‘নন-গ্ল্যামারাস’ ক্যাপ্টেন এবং তার দলবলকে ঘিরে জেলায় জেলায় গ্রামাঞ্চলে এমন উন্মাদনা সত্যিই বিস্ময়কর! রাস্তার ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির মা-বউদের, কচি-কাঁচাদের, কমবয়সই ছেলেমেয়েদের মীনাক্ষীকে ঘিরে উচ্ছ্বাস-পুষ্পবৃষ্টি এবং প্রতিটা মুহুর্তকে মোবাইলে ক্যামেরাবন্দী করবার মরিয়া চেষ্টা অথবা ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধার মীনাক্ষীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া বা গরীব চাষাভুসা পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের আর্তি নিয়ে ইনসাফ যাত্রায় ছুটে আসা, এইসব ছোট ছোট কোলাজই হলো ইনসাফ যাত্রার আসল প্রাপ্তি। এই জনতাকে কেউ পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে ভয় দেখিয়ে তুলে আনে নি। ‘না গেলে ১০০ দিনের কাজের টাকা বা আবাস যোজনার টাকা অথবা লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা দেব না’ বলে ভয়ও দেখায়নি। এই মুহুর্তে ‘শূন্য’ পার্টির সেই ক্ষমতা নেই। তাও মানুষ আসছে মীনাক্ষীদের কাছে। সাংসদ বা বিধায়ক সংখ্যা ‘শূন্য’তে নেমে এলেও যে বামপন্থা মরে যায় না, এটা তার বড় প্রমাণ। সেভাবে দেখলে কোন রাজনৈতিক দলেরই সাংসদ বা বিধায়ক সংখ্যা তলানিতে ঠেকলে তার মৃত্যু অবধারিত এমন্ত বলা যায় না। আর তাছাড়া তৃণমূল দলেরও একসময় সংসদে বাংলা থাকে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ‘এক’। একদা বিজেপিরও সারা ভারতে সাংসদ ছিল মাত্র দুজন। বাকিটা ইতিহাস। তবে আমরা এখুনি মীনাক্ষীদের হাতধরে বঙ্গ সিপিআই(এম)র ‘শূন্যদশা’ কেটে পাঁচ-দশ-পনেরো-বিশ হয়ে যাবে এমনটা বলবার মত জায়গায় নেই। তবে ‘শূন্যদশা’টা যে অদূর ভবিষ্যতেই কাটবে তার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আর সেই দেওয়ালের লিখনটা পড়তে অসুবিধা হয়নি পোড় খাওয়া আলিমুদ্দিন স্ট্রীটের। স্বয়ং সিপিআই(এম)র রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম, রাজ্য কমিটির সদস্য শতরূপ ঘোষ, পলাশ দাস বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরী, সহ বেশ কিছু প্রথম সারির নেতৃত্বরা কার্যত কলকাতা থেকে যাতায়াত শুরু করেছেন এবং দফায় দফায় যোগ দিচ্ছেন মীনাক্ষীদের সাথে। মিছিলের গুরুত্ব বুঝতে পেরে পা মিলিয়েছেন পলিটব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম, অশোক ভট্টাচার্য্য, আনোয়ারুল হক, জামির মোল্লা, সৈয়দ হোসেনের মত পরিচিত মুখেরা। মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া দেখে এবং আলিমুদ্দিনের সম্পূর্ণ সাপোর্ট পেয়ে মীনাক্ষীর ভাষণেও ক্রমশঃ তেজ বাড়ছে যা উত্তরবঙ্গে কিছুটা হলেও কম ছিল। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে চুইঁয়ে পড়ছে আত্মবিশ্বাস। বীরভূমের তথাকথিত কেষ্টগড়ে দাঁড়িয়ে একদা তৃণমূল জেলা সভাপতি কেষ্ট মণ্ডলকে ‘বাঘ’ বলে প্রচার করা শাসক তৃণমূলকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন “জঙ্গলের বাঘ হলে বাংলার মানুষ অভয়ারণ্যে তাদের সংরক্ষণ করবার দায়িত্ব নেবে, কিন্তু মানুষখেকো বাঘ হলে তার চামড়া ছাড়িয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেও বাংলার মানুষ জানে।” আবার কখনও বলছেন “বীরভূম- শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতির মাটিকে জানোয়ারের চারণভূমিতে পরিণত করেছে তৃণমূল। আগে বাঘ (কেষ্ট মণ্ডল) ছিল, এখন ফেউ (কাজল শেখ, নতুন জেলা তৃণমূল নেতা) এসেছে! কিন্তু আমরা বলি, বাঘই হোক আর ফেউই হোক, মানুষের বসতিতে তাদের কোনও স্থান নেই।” এমনকি মোদি-মমতার মত দেশ ও রাজ্যের সর্বেসর্বাকেও তোপ দাগছেন – “কথা ছিল প্রত্যেক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা করে ঢোকবার। অথচ এখন দিদি-মোদি এমন সরকার চালাচ্ছে যে সামান্য ১০০ দিনের কাজের টাকাও অ্যাকাউন্টে ঢুকছে না।”

আর এসবের মাঝেই ভারত–অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন গায়ে বিরাট কোহলির আঠারো নম্বর নীল জার্সি চাপিয়ে সবার সাথে বসে জায়েন্ট স্ক্রিনে বিশ্বকাপ ফাইনালও দেখেছেন। মানে ইনসাফ যাত্রার নামে লোকসভা ভোটের আগে মীনাক্ষী যেটা চালাচ্ছেন সেটা হলো নিবিড় জনসংযোগ আর আগামী ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে চলা ‘ইনসাফ’ ব্রিগেডের প্রচার। বাম জনতার ক্যাপ্টেন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আম জনতার ক্যাপ্টেন হতে! এই মুহুর্তে তিনি অনেকের কাছে জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছেন ‘ইনসাফ দিদি’ নামে।

আগামী সপ্তাহে দুই বর্ধমান জেলা শেষ করে ইনসাফ যাত্রা ঢুকবে রাঢ়বঙ্গে। তারপর দুই মেদিনীপুর হয়ে যাবে হাওড়াতে। সেখান থেকে হুগলী, নদীয়া হয়ে দুই ২৪ পরগণা অতিক্রম করে হাজির হবে কলকাতার যাদবপুরে।

আর আমাদের কাছে যা খবর তা হলো সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-শালবনী, বাংলার শিল্প সম্ভাবনার নির্মূল হওয়া এবং ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পথে গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটে মাইল ফলক নাকি ইনসাফ যাত্রা ছোঁবে না! একদা ‘সিঙ্গুর থেকে শালবনী, ক্ষেত মজুরের কান্না শুনি’ স্লোগান তোলা ছাত্র-যুবদের যাত্রাপথে এই তিনটে গন্তব্য কেন স্থান পেল না তা আমাদের রাইজ অফ ভয়েসেস কে কিছুটা হলেও অবাক করেছে। পুরো ইনসাফ যাত্রার এটুকুই যা খামতি।

তবে তারজন্য ‘ইনসাফ দিদি’ ও তার দলবলকে নিয়ে আম জনতার উৎসাহে কোন খামতি চোখে পড়ছে না। ইনসাফের রেলগাড়িটা দেখতে ধানক্ষেত পেরিয়ে আলপথ দিয়ে ছুটে আসছে গ্রাম বাংলার অপু-দূর্গারা এবং তাদের গায়ে গতরে খেটে খাওয়া বাপ-মায়েরা, ঠাকুমা -দিদিমারা। আর ড্রাইভারের সিটে এক ক্যাপ্টেন! নাম মীনাক্ষী ‘ইনসাফ’ মুখার্জ্জী। যে অপু-দূর্গা এবং তাদের বাড়ির লোকদের দেখতে পেয়ে ট্রেন থামিয়ে নেমে আসছে…. মিশে যাচ্ছে জনতার ভিড়ে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস