ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল / The Metamorphosis

“বেজায় গরম । গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির । ঘাসের উপর রুমালটা ছিল ; ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি, অমনি রুমালটা বলল, ‘ম্যাও !’ কি আপদ ! রুমালটা ম্যাও করে কেন ?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা সোটা লাল টক্‌টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্‌ প্যাট্‌ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি বললাম, ‘কি মুশকিল ! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল ।’
অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, ‘মুশকিল আবার কি ? ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস । এ তো হামেশাই হচ্ছে।'”

হ্যাঁ মশাই, হামেশাই হচ্ছে। কেউ ছিলেন ওবিসি, হলেন এসসি। আর এসসি হয়েই জেলা পরিষদের সভাধিপতি। যে রাজ্যে কুড়মিরা তাদের জাতিগত পরিচয় ফিরে পেতে শতকের পর শতক আন্দোলন করছে, সে রাজ্যেই শাসক দলের নেত্রী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তপসিলি অধিকার ইতিমধ্যেই কেড়ে নিয়েছেন।

নাহ্, বানিয়ে বলছি না, এই ঘটনা সত্য এবং এর সমস্ত তথ্যপ্রমাণ যে কেউ একটু খোঁজখবর করলেই পেয়ে যাবেন।

জাতিগত শংসাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে উত্তরবঙ্গের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার স্ত্রীয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রভাব খাটিয়ে করণদীঘির বিধায়ক গৌতম পাল, পঞ্চায়েত ভোট সম্পন্ন হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তার স্ত্রীয়ের বেআইনি শংসাপত্র বের করিয়েছেন।

বর্ধমানের সিপিআই(এম) নেতা চন্ডীচরন লেট আমাদের জানিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তপসিলি শংসাপত্র সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি বিধায়ক পত্নীর যে ওবিসি সার্টিফিকেট ইস্যু হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার লেখা আছে, তিনি ওবিসি-বি কুম্ভকার সম্প্রদায়ভুক্ত”। তিনি আরও জানিয়েছেন, “গত ১১ই আগষ্ট পম্পা দেবীকে এসসি সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি”।

শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে করণদীঘি জেলা পরিষদের ১৫ নম্বর সিটে কারা কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তার তালিকা দেখলে প্রার্থী দেখবেন পম্পা পালের নামের পাশে ‘জেনারেল’ লেখা আছে, ওবিসি বা এসসি নয়। এটা কি ইচ্ছাকৃত তথ্য গোপন নাকি নির্বাচন কমিশনের করণিকের দ্বারা “অনিচ্ছাকৃত ভুল” তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কার, এমনটা হওয়ার কথা নয়। তাহলে ক্রোনোলজি দাঁড়াল ঠিক এই রকম:

১) পম্পাদেবী ২০১৪ সালে ছিলেন ওবিসি
২) ২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন জেনারেল হিসেবে
৩) পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর এক মাসের মধ্যেই হয়ে এসসি।

কিন্তু হঠাৎ কি হল, যে পম্পা পালকে ভোট গননা শেষের এক মাসের মধ্যে এসসি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।

প্রয়োজনীয়তা একটাই, ক্ষমতার ব্যবহার করে ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। আসলে উত্তর দিনাজপুরের জেলা পরিষদের সভাপতি আসনটি তপসিলি জাতির জন্যে সংরক্ষিত। তাই ভোট গননার এক মাসের মধ্যেই ওবিসি থেকে এসসি হওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল বিধায়ক পত্নীর। আর আজ তাই উত্তর দিনাজপুরের জেলা পরিষদের সভাপতির নাম শ্রীমতী পম্পা পাল। কিন্তু প্রশ্ন হল, এভাবে কি সত্যিই ওবিসি থেকে এসসি হওয়া যায়?

উত্তর না।

ভারতীয় আইনে ওবিসি থেকে এসসি হওয়ার বড়, মেজো, ছোট, সরু, কোনো উপায় নেই, বরং শংসাপত্র জালিয়াতি কেউ করেছে তা প্রমান হলে সর্বোচ্চ তিন বছর অবধি হাজতবাসের বিধান আছে। সাথে এসডিও এবং সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের চাকরি পর্যন্ত চলে যেতে পারে। সব শেষে আরেকটা তথ্য দিয়ে যাই, দিন কয়েক আগে, তৃণমূল মুখপাত্র জাগো বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে পম্পা পাল বলেছিলেন, উনি ২০১৮তে হেমতাবাদ ব্লকে জয়ী জেলা পরিষদ সদস্য ছিলেন। সেবারেও পম্পাদেবী জেলা পরিষদের সভাধিপতি হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। কিন্তু সেবার তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী (বর্তমানে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এবং বিজেপি নেতা) জানিয়েছিলেন, কোনও মন্ত্রী-বিধায়কের আত্মীয়কে জেলা পরিষদের শীর্ষ পদে বসানো হবে না। তাই সে যাত্রায় পম্পা দেবীর সাফল্য আসেনি। কিন্তু এবার এই ঘটনার পর, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা নীরব। এবার প্রশ্ন হল, তখন পম্পা পাল জেনারেল ছিলেন, না এসসি ছিলেন, নাকি ওবিসি ছিলেন? যদি তিনি তখন এসসি থাকেন, তাহলে ২০২৩-এ তিনি এসসি সার্টিফিকেট বের করলেন কেন? পূর্ববর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতা? যদিও এত প্রশ্ন না করে সাধারণ একটা আরটিআই করলেই এই কেস সলভ হয়ে যেতে পারে।

আমাদের কাজ তথ্য অনুসন্ধান করা এবং পাঠকদের জানানো। সেই দায় থেকেই এই প্রতিবেদন। যদি ঘটনা ধামাচাপা না পড়ে যায় তবে, মানিক ভট্টাচার্যের স্ত্রীয়ের পর পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের আরেকজন বিধায়কের স্ত্রী প্রবল আইনগত সমস্যায় জড়িয়ে যেতে পারেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://uttarbangasambad.com/pompa-pal-the-wife-of-the-mla-elected-as-savadhipati-of-north-dinajpur-zilla-parishad/
b) https://www.anandabazar.com/west-bengal/north-bengal/kabita-barman-chosen-as-the-president-of-north-dinajpur-zilla-parishad-1.875412