উত্তরকন্যা অভিযান- ‘ক্যাপ্টেন কন্যা’ ও ‘মিস্টার সাম ওয়ান’ / Duo

আমাদের ভোট দিন, ‘ডবল-ডবল’ চাকরি হবে।

ভোট চাইতে গিয়ে বলেছিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। সালটা ২০২১।

ভোট হয়ে গেছে। ভোট পাওয়াও হয়ে গেছে। শুধু চাকরির দেখা নেই। ‘ডবল-ডবল’ তো কোন ছাড়, একটা ‘সিঙ্গল’ চাকরির জন্য যোগ্যদের বসতে হচ্ছে ধর্নায়। আর অযোগ্যরা মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে বাগিয়ে নিচ্ছে সেইসব চাকরি। সেই অযোগ্য চাকরি প্রাপকদের তালিকা তৈরি হচ্ছে ‘জনৈক’ লিপ্স অ্যান্ড বাউন্ডস কোম্পানির অফিসে। এমনটাই নিয়োগ দুর্নীতি কান্ডের তদন্তের চার্জশিটে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই দাবি করছে। সেইসঙ্গে তাদের আরও দাবি এই কোম্পানির কর্নধার হলেন নাকি ‘জনৈক’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাজারে শুনতে পাই ইনি আবার নাকি ‘জনৈক’ থুড়ি ‘জনৈকা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো। এখন সেই জনৈকা আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কি না আমরা জানি না। এমনকি জানলেও বলতে চাই না।

আসলে আমরা হলাম গিয়ে বাঙালীর সেই ভীতু কাপুরুষ অংশটা যাদের বাস কলকাতা ও শহরতলীর আশপাশে এবং সমস্ত বাতেলাবাজির শুরু ও শেষ প্রতিদিন সন্ধেবেলা প্রাইম টাইমে খবরের চ্যানেল গুলোর চোখে চোখ রেখে। ভোটের দিন শাসকদলের মস্তানদের চোখে চোখ রাখা তো পরের কথা, ভোটের দিন আমরা অনেকে বুথ মুখো পর্যন্ত হই না। ভোট নিয়ে সামান্য একটু গণ্ডগোল হলেই সোজা মাংস কিনে বাড়ি। মানে যতই আমাদের ঘরে ঘরে রবিঠাকুর-বিবেকানন্দ-নেতাজীর ছবি ঝুলুক, আসলে আমরা বহুদিন হলো ভেতরে ভেতরে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়া কলকাতা পুলিশকেই আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছি।

কিন্তু আমাদেরকে ও মাননীয়া অনুপ্রাণিত ঘেসো মস্তান বাহিনীকে বাদ দিলে বাঙালীর আরও দুটো অংশ আছে। এরা দু-দলই প্রতিবাদী হলেও এদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।

প্রথম অংশটা প্রতিবাদ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে পুলিশ রে-রে করে ওঠবার আগেই ‘ডোন্ট টাচ মি’ বলে নিজেরাই সটাং পুলিশের ভ্যানে চেপে থানায় চলে যায়। তারপর সেখানে চা-জল খেয়ে খোশগল্প করে থানার টিভিতেই কেমন ফুটেজ-ছবি উঠেছে তা দেখে সোজা বাড়ি। তথাকথিত আপামর ‘জেগে ওঠা’ বাঙালী তামাশাটা দেখে কিন্তু গায়ে মাখে না। কারণ ব্যাপারটা ‘গা-সওয়া’ হয়ে গেছে।

কিন্তু দ্বিতীয় অংশটা একটু বেয়ারা টাইপের। ‘ডবল-ডবল চাকরি’র প্রথিশ্রুতিটাকে এরা জুমলা ধরে নিয়ে ঘরে বসে থাকলেই পারতো। কারণ এমনিতেই এরা ‘শূন্য’ পার্টি। মহাশূন্যে বিলীন হবে বলে নাকি সম্প্রতি ফেসবুকের ‘ডিপি’র ছবি বদলে তাতে লাগিয়েছে আকাশের নীল রং। সাধারণ মানুষও ভোট দেওয়ার সময় এদের খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। কিন্তু ঐ যে বললাম এরা হলো একটু ঢ্যাঁটা বেয়ারা টাইপের। কাজ নেই কম্ম নেই, উত্তরবঙ্গের চাকরি না পাওয়া ছেলে মেয়েগুলোকে এরা একসাথে জড়ো করে গত ২৮ শে মার্চ ঝেঁটিয়ে নিয়ে চললো উত্তরকন্যা অভিযানে। শিলিগুড়ির রাজপথ ভেসে গেলো জনসমাগমে। এদের আটকাতে রাস্তায় বসলো ব্যারিকেড। চললো জলকামান। ফাটানো হলো কাঁদানে গ্যাসের সেল। হলো দেদার লাঠিচার্জ। না ভুল বললাম, রীতিমত তাড়া করে ধরে রাস্তায় ফেলে পেটানো হলো যুবনেতা-নেত্রীদের। যেটা এদের পালের গোদা সেটার বাড়ি কিন্তু আমরা যদ্দুর জানি দক্ষিণবঙ্গে, বর্ধমানের কুলটিতে। গাঁয়ের মেয়ে। ময়লা গায়ের রঙ। থ্যাবড়া গেঁয়ো চোখমুখ। শহুরে চাকচিক্যের ছিটেফোঁটাও নেই। যে জন্য শাসকদলের সমাজমাধ্যম প্রভাবীরা একসময় একে ‘কাজের মাসী’ বলে দেগে দিয়েছিল। অথচ সেই পালের গোদা ‘কাজের মাসী’কে বাগে আনতে জনৈকা ‘পিসি’ থুড়ি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্ত পুলিশবাহিনীর কালঘাম ছুটে গেলো। অন্তত সেরকম ছবি-ছাবাই সমাজমাধ্যমে দেদার ঘুরছে। তাতে লেখা হচ্ছে উত্তরকন্যাতে ক্যাপ্টেনকন্যা। হ্যাঁ, ঐ ‘কাজের মাসী’কে তার সহকর্মী ও সহমর্মীরা ডাকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে।

কিন্তু ঠিক এরসাথেই হাতে এলো আরও একটা শিউরে ওঠার মত ভিডিও। তাতে দেখা যাচ্ছে দু-তিনজন পুলিশ লাঠি হাতে রে-রে করে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক তরুণের ওপর। হাতের লাঠি দিয়ে খানিক বেপরোয়া ভাবে পিটিয়ে দিল ছেলেটিকে। তারপর উর্ধশ্বাসে ছুটে গেলো অন্য কাউকে ধরে পেটাতে। আমরা ভাবছিলাম রাস্তায় আরও অনেক ছেলে মেয়ে থাকতে পুলিশ হঠাৎ এই ছেলেটিকে টার্গেট করলো কেন! সে তো জনতার ভিড়ে মিশে থাকা আর পাঁচটা নিরীহ গো-বেচারা মানুষের মতই হেঁটে যাচ্ছিল। তাহলে ….

কিন্তু ক্যামেরা একটু ক্লোজ হতেই রাইজ অফ ভয়েসেস চিনতে পারলো ছেলেটিকে । ইনি হলেন আমাদের সেই মিস্টার ‘নো-ওয়ান’। হ্যাঁ রাইজ অফ ভয়েসেসের এনাকে নিয়ে প্রতিবেদন আছে। এনাকে ‘মিস্টার নো ওয়ান’ বলেছিলাম কারণ ওনার ফেসবুকের পাতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় বিবরণীতে এটাই লেখা ছিল। এখনও আছে। না, ইনি কোন চাকরি না পাওয়া বেকার যুবক নন। ইনি পেশায় স্কুল শিক্ষক। আমরা যখন এনাকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখি তখন তিনি শাহুডাঙ্গীহাট পি কে রায় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন। বিষয় ইংরাজী। এখনও সেই স্কুলেই পড়ান নাকি বদলি হয়ে গেছেন জানি না। ইনি বিগত লোকসভা নির্বাচনে জলপাইগুড়ি কেন্দ্রে বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী ছিলেন। নাম দেবরাজ বর্মণ।

কিন্তু যেটা আপামর জনতাকে অবাক করেছে সেটা হলো এই আপাত ‘গো-বেচারা’ দেবরাজের মানসিক দৃঢ়তাটা। না ইনি একবারও বলেন নি “ডোন্ট টাচ মি”, বরং ইনি রাস্তার ধারে বসে বুক পেতে পুলিশের লাঠি খেয়েছেন। ইনি পুলিশের গাড়ি চেপে থানায় গিয়ে চা -জল খেয়ে বাড়ি ঢুকে যান নি, বরং বেদম লাঠিপেটা খেয়ে ফের উঠে দাঁড়িয়ে সহকর্মীদের সাথে অভিযানে হেঁটেছেন। ছাড়েন নি রাস্তা। আর তারসাথে মুখে সেই বেয়ারা আব্দার-স্লোগান “চাকরি দাও”! না নিজের জন্যে চাইছেন না, চাইছেন উত্তরবঙ্গের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক যুবতীদের জন্য মিছিলের ভিড়ে মিশে ‘মিস্টার নো -ওয়ান’ হয়ে। মানে ঐ যাকে আমরা বলি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো খানিকটা তাই।

কিন্তু রাজ্য পুলিশ কি তাঁকে থাকতে দিল ‘মিস্টার নো-ওয়ান’ হয়ে! এক ‘শূন্য পার্টি’র থার্ড হওয়া ৫%-৭% ভোট পাওয়া লোকসভা প্রার্থীকে ভিড়ের মধ্যে থেকে আলাদা করে খুঁজে বার করে লাঠি পেটা করে তারা বুঝিয়ে দিল দেবরাজ বর্মণ মোটেই মিস্টার নো-ওয়ান নন। উনি ‘সাম-ওয়ান’!

হ্যাঁ, মিস্টার দেবরাজ বর্মণ। আপনি আপনার ফেসবুক পাতা থেকে নির্দ্বিধায় ‘মিস্টার নো-ওয়ান’ লেখাটা মুছে ফেলতে পারেন। কারণ আপনি এখন ‘মিস্টার সাম-ওয়ান’। আপনাকে নিয়ে আমাদের বিগত প্রতিবেদনে আমরা সংশয় প্রকাশ করেছিলাম ‘মিস্টার নো ওয়ান’ কি পারবেন ‘মিস্টার সাম-ওয়ান’ উঠতে? আমাদের ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, যদি আপনি কিছুটা ভদ্রস্থ ভোট শতাংশ পেয়ে আলিমুদ্দিনের অপরিণামদর্শী নেতাদের মুখরক্ষা করতে পারেন সেটাই অনেক! কিন্তু আপনি আমাদেরকে ঘাড় ধরে শেখালেন ভোটে না জিতেও এভাবে নো-ওয়ানের মত জনতার ভিড়ে মিশে তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তার লড়াইতে থেকে ‘সাম-ওয়ান’ হয়ে ওঠা যায়। আমরা হারলাম। আপনি জিতলেন। আপনাকে কুর্নিশ। আপনি উত্তরবঙ্গের ‘ক্যাপ্টেন নিমো’ হয়ে উঠুন। আপনার নটিলাস ছুটুক জনসমুদ্রে। শুভেচ্ছা রইলো।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস