ব্যারিকেডের ওপারে / The Iron Grip
প্রতিটি সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং জনতার মধ্যে একটি অনিবার্য দ্বন্দ্ব থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্র, যার প্রধান কাজ হলো জনগণের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা, প্রায়শই নিজেই এমন একটি যন্ত্রে পরিণত হয়, যা জনতার আওয়াজ দমিয়ে রাখতে চায়। ভারতের ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের ক্ষমতা ও অবস্থান টিকিয়ে রাখতে জনগণের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সম্প্রতি, আমরা এই দ্বন্দ্বের দুটি আলাদা কিন্তু প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেখেছি—কৃষক আন্দোলন দিল্লিতে এবং ডাক্তারদের আন্দোলন কলকাতায়।
দিল্লি: অন্নদাতাদের বিরুদ্ধে লোহার ব্যারিকেড
২০২০-২১ সালে, দিল্লির রাজপথে অন্নদাতাদের (কৃষকদের) এক বিরাট আন্দোলন ঘটেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার যে নতুন কৃষি আইনের প্রবর্তন করেছিল, তা নিয়ে লাখ লাখ কৃষক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের দাবি ছিল সহজ—তাদের কৃষি জমি, উৎপাদন, এবং জীবিকা রক্ষার জন্য ন্যায্যতা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবিকে মোকাবিলা করার পরিবর্তে তাদের আটকে রাখার চেষ্টা করল লোহার ব্যারিকেড দিয়ে। ট্র্যাক্টর, ট্রলি, এবং কাঁধে ব্যানার নিয়ে অন্নদাতারা যখন দিল্লির দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন তাদের রুখে দিতে দেখা গেল লোহার ব্যারিকেড, জলকামান, এবং টিয়ার গ্যাস।
এই ঘটনা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। যখন জনতা তাদের মৌলিক অধিকার ও জীবিকার জন্য সংগ্রাম করে, তখন তাদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়ার পরিবর্তে, তাদের প্রতিবাদ দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্র তার শক্তি প্রয়োগ করে। কিন্তু এই লোহার ব্যারিকেড জনতার অঙ্গীকার, দৃঢ়তা, এবং সংগ্রামকে থামাতে পারেনি। মাসের পর মাস ধরে চলা এই আন্দোলন অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারকে তাদের দাবির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য করেছিল।
কলকাতা: জীবনদাতাদের বিরুদ্ধে লোহার ব্যারিকেড
দিল্লির অন্নদাতাদের আন্দোলনের ছায়া পড়ে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও, তবে এবার তা জীবনদাতাদের (ডাক্তারদের) দাবির প্রেক্ষিতে। ২০২৪ সালে কলকাতায় ডাক্তারদের একটি আন্দোলন শুরু হয়, যার কেন্দ্রে ছিল সরকারী হাসপাতালে কর্মরতা ডাক্তারের ধর্ষণ করে খুন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের তরফে গোটা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার, দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের মতোই, তাদের দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে ডাক্তারদের আন্দোলনকে ঠেকানোর চেষ্টা করল। তারপর কি হয়ে চলেছে, তা আপনারা সকলেই জানেন।
এই ঘটনাগুলি আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন তোলে—রাষ্ট্র কি তার ক্ষমতা সংরক্ষণ করতে এতটাই মরিয়া যে তারা জনতার মৌলিক অধিকার এবং দাবিকে উপেক্ষা করতে পারে? অন্নদাতা এবং জীবনদাতা—উভয়েই সমাজের ভিত্তি। এরা শুধু নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, পুরো সমাজের মঙ্গলার্থেই সংগ্রাম করে। কিন্তু যখন তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য রাষ্ট্র যন্ত্র ব্যারিকেড তৈরি করে, তখন তা আসলে সেই ভিত্তির ওপরই আঘাত হানে।
ব্যারিকেডের ওপারে তবে কে দাঁড়িয়ে?
এই দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতিতে, ব্যারিকেডের একদিকে থাকে রাষ্ট্র, যার হাতে রয়েছে ক্ষমতা, প্রশাসন, এবং আইনশৃঙ্খলা। আর অন্যদিকে থাকে জনতা, যারা অন্নদাতা, জীবনদাতা এবং সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এই জনতার দাবি শুধু তাদের নিজেদের স্বার্থে নয়, সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তাদের কণ্ঠরোধ করতে চায়, তখন সেই লড়াই একতরফা থাকে না। লোহার ব্যারিকেড বা ক্ষমতার জোরে রাষ্ট্র হয়তো সাময়িকভাবে এই সংগ্রাম দমিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে জনগণের ইচ্ছাশক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকেই মাথা নত করতে হয়।
তাই, যখনই রাষ্ট্র জনগণের অধিকারকে অবজ্ঞা করে, তখন আমাদের উচিত মনে রাখা—ব্যারিকেডের অন্য প্রান্তে আমরা, অর্থাৎ সাধারণ মানুষই দাঁড়িয়ে আছি, এবং সেই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ না ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পায়।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Rathin Biswas
শাসকদের চেয়ে জনগনই বেশি শক্তিশালী, এটা বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে।
People are more Powerful than rulers, it is to be reminded time and again.
Les gens sont plus puissants que les gouvernements, il faut rappeler encore et encore.
La gente es más poderosa que los gobernantes, hay que recordarlo una y otra vez.