মিসফিট সিট / Fish Out Of Water

মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া পনেরো দিন সময়সীমা অতিক্রান্ত। এখনও আনিস খানের খুনীদের “গরু খোঁজা” খুঁজছে পুলিশ। আর মজার ব্যাপার হল পুলিশ এই মুহুর্তে যাদের খুঁজছে তারাও পুলিশ। তাও সেই খুনী পুলিশের দলটাকে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে গড়া “সিট” পুলিশ এখনও ধরে উঠতে পারেনি।

স্বয়ং রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মত রাজ্যবাসীকে আস্বস্ত করেছিলেন পনেরো দিনের মধ্যে ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত চালিয়ে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আনিস হত্যাকান্ডের যবনিকা টানা হবে। কিন্তু কোথায় কি?

রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্তরের এমন নজিরবিহীন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে শেষ কবে ঘটেছিল আমাদের জানা নেই।

যে কোন মৃত্যু বা খুনই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু আনিস হত্যাকান্ডকে আর পাঁচটা খুনের সাথে গুলিয়ে ফেললে বেসাতি করা হবে। একদল পুলিশ রাতের অন্ধকারে লোকের বাড়িতে কড়া নেড়ে ঢুকে বাড়ির জোয়ান ছেলেকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে খুন করে পালিয়ে গেছে। কারণ ছেলেটি প্রতিবাদী। স্বভাবতই খবরটা চাউড় হতেই রাজ্য উত্তাল হয়ে ওঠে। কলকাতার রাজপথ ভরে যায় প্রতিবাদী মিটিং মিছিলে। মানুষের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে রাজ্যের অন্যান্য অংশেও। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে ওঠে যে সামাল দিতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক মনোজ মালব্যকে একই বিকেলে অল্প সময়ের ব্যবধানে উপর্যুপরি সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্যবাসীর কাছে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গঠনের কথা ঘোষণা করতে হয়। জানানো হয় পনেরো দিনের মধ্যে আনিস হত্যাকান্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ করে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে এবং দোষীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে। অথচ সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া পনেরো দিনের সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখনও আসল খুনীদের পরিচয় সামনে তো এলই না, এমনকি রাজ্য পুলিশের তরফে অথবা মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে তদন্তের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে রাজ্যবাসীকে অবহিত করবার প্রয়োজনটুকুও কেউ দেখালেন না। এটা কে কি বলবো ! ঔদ্ধত্য নাকি পলায়নপর মনোবৃত্তি!

আর সিট গঠনের ঘোষণা হতেই যেসব “ধান্দাশ্রী” সুশীল এবং সরকারী “সাপোর্ট” পাওয়া সংবাদমাধ্যম মুখ্যমন্ত্রী এবং ওনার তৈরি “সিট” এর প্রতি ভরসা রেখে এতদিন মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে বসে রইলেন এবং পনেরো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও খুনীরা ধরা পড়েনি দেখেও “স্পিকটি নট”, আমরা জানতে চাই তা কি শুধুমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে বলে নাকি নিজের নিজের মেরুদণ্ডটা খুঁজে পাচ্ছেন না বলে! মানে জানতে চাইছি এভাবে পালিয়ে বেরিয়ে আনুগত্য দেখিয়ে আর কদ্দিন!
উচ্চপর্যায়ের পুলিশ অফিসারদের নিয়ে তৈরি একটি বিশেষ তদন্তকারীদল নিজেদেরই অধস্তন ও সহকর্মী একদল পুলিশকে খুঁজে পাচ্ছে না এমন হাস্যস্পদ ঘটনা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!

আনিসের পরিবার ও প্রতিবেশীরা প্রশ্ন তুলছেন সিট কি আদৌ আনিসের খুনীদের খুঁজছে নাকি এই খুনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত শাসক ঘনিষ্ঠ একদল “সিভিক পুলিশ”, লোকাল থানার ওসি, হাওড়া গ্রামীণের শাসক ঘনিষ্ঠ পুলিশ সুপার এবং শাসক দলেরই কিছু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বাঁচানো জন্য একটা ফুলপ্রুফ গল্প খুঁজছে!

কেন এমন বিতর্কিত প্রশ্ন উঠছে স্থানীয় স্তরে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তাঁরা। বলছেন আনিস খানের দ্বিতীয় ময়না তদন্তের রিপোর্ট এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও সামনে আসেনি। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সেই রিপোর্টের কপি আনিস খানের পরিবারেরও পাওয়ার কথা। তাঁদের হাতেও সেই রিপোর্ট আসেনি। পরিবারের এবং স্থানীয়দের অভিযোগ আসল খুনিদের আড়াল করতে এখনও সাজানো গোছানো ‘ফুলপ্রুফ’ গপ্পো লেখবার কাজ চলছে। গপ্পো লেখা শেষ হয়ে গেলে তার সাথে খাপে খাপ মিলিয়ে প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট লেখা হবে। অথবা যে ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে এসেছে তার সাথে খাপে খাপ মিলিয়ে গপ্পো ফাঁদতে সময় লাগছে। তাই সিট পুলিশের তরফে “ইতনা সান্নাটা।”

ইতিমধ্যেই জনৈক তৃণমূল নেতার মুখ দিয়ে বলানো হয়েছিল আনিস খান নাকি তিনতলার ছাদ থেকে পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যায়। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আনিস খানের বাড়ির যে ছবি সামনে এসেছিল তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আনিস খানের মৃতদেহ যেখানে পড়েছিল সেটা ছিল বাড়ির সামনের দিক এবং সেদিকের বাড়ির দেওয়ালে এমন কোন পাইপ নেই। ফলে স্বভাবতই অন্য গপ্পের খোঁজে ফের “অ্যাকশন” শুরু হয়েছে। কাজেই একটু টাইম তো লাগবেই! আর অনেকটা একারণেই আনিসের খুনীরা নাকের ডগায় কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ইতিমধ্যেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কমবয়সী ছেলেমেয়েরা তাদের সহপাঠীকে হারিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। রাজপথ ভরে যাচ্ছে মিটিং-মিছিল ও প্রতিবাদে। তার নেতৃত্ব দিচ্ছে মূলতঃ বামেরা। কারণ আনিস খান বামপন্থী ছিলেন।

কিন্তু আমরা যারা এখনও শাসকের অঙ্গুলিহেলনে ওঠাবসা করছি এবং আনিস হত্যাকান্ড থেকে মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি তাদেরকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা রাইজ অফ ভয়েসেস এর পক্ষ থেকে মনে করিয়ে দিতে চাই।

মনে রাখবেন দৌড়ে পালানো ইঁদুর কিন্তু কাকের ছোঁ থেকে বাঁচতে পারে না। নানা রকমের সরকারী সাপোর্ট, পদোন্নতি, মাসিক ভাতা ইত্যাদি বহুমাত্রিক চাহিদার পৌনঃপুনিকতায় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে কাক এসে যায়।

ইনফ্যাক্ট কাক এসে গেছে।

কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর বানানো “সিট” কে জোর গলায় “মিসফিট” বলবার সময়ও এসে গেছে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস