এক ‘SHIT’ ঝোল / The Exit Files

বিজ্ঞান কখনও কিছু প্রেডিক্ট বা অনুমান করে না। বিজ্ঞান সমস্ত জাগতিক ও মহাজাগতিক ঘটনার কারণ ও পরম্পরা খুঁজে তার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করে আমাদের জানায়, কেন সেটি ঘটছে। আর তারপর সেই আহরিত জ্ঞানটির প্রযুক্তিগত ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটায়।

তাই কোন একটি ঘটনা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হওয়ার মানে হলো সেই ঘটনার পেছনে থাকা সঠিক কারণ বা পরম্পরাকে সঠিক ভাবে জানা। আর তাই সেরকম কোন কারণ বা ঘটনার পরম্পরা সামনে এলে তার ফলাফল বা কি ঘটতে চলেছে, তাও সঠিক বা অভ্রান্ত ভাবে আগে থেকে বলে দেওয়া যায় এবং হ্যাঁ, সেটা বলা যায় প্রায় ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তার সাথে। মানে সোজা কথায় বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত ও প্রমাণিত ঘটনার ক্ষেত্রে ‘ইনপুট’ সঠিক হলে এবং জানা থাকলে ‘আউটপুট’ ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তার সাথে আগে থেকে বলে দেওয়া যায়। অর্থ্যাৎ ১০০ শতাংশ সাফল্যের সাথে বিজ্ঞান প্রেডিক্ট বা অনুমান করতে সাহায্য করে, যদি ‘ইনপুট’ সঠিক হয়। মানে বিজ্ঞান আদতে পদ্ধতিটাকে সিলমোহর দেয়, ‘ইনপুট’ টা’কে নয়।

যেমন ধরুন আপনি একটা ঢিল আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে সেটা ঠিকই মাটিতে নেমে আসবে। এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য এবং প্রমাণিত। কিন্তু যদি কোন পৃথিবীর থেকেও বড় কোন গ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি এসে পড়ে তাহলে কিন্তু আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া ঢিলটা আর মাটিতে নেমে আসবে না, সেটা ঐ গ্রহটির দিকে ছুটে যাবে এবং আকাশে মিলিয়ে যাবে। আর সেরকম কোন মহাজাগতিক ঘটনা ঘটলে, শুধু আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া ঢিলটা নয়, উপগ্রহ চাঁদ কে নিয়ে আস্ত পৃথিবীটাই ঐ বড় গ্রহটার বুকে আছড়ে পড়বে। কারণ এক্ষেত্রে নতুন ‘ইনপুট’ হলো ঐ বড় গ্রহটির আবির্ভাব যা নতুন মহাজাগতিক পরিস্থিতির তৈরি করবে, যার ফলে আমি বা আপনি আকাশের দিকে ঢিলটা ছুঁড়ে দেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পাবো না, তার আগেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। এর মূলে রয়েছে অভিকর্ষ বল এবং সেই সংক্রান্ত জটিল বৈজ্ঞানিক কার্য কারণ,অঙ্ক। তাই সেরকম কোন বড় গ্রহের আবির্ভাব ঘটলে পৃথিবী ধ্বংস হবেই এবং আবির্ভাব না ঘটলে আপনার আকাশে ছোঁড়া ঢিল মাটিতে নেমে আসবেই, এটা নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া যায়। এর কোন ব্যত্যয় হবে না। এটাই বিজ্ঞান।

আর ঠিক এই কারণেই প্রতিবার ভোট পূর্ববর্তী ওপিনিয়ন পোল বা ভোট পরবর্তী এক্সিট পোল সমীক্ষার নামে বিশ্বের নামীদামী সংবাদমাধ্যম ও সমীক্ষক সংস্থাগুলি যে কাজ করে চলেছে তাকে সেই অর্থে ‘বৈজ্ঞানিক’ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এর সাফল্যের হার ১০০% নয়। এমনকি ৯০% শতাংশও নয়। যদি তাঁরা বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগ ঘটাতেন, তাহলে প্রতিবারই ওপিনিয়ন পোল এবং এক্সিট পোল সঠিক প্রমাণিত হত, একবারের জন্যেও ভুল বলে প্রমাণিত হত না। অথচ সাম্প্রতিক অতীতে সেটাই হয়েছে বহুবার। তার মানে হয় এর পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে অথবা সঠিক ‘ইনপুট’ ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এখন যারা স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তারা জানেন এক্ষেত্রে সমীক্ষকরা জনমানসের ‘স্যাম্পেল’ নিয়ে তার থেকে বিভিন্ন ‘স্ট্যাটিস্টিকাল টুল’ ব্যবহার করে ওপিনিয়ন বা এক্সিট পোলের মাধ্যমে জনমতের একটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা করেন। এখানে এই স্যাম্পলটা হলো ‘ইনপুট’, আর ‘স্ট্যাটিস্টিকাল টুল’ গুলো হলো বিজ্ঞান বা অঙ্ক। এখন যে কোন স্যাম্পলিং পদ্ধতির একটা ‘মার্জিন অফ এরর’ থাকে। কিন্তু তাতে ১০ টা ৮ বা ৯ অথবা ১১ বা ১২ হতে পারে, কিন্তু সেটা কখনই ৩ বা ৫ অথবা ১৫ বা ২০ হতে পারে না। কিন্তু আমরা বেশ কয়েকবার দেখেছি সেটাই হচ্ছে। একের পর এক উদাহরণ দিয়ে অযথা লেখাটা বড় করতে চাইছি না। চাইলে আপনারা আমাদের রাইজ অফ ভয়েসেসেরই পশ্চিমবঙ্গের পুরসভা অথবা পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে এই সংক্রান্ত লেখা প্রতিবেদন গুলো পড়ে দেখতে পারেন। দুক্ষেত্রেই ওপিনিয়ন ও এক্সিট পোল সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি আমাদের রাজ্যের ২০২১ এর বিধানসভা ভোটের ফলাফলও এক্সিট পোলের সাথে মেলেনি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। সবক্ষেত্রেই ‘মার্জিন অফ এরর’ অনেক। তারমানে হয় গন্ডগোলটা হচ্ছে ইনপুটে অর্থ্যাৎ স্যাম্পেলে অথবা স্ট্যাটিস্টিক্সের যে টুল ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা প্রায় ১০০ কোটি ভোটদাতা সমন্বিত ভারতবর্ষের মত বৃহৎ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকরী বা উপযুক্ত নয়।

আর আমাদের রাইজ অফ ভয়েসেসের মনে হয়েছে দুটোই সত্যি। কারণ প্রথমতঃ ১০০ কোটি ভোটদাতার মধ্যে থেকে ১% বা ২% মানুষের ‘মত’ জেনে স্যাম্পেল হিসেবে ব্যবহার করে তার থেকে ভারতের মত ভৌগলিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্রে ভরা এই বিরাট জনমানসের মন বুঝে যাওয়ার দাবী করাটাকে অবিমৃষ্যকারীতা বলে। ধৃষ্টতাও বলা যায়। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য স্যাম্পেল সাইজ ও তার বৈচিত্রের সীমাবদ্ধতার কারণেই এই সমস্ত ওপিনিয়ন বা এক্সিট পোলের ফলাফল সংক্রান্ত অনুমান সবক্ষেত্রে মেলে না। মানে স্ট্যাটিসটিক্যাল টুল ব্যবহার করে এত বড় একটা বৈচিত্রপূর্ণ দেশের জনমত অনুমান করার চেষ্টা করাটাই একটা অবৈজ্ঞানিক কাজ। আর দ্বিতীয়তঃ যে সমীক্ষক সংস্থা বা সংবাদমাধ্যম স্যাম্পেল কালেক্ট করে তাদেরও কিছু অনিচ্ছাকৃত ও কিছু ইচ্ছাকৃত ত্রুটি থাকে। অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি’টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐ সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। মানে স্যাম্পেলে সমাজের সব অংশের মানুষের যথেষ্ট আনুপাতিক প্রতিনিধির মত তুলে আনা সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ত্রুটিটা ঐ সমীক্ষক সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা যেটা বর্তমানে খুব প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। তা নাহলে কোন রাজ্য বা পুরসভা ভোটের ক্ষেত্রে যেখানে ভোটদাতার সংখ্যা অনেকটাই কম সেখানে তাদের এতটা ভুল হওয়ার কথা নয়। ‘মার্জিন অফ এরর’ ও এতটা বেশি হওয়া উচিৎ না। অথচ সেটাও যে হয়েছে তারও আমরা সাক্ষী থেকেছি।

আর তাই এই সমস্ত কারণেই ওপিনিয়ন পোল বা এক্সিট পোল কখনও মিলছে কখনও মিলছে না। এমনকি কখনও আবার আসন সংখ্যা মোটামুটি মিলে গেলেও দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট শতাংশের ক্ষেত্রে বিশাল হেরফের দেখা গেছে। মানে গাঁজাখুরি দিয়ে অঙ্কটা দাঁড় করালেও পাকেচক্রে অঙ্কের উত্তরটা মিলে গেছে। এটা বুঝতে গেলে কলকাতা পুরসভার ভোট নিয়ে আমাদের খুব পরিচিত C-Voter এর সমীক্ষার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন আমরা ঠিক কি বলতে চাইছি। এই নিয়ে আমাদের প্রতিবেদনও আছে।

আরও আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো যেবার অনুমান মিলে যাচ্ছে, সেবার ঐ সমস্ত সমীক্ষক ও সংবাদ সংস্থার তরফে তারপরের এক সপ্তাহ জুড়ে সকাল-বিকেল ঢাক পেটানো হয়। অথচ যখন মেলে না, তখন তাদের তরফ থেকে ন্যুনতম দুঃখপ্রকাশটুকুও করা হয় না। আর আমারা জনসাধারণও এদেরকে পাল্টা জিজ্ঞেস করতে বা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই। এটাই হয়ে আসছে। আর সেই গতানুগতিকতা মেনেই গতকালই ২০২৪ এর লোকসভা ভোট শেষ হতেই ফের শুরু হয়ে গেছে এক্সিট পোলের ধুম। সারাদেশ জুড়ে তাই নিয়ে চলছে তোলপাড়। নিউজ চ্যানেল গুলোর টিআরপিও বেড়েছে হু-হু করে।

তা দেখে সবপক্ষ যে যার মত তাল ঠুকছে। সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমগুলো জানে তাদের অনুমান ‘লেগে গেলে তুক, না হলে তাক’। মিলে গেলে কলার তুলে ঘুরবো। জনমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। বাড়বে রেটিং। বাড়বে বিজ্ঞাপনী আয়। আর না মিললে ব্রেকিং নিউজে অন্য খবর দেখিয়ে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেব। আর সে সুযোগও রয়েছে বিস্তর। কারণ ফলাফল বের হলেই শুরু হবে সরকার গঠনের তোরজোড়। কে জিতলো, কে হারলো, কে প্রধানমন্ত্রী হবে, কে কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় জায়গা পাবে সেদিকেই নজর থাকবে দেশবাসীর। তাই দেখিয়ে ফের একদফা টিআরপি বাড়ানো ও বাড়তি বিজ্ঞাপনী আয়। সেখানে কোন সংবাদ সংস্থার এক্সিট পোল মিললো বা মিললো না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। মানে ‘শোলে’ সিনেমার সেই বিখ্যাত কয়েনটার মত একদম পাকাপাকি ব্যবস্থা। ভোটের ফল যাই আসুক, লাভ কুড়োবে চ্যানেলগুলো। আপনি আমি সেই ‘বেওকুফ’ দর্শকই থেকে যাচ্ছি।

আর এসব দেখেই আমাদের রাইজ অফ ভয়েসেস এর মনে হয়েছে এইসব ওপিনিয়ন পোল বা এক্সিট পোলের নামে রাজনৈতিক ঝোল টানার এই প্রয়াস গণতন্ত্রের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর, কারণ এর সাথে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এসবই বিশেষ রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে জনমতকে প্রভাবিত করবার ছল চাতুড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলো বন্ধ হওয়া জরুরি। বিজ্ঞানের এই অপব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। এমনকি ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের ফল এক্সিট পোল বা ওপিনিয়ন পোলের সাথে হুবহু মিলে গেলেও নয়। কারণ তাতে আগামী কোন ভোটে ফের একবার যে আসল ভোটের ফলাফলের সাথে এই সমস্ত ওপিনিয়ন বা এক্সিট ভোটের ফল মিলবেই এমন কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। আর একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন ‘অবৈজ্ঞানিক’ একটি প্র্যাক্টিস দিনের পর দিন গণতন্ত্রের বুকে মার্চপাস্ট করে বেড়াবে তা কখনই বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে ভোট আসবে, ভোট যাবে, কেউ ক্ষমতায় বসবে, কেউ ক্ষমতা থেকে সরে যাবে, কিন্তু গণতন্ত্রের ভিতটা যেন নড়ে না যায়।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস