পাঁচ গেটের সাম্রাজ্য / Fake Receipts, Real Money

২০২৩ সালের মার্চ মাসে আমরা প্রকাশ করেছিলাম ডিসিআর গেট কেলেঙ্কারির কথা। তারপর তা নিয়ে সংবামাধ্যমগুলোতে হটাৎ আলোড়ন উঠলেও, তা আবার দপ করে নিভেও গিয়েছিল। রাইজ অফ ভয়েসেসের প্রতিবেদন প্রকাশের আট মাস পর, ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক তথা সিপিআই(এম) নেত্রী মিনাক্ষী মুখার্জি সিউড়ির সভা থেকে তুলে এনেছিলেন, দৈনিক সাড়ে তিন কোটি টাকার দুর্নীতির কথা। যা শোনার পর আমাদের মনে হয়েছিল, রাজ্যের প্রায় সব দূর্নীতির অন্যতম উৎস, ডিসিআর গেটের বাকি কথাগুলো আপনাদের সামনে নিয়ে আসা উচিৎ। কিন্তু হাজারো বিষয়ের মাঝে সে সব আর সামনে আনা হয়নি। কিন্তু গতকাল সিউড়ি তথা বীরভূমের বিশিষ্ট শিল্পপতি টুলু মন্ডলের মেয়ের বিয়েতে আমন্ত্রিতদের (আসরানি, আরবাজ খান, জারিন খান, আফতাব শিবদাসানি, অঙ্কুশ প্রমুখ) লিষ্টি দেখে মনে হল, এই শিল্পপতির শিল্প রহস্য এখনই আমাদের সামনে তুলে আনা প্রয়োজন। তবে, যারা এখনো ডিসিআর গেট নিয়ে আমাদের প্রথম প্রতিবেদন পড়েননি, তারা এই লিঙ্কে ক্লিক করে পড়ে নিতে পারেন প্রথম পর্ব

মনে পড়ে শাসক দলের বাহুবলি উপপ্রধান ভাদু শেখ খুনের কথা (২১ মার্চ, ২০২২), সেই রাতেই খুনের বদলা নিতে নৃশংস বগটুই গণহত্যা, তার বেশ কয়েকদিন পর মুখ্যমন্ত্রীর বীরভূম যাত্রা, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একসময়ে তিহারে বন্দী বাঘের আবদার, “ঘটনাকে সুচপুরের মত ‘সাজাতে’ হবে”, তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে অভিযুক্ত আনোয়ারুলকে গ্রেফতার, তারপর সিবিআইয়ের হাতে মামলা, মূল অভিযুক্ত লালন শেখের গ্রেফতার, তারপর সিবিআই কাস্টডিতে লালনের ঝুলে পড়া, তারপর কেস ঠান্ডা। এই সবকিছুর কারণ একটাই, ডিসিআর গেট। বীরভূমের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি, রাজ্যের তথা দেশের অন্যতম বড় দুর্নীতি, যার পরিমাণ মিনিমাম ৫০,০০০ কোটি টাকা।

ভাদু শেখের খুনের পর মাস নয়েক বীরভূমের ডিসিআর গেটগুলো বন্ধ থাকার পর (২১ মার্চ, ২০২২ – ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২), ২০২৩-এর প্রথম দিন থেকে সাতটা ডিসিআর গেট আবারো সগৌরবে পুলিশ, প্রশাসন, সিবিআইয়ের নাকের ডগায় কাজ করে চলেছে। এই দুর্নীতি এতটাই পাওয়ারফুল যে, যে কয় মাস এই গেট বন্ধ ছিল, সেই কয় মাস গত রাজ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বালি, পাথরের দাম কমে গিয়েছিল।

ডিসিআর কথাটির অর্থ “ডুপ্লিকেট কার্বন রিসিট” অথবা নকল চালান। বীরভূম জেলা প্রশাসনের সুত্র অনুযায়ী, কোনো বালি, পাথর খাদান এলাকায় তারা রয়্যালটি অথবা টোল কিছুই আদায় করে না, কিন্তু খনি এলাকার মুখে একটা টোল থাকে, যেখানে কত পরিমাণ পাথর তোলা হল, তার হিসেব রাখা হয়। এইটুকুই। দেশের আইন অনুযায়ী, কোনো কিছুর ওপর জিএসটি আদায় হলে, তার ওপরে রয়্যালটি নেওয়া যায় না। বেশ।

তার মানে ডিসিআর গেট আছে, কতগুলো?

১. পাঁচামি
২. রাজগ্রাম
৩. বাউটিয়া
৪. ঝনঝনিয়াপুল
৫. শালবাদরা

এখানে কি হয়? তাহলে চলে যেতে হয় বিএলআরও অফিসে। জানা গেছে প্রতিদিন বিএলআরও অফিস থেকে দুটো থেকে তিনটে ২৫ পাতার ডিসিআর স্লিপ দেওয়া হয়, কিন্তু এই একই রকমের আরো ১০-১২ টা স্লিপ ছাপানো হয় রাজ্যের শাসক দলের তরফে, আর তা দিয়েই তোলা হয় টাকা। অভিযোগ এমনটাই। এখানেই শেষ নয়, আমাদের প্রতিনিধি এক পাথরের লরি চালকের থেকে জেনেছেন, তার কাছ থেকে ৭,০০০ টাকা নেওয়া হলেও, তাকে ডিসিআর দেওয়া হয়েছে ৪,০০০ টাকার। কিন্তু যে ডিসিআর তার কাছে আছে, সেটা আসল নাকি ভুয়ো তা নিয়েও তিনি সন্দিহান। সাধারণভাবে এই ডিসিআরের অরিজিনাল কপি যায় গাড়ির মালিকের কাছে, আর কাউন্টার প্যাড থাকে ডিসিআর গেটে। তার মধ্যে আবার যে ডিসিআর বিএলআরও অফিস থেকে ছেপে আসে, সেগুলোর কাউন্টার প্যাডে লেখা কালেকশন মানি যায় সরকারের ঘরে, অতিরিক্ত যে টাকা আদায় হয়, তা চলে যায়… জয় মা কালী। এখানেই শেষ নয়, যে ডিসিআরগুলো শাসক দলের ছাপাখানা থেকে ছেপে আসে, তার গোটাটাই যায়, বিখ্যাত ৭৫-২৫ হিসেবে। অভিযোগ, ডিএম থেকে বিএলআরও, এসপি, পুলিশ, নেতা, প্রায় সকলেই জড়িত এই কেলেঙ্কারির সাথে। সিপিআইএমের মিনাক্ষী মুখার্জি ইনসাফ যাত্রা চলাকালীন অভিযোগ তুলেছিলেন, “বীরভূম বিজেপি জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা ডিসিআর কেলেঙ্কারি থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখার জন্যে ৯ কোটি টাকা নিয়েছেন।” ইনি যেই ধ্রুব সাহা, যিনি কয়েক বছর আগে, অনুব্রত মণ্ডলের গাড়ি চড়ে ঘুরতেন, বড় বড় মিডিয়া তা ফাঁস করেছিল, কিন্তু ডিসিআর গেট নিয়ে তারা আর কিছু বলেননি। কারণ বীরভূম জেলায় এক প্রাইভেট ভাতা প্রকল্প চলে বলে জানা যায়, যেখানে সাংবাদিকরা চুপ থাকার জন্যে মাসিক ৩,০০০ থেকে ৫০,০০০ পর্যন্ত টাকা পান। আর চুপ না থাকলে! গোপালবাবুর গল্প নিয়ে ঘন্টাখানেক এখনো হয়ে ওঠেনি। যাই হোক, ডিসিআর গেটের সামনে ৩৫ লক্ষের জমির কথা আর বললাম না আপাতত।

জানা যাচ্ছে, ২০১৮ থেকে অত্যন্ত সংগঠিতভাবে চলে আসছে এই ব্যাবস্থা। পাঁচটা গেট দিয়ে রোজ ৭,০০০ লরি পাস করে, আর প্রতি গাড়ি পিছু তোলা হয় ৪,৬০০ টাকা থেকে ৮,০০০ টাকা। খাতায় কলমে এবার হিসেব করে নেওয়া যাক। আর এই গেটগুলির দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি টুলু মন্ডল, যার মেয়ের বিয়েতে বলিউড টলিউডের চাঁদের হাট বসেছিল সিউড়িতে।

যাই হোক, তিন খানা ডিসিআর স্লিপ বিএলআরও অফিসে ছাপা হলে, শাসক দল ছাপায় বারোটা। অনুপাত তাহলে ২৫:৭৫।

প্রতিদিন ৭,০০০ লরির মধ্যে তাহলে ৭৫% লরি (৫,২৫০ লরি) পাচ্ছে ভুয়ো ডিসিআর। এদের কাছ থেকে যদি সর্বনিম্ন রেট ৪,৬০০ টাকা আদায় করা হয়, সেক্ষেত্রে দৈনিক আদায় করা হয় :

৫,২৫০ x ৪,৬০০ = ২ কোটি ৪১ লক্ষ ৫০ হাজার, একদিনে। আর সরকারের ঘরে যায় ১,৭৫০ লরির টাকা, মানে ৮০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। যদিও প্রশাসন বলছে, তারা কোনো রকম টোল আদায় করে না, শুধু পাথরের পরিমাণের হিসেব রাখে।

তাহলে, বছরের ৩৬৫ দিনে হিসেবটা দাঁড়ায় (২.৪১ কোটি x ৩৬৫) = ৮৭৯ কোটি ৬৫ লক্ষ।

আর ২০১৮ থেকে ২০২৩, এই পাঁচ বছরে কত বেআইনি টাকা এই পাঁচটা গেট থেকে উঠেছে? ৪,৩৯৮ কোটি টাকা মাত্র। কিন্তু প্রতিবেদনের শুরুতে আমরা বলেছিলাম, এই দুর্নীতির পরিমান মিনিমাম ৫০,০০০ কোটি। কেন বলেছিলাম জানেন, কারণ পশ্চিমবঙ্গে কেবল পাথর খাদান নেই। এই রাজ্যে কয়লা আছে, বালি আছে, আরো অনেক খাদান আছে। এই পাঁচটা গেট ছাড়াও আরও অনেক গেট আছে, যেমন বীরভূমের হটাৎ টোল, যা নিয়ে বীরভূমনামার দ্বিতীয় পর্বে আমরা বীরভূমের ছোট গেটগুলোর কথা লিখেছিলাম। এখনো সেটা না পড়লে, পড়ে নিন এই লিঙ্কে ক্লিক করে

তাহলে ৫০,০০০ কোটির দুর্নীতি কি আমরা খুব বেশি বললাম! আমাদের জানাবেন।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস