পুরানো কাসুন্দি থেকে আগামীর আচার / The Mustard Sauce

২০১৩ সালের এপ্রিলে সারদা গোষ্ঠীর পতন হয়েছিল। তারপর নিখোঁজ সারদা কর্তার খোঁজ আচমকা দিয়ে দিলেন কোন পুলিশ কর্তা নন , মুখ্যমন্ত্রী। জানালেন, “ও উত্তরে আছে”। দুদিন পরেই দিল্লি বিমানবন্দরে হাসিমুখের সারদা কর্তা কে সঙ্গীনিসহ দেখা গেল পুলিশি হেফাজতে। কাশ্মীরের সোনমার্গ থেকে নাকি গ্রেফতার হন সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়। পরে বাকিদেরও গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শ্রী কুনাল ঘোষ। তিনি বারবার বলে আসছিলেন, তাঁকে সামনে রেখে সারদা গোষ্ঠীর থেকে নানা সুবিধা নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। সিবিআই-কে লেখা ৯১ পাতার একটি চিঠিতে কুণালবাবু অভিযোগ করেছিলেন, সারদা গোষ্ঠীর থেকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও কুণালবাবু – মদন মিত্র, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী প্রমুখের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থও এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে দাবি করেন কুণালবাবু। আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন তিনি। এর জেরে রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন পড়ে যায়। কুনাল বাবু জেল থেকেই ‘বিশ্বস্ত লোক’ মারফত সিবিআই অফিসে চিঠি পাঠান। তাঁর দাবি ছিল, রাজ্য পুলিশ তদন্তের নামে প্রহসন করেছে। সিবিআই তদন্ত হলে ‘সত্য উদঘাটিত’ হবে। এদিকে তদন্ত শুরু করে বিধাননগর কমিশনারেট।

তারপরে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে, খাতায় কলমে এখনো চলছে। এক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, রাজ্যে চিটফান্ড কাণ্ড সামনে আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছিলেন (সিট)। সেই দলের নেতৃত্বে প্রথমে ছিলেন বিধাননগর কমিশনারেটের সুপার অর্নব ঘোষ। তদন্তের কিছু দিন পর থেকেই এই অফিসারের নামে প্রমান লোপাট করার গুরুতর অভিযোগ আসতে শুরু করে। এরপর তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন রাজীব কুমার। যদিও সিবিআইয়ের অভিযোগ, তিনি নথিপত্র বিকৃত করেছেন। কারণ সিবিআই কে দেওয়া সারদা কর্তার বয়ান অনুসারে চিটফান্ডের যাবতীয় লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভানশালী ব্যক্তি যারা বিপুল “সুবিধে” নিয়েছেন , তাদের নামের তালিকা তিনি রেখেছিলেন একটি লাল ডায়েরিতে। সেই লাল ডায়েরি রয়েছে কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লকারে। সিবিআই সেই লাল ডায়েরি বাজেয়াপ্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, অর্ণব ঘোষ এবং রাজীব কুমারের নেতৃত্বে সিট এসে লকার থেকে সেই লাল ডায়েরি সহ যাবতীয় নথি আগেই বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই “লাল ডায়েরি”র খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই নিয়ে সিবিআই এবং সিটের দীর্ঘ টানাপোড়েন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এরপরে একদিন সিবিআইয়ের রাজীব কুমারের বাড়িতে অভিযান, পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি, মুখ্যমন্ত্রীর ধর্ণা, আরো কত কি!

আজ এগারো বছর পরে সেই পুরোনো কাসুন্দির চরিত্রদের স্ট্যাটাস কি, তা জেনে নেওয়া যাক।

চিটফান্ড মালিক: প্রতারিত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, বর্তমানে জেলবন্দী।
চিটফান্ড মালিকের বান্ধবী: তিনিও জেলবন্দী
বিগেস্ট বেনিফিশিয়ারি: আনন্দে আছেন, রিয়েলিটি শো’তে যাচ্ছেন, সিবিআই-ইডির খাতায় ওনার নামে অভিযোগ শূন্য
শ্রী কুনাল ঘোষ: সারদা কান্ডে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী বলে যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন, তারই দলের মুখপাত্র
অর্ণব ঘোষ: বেপাত্তা । চাকরি করছেন না ছেড়ে দিয়েছেন কেউ জানে না। কোথাও নামোল্লেখ অব্দি হয় না। সিবিআই তার খোঁজও করেনি।
রাজীব কুমার: পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের বর্তমান ডিজি
মদন মিত্র: বর্তমানে উনি গায়ক, অভিনেতা, ইউটিউবার এবং মাঝে মাঝে রাজনীতিবিদ
মুকুল রায়: বিজেপি ঘুরে আবার তৃণমূলে ফিরে, বর্তমানে বয়সজনিত কারনে অসুস্থ
শুভেন্দু অধিকারী: তিনি এখনও বিজেপিতেই আছেন, কিন্তু তার পরিবারের বাকিরা খাতায় কলমে তৃণমূলে।
সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ: ২০২১ সালে ইডি-র দফতরে দেড় ঘণ্টা জেরা হওয়ার পর, তার খোঁজ মিডিয়াতে পাওয়া যায়নি।

আজ শাহজাহান ঠিক সুদীপ্ত সেনের কায়দায় রাজ্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন। আর কে জানে, যা চলছে বঙ্গে, ১০ বছর বাদে এনাকে আপনারা শাসক দলের মুখপাত্র বা বিরোধী দলনেতা বানিয়ে দিলে, অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তথাকথিত ‘রোহিঙ্গা’ কখন ‘রাষ্ট্রবাদী মুসলমান’ হয়ে যাবে হয়তো টেরও পাওয়া যাবে না!

না, রাইজ অফ ভয়েসেস কোন ভবিষ্যদ্বাণী করছে না। লোকসভা ভোটের পাতে পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে আগামীর আচার বানিয়ে পরিবেশন করছে মাত্র, যাতে টাকনা দিয়ে খাওয়া যায়।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস