নিরো বনাম ন্যাড়া / The Carnival

১৫ই অক্টোবর, ২০২৪। এই দিনটি বাংলার ইতিহাসে এক গভীর দাগ রেখে গেল। একদিকে সরকার আয়োজিত পুজোর কার্নিভাল, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সংগঠিত দ্রোহের কার্নিভাল—দুই ভিন্ন বাস্তবতা, দুই বিপরীত শক্তির প্রকাশ। একদিকে তারকাখচিত, সজ্জিত, আড়ম্বরপূর্ণ শোভাযাত্রা, অন্যদিকে নির্যাতিতদের সুবিচারের দাবিতে সাধারণ মানুষের উত্থান। তবে, শেষ পর্যন্ত যে কার্নিভাল সত্যিকারের শক্তি প্রদর্শন করল, তা ছিল সাধারন মানুষের বিক্ষোভ, যা সমস্ত সরকারি আয়োজনকে ছাপিয়ে গেল।

এই দ্রোহের কার্নিভাল শুধুমাত্র একটি দাবির জন্য নয়, বরং প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও অবিচারের বিরুদ্ধে। আর জি করে নির্যাতিত ও নিহত জুনিয়র ডাক্তারের সুবিচারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে জয়নগর, বর্ধমান, যাত্রাগাছি, এবং ভূপতিনগরের নির্যাতিতদের সুবিচারের সাথে সাথে সমাজের সব রকমের অরাজকতার বিরূদ্ধে গর্জে ওঠার প্রতীক। এই আন্দোলন প্রতীকী মাত্র নয়, বরং একটি কঠোর সত্যের মুখোমুখি হওয়া—সাধারণ মানুষ আর অবিচারের শিকার হতে চায় না।

সরকার এই জনবিস্ফোরণকে ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ১৬৩ ধারা প্রয়োগ করে ব্যারিকেড তোলা হয়েছিল, যাতে মানুষ পথে নামতে না পারে। কিন্তু মানুষ ভয় পেল না, পিছু হটল না। মানুষের এই দৃঢ় প্রত্যয়ের সামনে সরকারকে অবশেষে মাথা নোয়াতে হল। আইনজীবী ও রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের হস্তক্ষেপে আদালত বলল, এই গণআন্দোলনকে আটকানো যাবে না। এবং জনস্রোত সরকারের লৌহকপাট নিমেষে লোপাট করে সুনামির মত আছড়ে পড়ল কলকাতার রাস্তায়।

এই জনপ্লাবন ছিল এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যূত্থানের নিদর্শন। কোনো রাজনৈতিক দলের পতাকা ছিল না, ছিল না কোনো নেতার প্ররোচনা, ধর্ম কিংবা দলের বিভেদও ছিল না। সেখানে ছিল শুধুই মানুষ, আর তাদের নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্যে এককাট্টা লড়াই। সেই মানুষগুলো, যারা বছরের পর বছর প্রতারিত হয়েছে তথাকথিত বেলতলার শাসকদের কাছে, তারা আজ আর মেনে নেবে না শাসকের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।

অন্যদিকে, যখন সাধারণ মানুষ তাদের অধিকারের দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে, তখন সরকার ছিল পুজোর কার্নিভালের উৎসবে মত্ত। একটি অভিজাত শ্রেণীর কাছে সমর্পিত এক আড়ম্বরপূর্ণ প্রদর্শনী, যেখানে প্রকৃত সমাজের কষ্টগুলোকে একধরনের পর্দার আড়ালে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলে। এই অন্ধত্ব এবং উদাসীনতা কবে সরকার বুঝবে? ইতিহাস বলে, রোমের সম্রাট নিরোও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন অনেক দেরিতে, যখন তিনি গণঅভ্যূত্থানের ভয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। কিন্তু যখন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রাস্তায় আছড়ে পড়ছিল, তখন সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন।

আজকের এই দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—জনগণকে চিরকাল প্রতারণা করা সম্ভব নয়। বেলতলার ‘ন্যাড়া’রা বারবার ঠকবে না। শাসকরা এই বার্তাটি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবে, ততই মঙ্গল। অন্যথায় ইতিহাস তার পথেই চলবে, এবং সেই পথ শাসকদের জন্য শুভ হতে পারে না।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস