মিস্টার নো ওয়ান / Captain Nimo

তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল বলছে তিনি মিস্টার ‘নো ওয়ান’।

হ্যাঁ, এটা দেখে আপনাদের মত আমাদেরও মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক সিনেমায় উৎপল দত্তের সেই ডায়লগ। মনে পড়ে যাচ্ছে ‘ক্যাপ্টেন নিমো’কে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কৈশোর কালে পড়া জুলে ভার্নের লেখা ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’র প্রচ্ছদ।

কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রতিবেদনের মিস্টার নো ওয়ান বা ‘ক্যাপ্টেন নিমো’ কোন কল্পবিজ্ঞানের কাল্পনিক চরিত্র নয়। তিনি ঘোর বাস্তব। তিনি রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁর উপস্থিতি সমুদ্রের গভীরে নয়, তিনি মিশে থাকেন জনতার ভিড়ে। আর তাই খুব সঙ্গত কারণেই তাঁর ক্যাপ্টেন নিমো’র মত নেই কোন ‘নটিলাস’ সাবমেরিন। তার পরিবর্তে আছে একটা মোটরসাইকেল। সেটা চালিয়েই তিনি চষে বেড়ান তার নিজের জলপাইগুড়ি জেলার এমাথা থেকে ওমাথা। পৌঁছে যান মানুষের কাছে, দাঁড়ান মানুষের পাশে। তা সে করোনা মহামারী হোক অথবা সাম্প্রতিক জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়িতে ঘটে যাওয়া টর্নেডো, কোন কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। সবক্ষেত্রেই তিনি তাঁর সাথী ‘রেড ভলেন্টিয়ার্স’ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপন্ন মানুষের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।

গত ৩১শে মার্চ বিকালবেলার আকস্মিক টর্নেডোতে জীবন ছাড়খাড় হয়ে যাওয়া গরীব প্রান্তিক জলপাইগুড়িবাসীর স্মৃতিতে আমাদের এই মিস্টার ‘নো ওয়ান’এর উপস্থিতি এখনও টাটকা। খবর পেয়েই আহত-আক্রান্তদের নিয়ে ছুটে গেছেন সরকারী হাসপাতালে, ব্যবস্থা করেছেন চিকিৎসার। স্থানীয় প্রশাসন যখন ঘূর্ণিঝড়ের অভিঘাত সামলাতে ব্যস্ত, তখন মাথার ওপরের ছাদ হারানো গরীব প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য তিনি ও তাঁর ‘রেড ভলেন্টিয়ার্স’ সাথীরা জোগাড় করেছেন শুকনো খাবার আর পানীয় জলের বোতলের। ঘটনার পর প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও যখন সর্বস্ব হারানো পরিবারগুলোর কপালে সরকারী ত্রাণ বলতে জুটছে শুধুই ত্রিপল, তখন ঐ রেড ভলেন্টিয়ার্সরাই দলবেঁধে খুলেছেন লঙ্গড়খানা। ব্যবস্থা করেছেন আর্ত মানুষগুলোর জন্য দুপুর ও রাতের দু-মুঠো ভাত-ডালের। না, এ কোন ‘টেলি’ বা ‘টলি’ নায়িকার লোক দেখানো প্রতিযোগিতামূলক রান্নাবাটি খেলা না। এ হলো সব পাতে ভাতের লড়াই। এখানে বগলে করে মিডিয়ার বুম-ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে মাটির উঠোনে পাত পেড়ে ভাত খাওয়ার ‘পোজ’ দিয়ে ফুটেজ খাওয়ার গল্প নেই। তাই তার ফেসবুক প্রোফাইল তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাবেন না সেরকম কোন ছবি। আসলে তিনি তো ‘নো ওয়ান’। তাই মানুষের ভিড়ে মিশে থাকাতেই বোধহয় তার আনন্দ। টর্নেডো আক্রান্ত মানুষগুলোকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তাদের সাথে যখন কথা বলছিলেন তখন কেউ একটা সেই ছবি তুলে বাজারে ছেড়ে দিয়েছিল। ছবিটা ভাইরাল হয়ে যায়। প্রমাণ হয়ে যায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নন, প্রথম আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। কেন এটা প্রমানের দরকার ছিল, সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরেই। যদিও তার সমাজমাধ্যম প্রোফাইল তন্নতন্ন করে খুঁজেও এমন নিজের ঢাক নিজে পেটানোর ছবি খুঁজে পাবেন না। পাবেন অন্য ছবি। ‘মিস্টার নো ওয়ান’ ও তার সঙ্গী ‘নটিলাস’ দু চাকার বাইকের ছবি। পাবেন স্ত্রী ও সন্তানের সাথে ছবি। পাবেন তার হারমোনিকা ও গিটার বাজিয়ে ‘বসন্ত এসে গেছে’ গানের ভিডিও। বলতে ভুলে গেছি, আমাদের মিস্টার নো ওয়ান ভালো মাউথ অরগ্যান এবং গিটার বাজান। আর পাবেন লাল ঝান্ডা কাঁধে জনতার ভিড় নিয়ে মানুষের দোরে দোরে ঘুরে ভোট প্রার্থনার ছবি।

হ্যাঁ, তিনিই হলেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে জলপাইগুড়ি কেন্দ্রে বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী। নাম দেবরাজ বর্মণ। আমাদের মিস্টার ‘নো ওয়ান’। জলপাইগুড়ি’র বাম ভোট পুনরুদ্ধারে ছত্রিশ বছরের এই তরুণই হলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রীটের বাজি। আর তাই ভরা ভোট বাজারে বামপন্থী দলটির কর্মী সমর্থকদের তরফেই যে হাসপাতালে টর্নেডো আক্রান্ত মানুষের সাথে দেবরাজের কথোপকথনের ছবি বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এব্যাপারে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস নিশ্চিত।

দেবরাজ বর্তমানে সিপিআই(এম) এর যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই এর জলপাইগুড়ি জেলার সদস্য। তাই কেউ কেউ আবার বলছেন বিজেপি-তৃণমূল বাইনারি ভাঙতে দেবরাজই হলেন ক্যাপ্টেন মীনাক্ষীর ‘ক্যাপ্টেন নিমো’। যদিও বাম রাজনীতিতে দেবরাজের ‘হাতেখড়ি’ ছাত্রজীবনে। জলপাইগুড়ি আনন্দ চন্দ্র কলেজে এসএফআই এর হয়ে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সামলানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। এখন তিনি পেশায় স্কুল শিক্ষক। শাহুডাঙ্গীহাট পি কে রায় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ান। বিষয় ইংরাজী। আপাতত তিনি জনতাকে বোঝাচ্ছেন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের গুরুত্ব। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের লড়াই। জনতাও সাড়া দিচ্ছে। তাকে কাছে পেয়ে চা-বাগানের শ্রমিক বুকে জড়িয়ে ধরছে। তাদের বসতজমির জন্য অধিকারের লড়াইতে তাকে পাশে পেতে চাইছে তারা। চাইছে মজুরির নিশ্চয়তা। বন্ধ চা বাগান খোলার প্রতিশ্রুতি। চা-বাগানের শ্রমিক মহল্লার মহিলারা তাদের লড়াইয়ে চাইছে দেবরাজকে সঙ্গে পেতে।

এই মুহুর্তে জলপাইগুড়ি শহর জুড়ে তার হয়ে দেওয়াল লিখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুবতী ব্রিগেড। কাজের ফাঁকে, সংসার সামলে দিনে-রাতে দেওয়াল লেখার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সোহিনী রায়, পূর্ণা দত্ত, পিয়া শীল, পায়েল সরখেলরা।

কিন্তু এতকিছুর পরেও লড়াই কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। তাই জনসংযোগকেই দেবরাজ তার অস্ত্র বানিয়েছেন। কারণ তিনি জানেন মানুষই ইতিহাস লেখে। তার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতি বসুর সেই অমোঘ বাণীই তার পথ চলার রসদ। রোদ-ঝড়-জল উপেক্ষা করেই সাথী কমরেডদের নিয়ে পথ হাঁটছেন তিনি। পথ চলতি জনতাও থমকে দাঁড়াচ্ছে এক ‘নো ওয়ান’ তরুণের ‘সাম ওয়ান’ হয়ে ওঠার লড়াই দেখতে।

একটা সময় একটানা জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্র ছিল বামেদের অধীনে। তবে এই কেন্দ্রকে এই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক দলের শক্ত ঘাঁটি বলে চিহ্নিত করা যাবে না। গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে ফিরে তাকালে বোঝা যাবে, বারবার রঙ বদলাচ্ছে এই কেন্দ্রের। ২০০৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন সিপিএম নেতা। ২০১৪ সালে হয় পরিবর্তন। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরই এই কেন্দ্রেও ফোটে ঘাসফুল। আর গত লোকসভা ভোটে রঙ বদলে হয় গেরুয়া। জয়ী হয় বিজেপি। তাই এই কেন্দ্রের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছে সব মহল।

এবারের ভোটে লড়াইয়ে রয়েছেন বিজেপির বিদায়ী সাংসদ ডক্টর জয়ন্ত রায়, তৃণমূলের পক্ষে নির্মল চন্দ্র রায় যিনি আবার ধূপগুড়ির বিধায়কও এবং আমাদের প্রতিবেদনের মিস্টার নো ওয়ান বা ক্যাপ্টেন নিমো। বিগত সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে বামেরা সেভাবে জনমানসে দাগ কাটতে পারেনি। লড়াই মূলতঃ সীমাবদ্ধ থেকেছে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে। তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। জলপাইগুড়ির প্রার্থী বাছাই নিয়ে জেলা বিজেপিতে যেমন ডামাডোল চলেছে, তেমনই তৃণমূলও আর কোন ভালো প্রার্থী না পেয়ে একজন বিধায়ককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর এখানেই তাল ঠুকছে সিপিআই(এম)। একজন স্বচ্ছ তরুণ মুখকে সামনে এনে চাইছে জনমানসে দাগ কাটতে। ফেরাতে চাইছে পুরানো লাল দূর্গ।

কিন্তু জলপাইগুড়ি সত্যিই বসন্ত পেরিয়ে তীব্র বৈশাখী দাবদাহে লাল পলাশ ফোটাবে কি না, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ৪ঠা জুন পর্যন্ত।

তবে ভোটের ফল যাইহোক, আমরা চাইবো মিস্টার ‘নো ওয়ান’রা থাক। তা নাহলে আমজনতার ভিড়টা বড্ড একা পড়ে যাবে।

আর আপনারাও থাকুন আমাদের সঙ্গে। আমাদের প্রতিবেদন পড়ুন, কমেন্ট করুন এবং শেয়ার করুন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস