চাতুর্যের এক অনন্য প্রতীক / The Artist of Calculative Moves

বর্তমান সময়ে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান একেবারে আলাদা। তিনি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নেত্রীই নন, এক সময়ের বাম-প্রভাবিত রাজ্যকে দক্ষিণপন্থী ঘরানার রাজনীতির দিকে টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কারিগর। তার রাজনীতির গতি প্রকৃতি, এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, সাম্প্রদায়িক ও ঘৃণার রাজনীতি আজকের পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি স্তরে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চালে এমন অনেকই উঠে এসেছেন, যারা একসময় তারই দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মুকুল রায় (বর্তমানে তৃণমূলে ফিরেছেন এবং অসুস্থ), শুভেন্দু অধিকারী তার অন্যতম উদাহরণ। এককালে মমতারই ঘনিষ্ঠ নেতা শুভেন্দু আজ তার প্রধান বিরোধী, যেমনটা একসময় ছিলেন মুকুল রায়। এই ক্ষমতা বদল এবং বিরোধী শিবিরে যোগ দেওয়ার প্রবণতা মমতার রাজনৈতিক পরিসরে যে বিপুল পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তা স্পষ্ট। শুভেন্দুর মতো আরও অনেক নেতা, যেমন উদয়ন গুহ, কুনাল ঘোষ – যারা এক সময় তৃণমূলের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা বলতেন, এখন তৃনমূল দলের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন।

রাজনীতির এই নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ কি? এর উত্তর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি এমন একজন নেত্রী, যিনি প্রতিটি পদক্ষেপ সুচিন্তিতভাবে গ্রহণ করেন। তার রাজনীতির মূল মন্ত্র হল শক্তিশালী চালে নিজের প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা এবং প্রয়োজনে তাদের নিজেদেরই অস্ত্র দিয়ে প্রতিহত করা। কংগ্রেস ও বাম দল থেকে যারা বেরিয়ে মমতার শিবিরে যোগ দিয়েছেন, তারা আজ মমতাকে ভক্তিভরে সমর্থন করছেন। মমতার সাবেক কট্টর সমালোচকরা এখন তার সমর্থনে সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

যেমন একসময়ের বাম নেতা ঋতব্রত, রেজ্জাক মোল্লারা বাম রাজনীতিতে লেনিনের আদর্শ দেখলেও, আজ তারা মমতার মধ্যে সেই একই আদর্শ খুঁজে পান। একইভাবে প্রাক্তন বাম নেতা শঙ্কর, খগেন, মোদীর মধ্যে সমাজতন্ত্রের ছায়া দেখতে পান। এমন কি প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা নিশীথ প্রামানিক, তিনিও তৃণমূলের হাতেই তৈরি, এটা অনেকেরই আজ মনে নেই। আর এই ধরণের রাজনৈতিক রূপান্তর শুধু পশ্চিমবঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, বরং গোটা দেশের রাজনীতিতেও এক বিশাল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আজ যিনি এপাংয়ে, কাল তিনি ওপাংয়ে, পরশু ঝপাংয়ে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুধু এক রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। তার রাজনীতির মূলমন্ত্র হল সুচিন্তিত কৌশল ও পরিকল্পনা। তিনি প্রতিপক্ষকে তাদের দুর্বলতার দিক থেকে আক্রমণ করেন এবং নিজের রাজনৈতিক শক্তিকে আরও মজবুত করেন। যারা তাকে “কালীঘাটের ময়না” বলে একসময় অবহেলা করেছেন, তারাই পরে মমতার নেতৃত্বের সামনে মাথা নত করেছেন। অন্য দল থেকে যেমন অনেক নেতা তৃনমূল কংগ্রেসে এসেছেন, তেমন বহু নেতা আছেন যারা তৃনমূল দল ছাড়ার পর আবার তৃণমূলে ফিরে এসেছেন, যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কৌশলের আরেকটি দিককে ফুটিয়ে তোলে—প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিজেদের দলে ঠাঁই দিয়ে বিরোধিতার পরিসর নির্মূল করে দেওয়া। যেই একই প্রবণতা আমরা দেশীয় রাজনীতিতেও আমরা দেখি, সে বিজেপি হোক অথবা কংগ্রেস।

রাজনীতির ইতিহাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কৌশল এবং দূরদর্শিতার উদাহরণ বিরল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ, তার প্রতিটি চাল যে পরিকল্পিত তা বোঝা যায় তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যদি রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করতে হয়, তবে তা সহজে হবে না। এর জন্য প্রয়োজন তার প্রতিটি পদক্ষেপ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা এবং সুচিন্তিতভাবে রাজনীতি করা। কারন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন দক্ষ রাজনৈতিক কৌশলী, যিনি প্রয়োজনে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ আর বন্ধু নির্বাচন করতে পারেন। আর আলটপকা বক্তব্য, এটা তাঁর রাজনীতিরই অংশ, তাঁর আত্মরক্ষার অস্ত্র। বাংলার সামাজিক ও সংবাদ মাধ্যমের সৌজন্যে ট্রোলারের অভাব নেই, তাই গুরুত্বপুর্ণ প্রসঙ্গ চাপা দিতে, এই রকম আলটপকা মন্তব্যের জুড়ি মেলা ভার। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখবেন, সেই অস্ত্রে শান দিয়েই কুণাল ঘোষ থেকে দিলীপ ঘোষ, শতরূপ ঘোষ, সজল ঘোষ রাজনীতির আঙিনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন।

একটা কথা চালু আছে, “ভোটদাতাদের চেয়ে ভোটগণনাকারীরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় তৃনমূল কংগ্রেস এই প্রথাকে বাস্তবায়িত করেছে, এটি তার রাজনৈতিক জীবনে এক বড় প্রাপ্তি। তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শিবিরে, পরিকল্পনা ও কৌশলই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যে কৌশলে অনুব্রত, মানিক, সুদীপ, মদন, কুণাল ইত্যাদিরা দূর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েও জামিনে মুক্ত হয়ে যান, সিবিআই বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করার জন্যে একটি অনুবাদক খুঁজে পায় না, লালন শেখ সিবিআই কাস্টডিতে আত্মহত্যা করে, তাঁর ভাইপোর নাম কয়লা কেলেঙ্কারীর চার্জশিট থেকে বাদ পড়ে যায়, অথবা সিবিআই একজন সাংসদের আয়ের উৎস খুঁজে পায় না। তাই তাকে পরাজিত করতে হলে, তার প্রতিপক্ষকেও সমানভাবে পরিকল্পনামাফিক এবং দৃঢ়ভাবে এগোতে হবে। অন্যথায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে বিরোধীদের। কারন তাঁর রাজনৈতিক বিরোধী কে হবেন, তা তিনি নিজেই বেছে নেন। মানস ভূঁইয়া, শুভেন্দু অধিকারী থেকে কৃষ্ণ কল্যানী, পিএসি চেয়ারম্যান থেকে বিরোধী দলনেতা, সবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেছে দেওয়া অথবা তাঁর হাতে তৈরী, তাই বিরোধী শিবিরের কন্ট্রোলও থাকে ওনার হাতেই।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নেত্রী হিসেবে শুধু নিজের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করেননি, বরং গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রকে ঢেলে সাজিয়েছেন। তার এই পরিবর্তনশীল চরিত্র এবং চাতুর্যের জন্য, তাকে এলেবেলে ভেবে ফেলার ভুল করলে চরম মূল্য দিতে হতে পারে এবং হচ্ছেও। এখন তা যেমন হচ্ছে জুনিয়র ডাক্তারদের। মমতার বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলন ও ক্ষোভকে তাঁরা নিজেদের একক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করার “ভুল” করেছিল, তার মাশুল এখন তাদেরই গুনতে হচ্ছে। এখন তাদের অনশন মঞ্চ থেকে বলতে হচ্ছে, “মানবিক মুখ্যমন্ত্রী এতটা নিষ্ঠুর!” কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মঞ্চে যাবেন না, একমাত্র যেতে পারেন সেদিন, যেদিন এই জুনিয়র ডাক্তাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস