যেমন সুতো, তেমনই কাপড় / The Fate of Indians

আমাদের হাজার হাজার দৈনন্দিন ইস্যুর মাঝে বাজারী মিডিয়ার দ্বারা এক এবং অদ্বিতীয় ইস্যু হল আসন্ন লোকসভা নির্বাচন। আর এই নির্বাচনের দুই পক্ষকে নিয়েই বর্তমানে আমাদের মিডিয়া মহল ঘুরপাক খাচ্ছেন। বাস, ঘাট, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকায় তৈরি হওয়া পেল্লাই সংসদ ভবন পর্যন্ত আসন্ন লোকসভা নির্বাচনই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অবশ্য ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ নির্বাচনই এই দেশে রাজনীতিবিদদের “সৌভাগ্য” নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কারা রাজপথ দখল করবে তা এক্ষেত্রে খুব একটা বিবেচ্য নয়, আজ বিবেচ্য কে ক্ষমতা “দখল” করবেন। সেখানেও সমস্যা। কারণ, “আজকে যিনি দক্ষিণেতে, কালকে তিনি বামের, আজকে যিনি তেরঙ্গাতে, কাল ভক্ত রামের।” নচিদা এ সব কবেই বলে গিয়ে আজ বহাল তবিয়াতে শহিদ মঞ্চে “তুমি আসবে বলেই” গাইছেন। ভাবটা এমন যেন, কেউ ক্ষমতায় আসতে চান বলেই, ১৩ জন কর্মী প্রাণ দিয়েছিলেন।

তবে এই মুহূর্তে ক্ষমতার অধিকারী হওয়া বা ক্ষমতার লড়াইয়ের ময়দানে এগিয়ে থাকার আর এক রহস্য হল কে কতটা ধর্ম-জাত-সম্প্রদায় নিয়ে রাজনীতি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে পারবেন।

কাজেই এই মুহূর্তে বহু রাজনীতিকদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু তিনি কোন ডালে বসলে, নিজের “স্থাবর, অস্থাবর, বেনামী সম্পদ” সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। তাই এই মুহূর্তের রূঢ় বাস্তবতা হল, নির্বাচনে সুবিধা বলে যদি কোন কিছু থেকে থাকে, তবে তা কেবলমাত্র কিছু মুষ্টিমেয় রাজনীতিবিদদের জন্য, আমরা যারা সাধারণ জনগণ আছি তারা এই মুহুর্তে কেবল সংখ্যামাত্র।

তাই বারে বারে প্রশ্ন ওঠে, যে কোনো নির্বাচন দেশবাসীর জন্য দুই পয়সার মূল্য বয়ে আনে কি? নাহ্, তা আনে না, উল্টে মুল্য চোকাতে হয়, তা কখনো আবার সন্মানের বিনিময়ে অথবা প্রাণের বিনিময়ে। একটা নির্বাচনে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা হয়, এই অর্থের যোগানদাতা কারা? বিজয় মালিয়া, মেহুল চোকসী, আম্বানি, আদানি, বিনয় মিশ্র? নাকি এই দেশেরই ক্ষুধার্ত, দুর্বল, কঙ্কালসার কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর? কিন্তু তারা কি পায় এই নির্বাচন থেকে? ডাবল ডাবল চাকরি? ১০০ দিনের কাজের মজুরি? আবাস যোজনার ঘর? ডাবল ইঞ্জিন সরকার? কোনটা?

আসলে, এই নির্বাচন নামক আনুষ্ঠানিকতা হল একটা ফুটো কলসীর মত, যেখানে প্রতিদিন জনগণ অতি কষ্টে উপার্জিত অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দান করে থাকে।

আরও আলোচনার আগে বলে রাখি, নির্বাচনকে হেয় প্রতিপন্ন করা আমাদের উদ্দেশ্য একেবারেই নয়, বরং আমরা বাস্তবতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।

রাষ্ট্রের আইন-কানুন, নিয়ম নীতিমালা প্রণয়নের জন্য জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন, আর এই জনপ্রতিনিধি বাছাই করার সিস্টেম হিসেবেই আমরা নির্বাচনকে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু যদি দেখা যায় আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে নিজেরাই অবগত নন, তাহলে এই নির্বাচনের কি কোন যথার্থতা থাকে?

একজন সাংসদের কাজ হলো দেশের নীতি নির্ধারণ করা, আইন প্রণয়ন করা। দেশটা কিভাবে চলবে, কোন নীতিতে চলবে তা আইনসভায় বসে আলাপ আলোচনা করা, দেশকে দিক নির্দেশনা দেওয়া। দেশের মানুষের ভাল যেটা, সেটা গ্রহণ করা আর মন্দ যেটা তা প্রত্যাখ্যান করা। সাংসদ, বিধায়ক, কাউন্সিলররা যদি লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েতে পরস্পরের সাথে মারপিট করেন, অশ্রাব্য ভাষায় জাতিবিদ্বেষমূলক “খিস্তি” করেন, নিজের এলাকার কাজ ফেলে রিল বানান, কয়লা, গরু পাচার করেন বা নানাবিধ দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকেন এবং মানুষের নিত্যদিনের সমস্যাগুলো থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকেন, তাহলে তারা কিভাবে অন্যান্য বৃহৎ পদক্ষেপগুলো নেবেন? তাদের প্রধান যে কাজ, তা হল আইন প্রণয়ন করা, জনসেবা করা, মানুষকে তার প্রাপ্ত আধিকার পাওয়ায় ব্যবস্থা করা। আর বিধায়ক, সাংসদদের কাজ আরো বেশি, কোন আইনটা জনগণের জন্য কল্যাণকর আর কোন আইনটা অকল্যাণকর তা ঝাড়াই-বাছাই করা। যেটা কল্যাণকর সেটাকে বাস্তবায়ন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা, আর যেটা অকল্যাণকর তার যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য নিয়ে আইনজীবীদের পরামর্শ ইত্যাদি করে সেই অকল্যাণের বিপক্ষে দাঁড়ানো, এবং তা প্রচার করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো আজকের অধিকাংশ সংসদ সদস্যরা জানেনই না তাদের কাজ কি? তাই দেখা যায় যতটা না তিনি আইনবিধান নিয়ে ব্যস্ত, তার থেকে বেশি ব্যস্ত থাকেন নিজেদের আত্মস্তুতি করতে। তাই জনগণও নেতা নেত্রীদের কাছে যায় দেশের কল্যাণ নয়, বরং অকল্যাণ নিয়ে। তাদের ড্রয়িং রুম আর অফিস গিজ গিজ করে এলাকার জনতার ভারে, যারা তাদের নির্বাচিত নেতার কাছে যায় বিভিন্ন অদ্ভুত কারণে। যার মধ্য অধিকাংশ বেআইনি তদবির, বেআইনি নিয়োগ, মাত্রাধিক দামে রাস্তাঘাটের টেন্ডার, ভাতা, অন্যকে ধরাশায়ী করা, মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি। এ সব দেখেই হয়ত সেই প্রবাদ চালু হয়েছিল, “যেমন সুতো, তেমনই কাপড়”।

এই কথা অস্বীকার করা অসম্ভব যে, বর্তমানে গণতন্ত্রের নামে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি চলমান। এর প্রভাব পড়েছে সমাজজীবনেও। যা দেশের যেকোন জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়ালেই পরিষ্কার দেখা যায়। কেবলমাত্র নিজের এক বা দীর্ঘকালীন সুযোগ-সুবিধার আশায় চোখ কান বুজে একটা নির্দিষ্ট দলের দাসত্ব করতে শুরু করেন কেউ কেউ। শুরু হয় লেজুড়বৃত্তি, কিন্তু ঐ দলটির জাতীয় আদর্শ কি বা কোন মতাদর্শের বিশ্বাসী তা অনেকেই জানেই না বা জানার দরকার মনে করে না। লোক দেখানো মিছিল হয়, মাঝে মাঝে বড় নেতানেত্রী “কেনা মিডিয়া”র ঘেরাটোপে করেন জ্বালাময়ী বক্তৃতা। তারপর ছাত্র ছাত্রীদের প্লেট থেকে চুরি করা ডিম, আর কৃষককে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে রাঁধা চাল দিয়ে, বিশেষ আহার, ডিম ভাত। তা এতে কি হয়? গ্রাম দখল করা যায়, টেন্ডারবাজী করা যায়, দাদাগিরি করার লাইসেন্স পাওয়া যায়, সাথে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু জাতির স্বার্থে, সুবিধাবঞ্চিতদের স্বার্থে তাদের কোন কার্যকলাপ লক্ষ্য করা যায় না। এভাবেই আজকের রাজনীতি হয়ে গেছে লেজুড়বৃত্তির আরেক নাম। কোন রকমে যেকোন একটা একটা দলের টিকিট পেলেই হলো, যেন কলাগাছ, ল্যাম্পপোস্ট হলেও সমস্যা নেই। ফলে যারা রাজনীতিকে পরিচালনা করছেন তারা একটা বিল আনলে তার কল্যাণ কি বা অকল্যাণই বা কি তা অধিকাংশই জানেন না এবং জানার দরকারও পরে না। সংসদে যখন কোন বিল উথাপন করা হয় তারপর সকলের সমর্থন পেয়ে স্পিকার যখন চিৎকার করে বলেন হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হোয়েছে, করুণ বাস্তবতা হচ্ছে স্পিকার নিজেই অনেক সময় জানেন না, যে তিনি কিসের উপর হ্যাঁ বললেন।

প্রচলিত সিস্টেমে একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে, সংসদ, বিধানসভা যাব না (এদের কেউ কেউ আবার ইডি, সিবিআই, সিআইডি ডাকলে সেখানে না গিয়ে আদালত বা হাসপাতালে জন্য, কেউ আবার এমনি যান না)। তাহলে যারা বিধানসভা, সংসদে গেল না, বিল উথাপন করলো না, আলোচনা পরামর্শ করলো না, তাদের সাংসদ, বিধায়ক বানিয়ে লাভটা কি? আমরা দেখি একজন বিরোধী দলের নেতা থানার অফিসারের কাছেও কোন দাম পায় না। কারণ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ অফিসার সরকারী দলের ফরমায়েশে কাজ করে, কখনো টাকা তোলে। তাই, তার কাছে সরকারী দলের একটা পঞ্চায়েত প্রধানের যে দাম থাকে বিরোধী দলের সর্বোচ্চ নেতার সেই দাম থাকে না। কারণ ঐ অফিসার জানে সরকারী দলের কাছেই সবকিছু। তাহলে যে সরকারি দলের সদস্য নয়, তার কোন মূল্য নেই।

এদেশের রাজনীতির আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো নানান জনসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা-নেত্রীদের ছাড়াও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে গালাগালি। কে কত অশ্লীলভাবে গালাগালি করতে পারে, তাদের বাপ-মা-জাতি-ধর্মকে কে কত ভাবে ঘায়েল করতে পারে তার প্রতিযোগীতা শুরু হয়। কিন্তু জনগণের জনজীবনের দিক নির্দেশনার যে বিষয়টা, তা বরাবরই আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। কোন আইন পুরোনো হয়ে গেছে, কোন আইন এখন একান্ত প্রয়োজন, কোন আইন বাতিল করা উচিত তার দিকে রাজনীতিকদের কোন ভ্রক্ষেপ নেই। দুই ঘণ্টার সংসদ অধিবেশন হলে দেড় ঘণ্টাই চলে গালাগালি, খিস্তি খেউড়। তারপর পান থেকে চুন খসলেই ওয়াক আউট। এই ওয়াক আউটকে প্রতিষ্ঠা যে কে করেছে তা বোঝা বড় দায়। নেতাদের স্বার্থবাদী মত প্রতিষ্ঠিত না হলেই, তিনি সংসদ, বিধানসভা থেকে রাগ করে বের হয়ে চলে আসেন যার পোশাকি নাম ওয়াক আউট। কিন্তু ন্যায় তো ন্যায়ই। জনগণের কল্যাণ যেটাতে হবে, তা একজনে বললেও যেমন গৃহীত হওয়া উচিত তেমনি যেটা জাতির জন্য ক্ষতিকর তা ৫৪৫ জনের ভেতরে ৫৪৪ জনে পক্ষ নিলেও তা বর্জিত হওয়া উচিত। এমন সিস্টেমই আমাদের কাম্য। কিন্তু “পচা” সুতো দিয়ে উৎকৃষ্ট মানের বেনারসী তৈরি হয় না, কোনোভাবেই হয় না।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস