‘এক ডক্টর কি মউত ২.০’ – ‘সেটিং’ / Chained by Shadows

আদালতে তিলোত্তমা ধর্ষণ ও খুন কাণ্ডে সিবিআই-এর বক্তব্য ছিল এটি একটি “বৃহত্তর ষড়যন্ত্র”। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ষড়যন্ত্রের শরিক কারা? এক সামান্য সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় কি সত্যিই একা এমন একটি পৈশাচিক কাজ করতে পারে, মানে একজনের পক্ষে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র করা কি সম্ভব ? নাকি ঘটনা ঘটার পর, একা সঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করার পিছনে বিশেষ প্রভাবশালীদেরকে আড়াল করতে, একটি সমষ্টিগত প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে? সিবিআই কি নিজেই সেই ষড়যন্ত্রের অংশ? বিচারব্যবস্থাও কি প্রকারান্তরে সেই ষড়যন্ত্রের শরিক হয়ে পড়ছে? সংবাদমাধ্যমও কি যথাযথ ভাবে আরজি কর কান্ডে তার ভূমিকা পালন করছে? হ্যাঁ, আরজি কর কাণ্ডে রাজ্য সরকার ও তার পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় সরকার ও তার অধীনস্থ সিবিআই, মহামান্য আদালত এমনকি মহামহিম সংবাদমাধ্যম- প্রত্যেকের ভূমিকাই আজ প্রশ্নের মুখে।

প্রথমত, রাজ্য সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন প্রথম থেকেই বিষয়টি বারে বারে আড়াল করার যে চেষ্টা করেছিল, বিভিন্ন সময়ে রাজ্য পুলিশ হত্তাকর্তাদের নানাবিধ অসংলগ্ন বয়ানেই তা স্পষ্ট। প্রথমে ‘আত্মহত্যা’র তত্ত্ব খাড়া করা এবং সেইমত পুলিশ কমিশনারের সাংবাদিকদের ডেকে নির্যাতিতার নাম প্রকাশ্যে বলা দিয়ে যার শুরু। পরবর্তীতে বেগতিক বুঝে ঢোঁক গিলে ধর্ষন ও খুনের কথা স্বীকার করলেও দায়সারা তদন্ত-পোস্টমর্টেম এবং সর্বপরি পুলিশি তৎপরতায় লাশ পোড়ানোর মধ্যে দিয়ে আসল সত্য লুকানোর যে প্রবণতা দেখা গেল তা এক কথায় নজিরবিহীন। আর তখন থেকেই জনমানসে প্রশ্ন উঠলো এর পেছনে কি কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজ করছে? সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় কি কেবল দাবার বোড়ে?

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সিবিআই-এর ভূমিকা অত্যন্ত সন্দেহজনক। সিবিআই একদিকে সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে সদর্পে ঘোষণা করে বলছে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথা, অথচ নিজে সেই ষড়যন্ত্রের শিকড়ে হাত দিতে তারা নারাজ। অন্তত আদালতে তাদের পেশ করা বিভ্রান্তিমূলক চার্জশিট সেকথাই বলছে। আমরা শিউরে উঠছি এটা দেখে যে সিবিআই এর মত একটি পেশাদারী তদন্তকারী সংস্থা আদালতে চার্জশিট পেশ করে বলছে কলকাতা পুলিশের এক ‘কামুখ’ সিভিক ভলেন্টিয়ার নাকি “বৃহত্তর ষড়যন্ত্র” করে রাতবিরেতে একটি সরকারী হাসপাতালে ঢুকে এক কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষন করে খুন করে দিয়েছে অথচ সেই সময় হাসপাতালে উপস্থিত অজস্র ডাক্তার-নার্স-কর্মীরা কেউ কিচ্ছুটি টের পায়নি। কিন্তু কেন এমন হাস্যকর দাবী করছে সিবিআই ? অবশ্য সিবিআই যে ক্ষমতার পুতুল থুড়ি তোতাপাখি তা আমরা বারবার দেখেছি, এমনকি আদালতও বারংবার তোপ দেগেছে। চিটফান্ড কেলেঙ্কারি বা নারদ স্টিং কান্ড থেকে থেকে শুরু করে আজকের কয়লা-গরু পাচার বা সাম্প্রতিক নিয়োগ দুর্নীতি বা রেশন চুরি, প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের বাঁচাতে এই সংস্থা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয় বারে বারে। এমনকি বগটুই কান্ডে মূল সাক্ষী লালন শেখের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় সিবিআই হেফাজতে। সেসময়ও প্রশ্ন উঠেছিল আসল দোষীদের আড়াল করতেই কি এই অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল? তিলোত্তমার ঘটনার তদন্তেও কি তাই হয়েছে মানে আসল দোষীদের আড়াল করতে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় কে বলির পাঁঠা করা হয়েছে?

তৃতীয়ত, বিচারব্যবস্থার ভূমিকাও যথেষ্ট সন্দেহজনক। সর্বোচ্চ আদালত সুয়ো মোটো করে তদন্ত দেখাশোনার ভার নিয়ে কেন একের পর এক তারিখ দিয়েছে, তার সঠিক ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। এটা মাথায় রাখতে হবে, যে মামলায় সঞ্জয়ের শাস্তি ঘোষণা হল, সেটা আর সর্বোচ্চ আদালতের মামলা এক নয়। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা কি আদৌ শাস্তি পাচ্ছে ? আদালত কি পারছে সুবিচার দিতে ? নাকি এজলাসে পেশ করা অজস্র বিভ্রান্তিতে ভরা চার্জশিটের মধ্যেই বিচারব্যবস্থা ঘুরপাক খাচ্ছে ?

চতুর্থতঃ, তিলোত্তমা কাণ্ডে “বৃহত্তর ষড়যন্ত্রকারী” হিসেবে কলকাতা পুলিশের এক সিভিক ভলেন্টিয়ার, সঞ্জয় দোষী প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির রিপোর্ট যা বলছে তাতে স্পষ্ট অকুস্থল চারতলার সেমিনার রুম নয়। আর যদি সত্যি সত্যি সেমিনার রুমেই ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয়ের পক্ষে সেই কাজ একা করা সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে “সঞ্জয় রাই কি দোষী?” আর “সঞ্জয় রাই কি একাই দোষী?” এই দুটো প্রশ্ন এক নয়। তৃণমূল প্রশাসন ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অধীনস্থ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এই প্রশ্ন দুটো গুলিয়ে দিতে চাইছে। আর এখানেই উঠছে একশ্রেণীর রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। তাদের এডিটর-ডেপুটি এডিটরগণ প্রাণপণ গলার শিরা ফুলিয়ে বলছে যে মানুষ প্রথম প্রশ্নটা করছে। কিন্তু আসলে আন্দোলনকারীরা এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ করছে দ্বিতীয় প্রশ্নটা। সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় ঘটনার সময় অকুস্থলে উপস্থিত ছিল তার প্রমাণ আছে ঠিকই, তার মানে এই নয় যে সে একা ছিল। এমনকি তিলোত্তমার বাবা একটি সংবাদমাধ্যম কে স্পষ্ট জানিয়েছেনে যে ডিএনএ রিপোর্টে অন্তত পক্ষে চারজন পুরুষ এবং দুইজন মহিলার ঘটনার সময় অকুস্থলে উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এরা কারা ? এদেরকে আড়াল করতেই কি দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের কোন রকম সুযোগ না রেখে তৃণমূলের পানিহাটির বিধায়ক তথা বিধানসভার মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষের ব্যবস্থাপনায় তড়িঘড়ি রীতিমত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাবা-মা’র মতামতের তোয়াক্কা না করে পানিহাটি শ্মশানে দেহ সৎকার করে দেওয়া হলো? কেনই বা রাতদখলের রাতে অকুস্থলে তথ্যপ্রমাণ লোপাটে হামলা হলো? এই প্রশ্ন গুলো উঠবেই।

আমরা যদি সত্যিই একটি সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করি, তবে এই প্রশ্নগুলোকে মাথায় রেখে ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং প্রকৃত দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া আবশ্যক। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, তিলোত্তমার ন্যায়বিচার কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত একটি কষ্ট কল্পনা মাত্র। আর বাজারেও তাই এই মুহুর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে ‘শূন্য’ বামেদের তোলা “সেটিং” তত্ত্ব। মানুষ বলতে শুরু করেছে ‘প্রাতিষ্ঠানিক খুন’ চাপা দিতে ‘প্রাতিষ্ঠানিক সেটিং’ হয়েছে। কলকাতার ‘নীল-সাদা শাড়ি’কে বাঁচাতে দিল্লির ‘দাড়িওলা ফকির’ সেটিং এর ঝোলা নিয়ে ঝাঁপিয়েছে। আর তাই তিলোত্তমার বিচারের নামে রাষ্ট্রযন্ত্রের এই ধ্যাষ্টামো!

এব্যাপারে আপনাদের কি মত জানান আমাদেরকে। লিখুন কমেন্ট বক্সে।

পাশাপাশি এটাও জানিয়ে রাখা দরকার, এভাবে মানুষ ক্রমাগত সুবিচারের নামে প্রতারিত হতে থাকলে সরকার প্রশাসন বিচারব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থাটা কিন্তু উঠে যাবে। আস্থাটা যে ক্রমশ উঠে যাচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে আর জি কর আন্দোলনে। তাই একটি সভ্যদেশের শাসক ও প্রশাসনযন্ত্রের হত্তাকত্তারদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ এভাবে মানুষের ধৈর্য্যের অযথা পরীক্ষা নেওয়াটা আদৌ বিচক্ষণতার পরিচয় নয়। কে বলেছে “হিউম্যান মেমরি ইজ ভেরি শর্ট”! মানুষ সব মনে রাখে। মানুষই মানুষের ইতিহাস লেখে।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস