বিরলতম “সেটিং” / The Curious Case of ‘Setting’

সিবিআই পারল না।
আসল দোষীদের আড়াল করবার উদ্দেশ্য নিয়ে আর.জি. কর কান্ডের কেসটা ঢেলে সাজাতে গিয়ে কলকাতা পুলিশ যেমন সেমিনার রুমে ‘লালাজামা’ পরা তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক অভীক দে’র মধ্যে এক ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞকে আবিষ্কার করে হাসির খোরাক হয়েছিল, সিবিআইও ঠিক তেমনি তদন্ত সংক্রান্ত একগাদা অসঙ্গতি ও পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব খাড়া করে জনসমক্ষে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ফেলল, প্রশ্ন তুলে ফেলল নিজেদের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। যেমন:
ক) সিবিআই পারল না নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করতে হাসপাতালের ঠিক কোথায় ধর্ষণ ও খুন হয়েছে! অথচ চার্জ গঠন হয়ে গেল ।
খ) ঠিক কজন জড়িত এই জঘন্য অপরাধের সাথে,একজন না কি একাধিক অপরাধী রয়েছে এর পিছনে সিবিআই সেটাও চার্জশিটে ঠিক করে বলতে পারল না।
গ) ধর্ষন করে খুন নাকি খুন করে ধর্ষন এই ব্যাপারেও ধোঁয়াশা রয়ে গেল।
ঘ) ২৪ ঘণ্টা আটোসাটো নিরাপত্তায় মোড়া সরকারি হাসপাতালের মত পাবলিক প্লেসে ধর্ষন ও খুনের ঘটনা ঘটলেও সিবিআই খুঁজে পেল না একজন সাক্ষীকেও! এও এক বিরলতম ঘটনা।
ঙ ) ঘটনার পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও এসে পৌঁছাল না মৃতার ভিসেরা রিপোর্ট এবং সিবিআই যে এই ব্যাপারে খুব একটা তদ্বির করেছে বা জোগাড় করতে তৎপরতা দেখিয়েছে তেমনটা আমাদের জানা নেই। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, খুন হয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই ওই মহিলা চিকিৎসক তার কয়েকজন সহকর্মীর সাথে ফুড অ্যাপ থেকে খাবার আনিয়ে একসাথে খেলেও, সেই খাবারের প্যাকেট গুলো বিস্ময়কর ভাবে পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই পরিকল্পনা মাফিক কুকর্ম করবার আগে ঐ মহিলা চিকিৎসকের খাবারে কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না তা জানতে ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পাওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু সিবিআই তা জানতে চায়নি বা জানবার চেষ্টাও করেনি।
চ) মৃতা চিকিৎসকের শরীরের ডিএনএ রিপোর্টে ঘটনার সময় অন্তত চারজন পুরুষ ও দুই জন মহিলার উপস্থিতির ইঙ্গিত থাকলেও সিবিআই এরা কারা তার খোঁজ করে ধরে এনে তাদেরকে সেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। সিবিআই জানলো কি করে যে বাকি যাদের ডিএনএ পাওয়া গেছে তারা নির্দোষ ? এরা কেউ যে এই জঘন্য অপরাধে সঞ্জয় রায়ের সহযোগী নয় সিবিআই সেটা আগেভাগে ধরে নিল কেন? কাদের কে আড়াল করতে? প্রশ্ন গুলো উঠবেই।
এত অসঙ্গতির মধ্যেও সিবিআই শুধু যেটা প্রমাণ করতে পেরেছে তা হলো খুন ও ধর্ষণের ঘটনাটি ঠিক যে সময়ে ঘটেছিল সেই সময়ের আশপাশে অভিযুক্ত সিভিক সঞ্জয় রায় হাসপাতালের ‘অকুস্থল’ (যদি সেটা আদৌ চার তলার সেমিনার রুম হয়ে থাকে) লাগোয়া চত্বরে উপস্থিত ছিল এবং কোনভাবে সে খুন হওয়া নির্যাতিতার শরীরের সংস্পর্শে এসেছিল। এমনকি মেয়েটির সাথে যে সে বলপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিল তারও স্পষ্ট আভাস মিলেছে। মানে এটা স্পষ্ট সে এই অপরাধের সাথে যুক্ত। কিন্তু কতখানি যুক্ত আদৌ সে ধর্ষণ বা খুন করেছে না কি এই কুকর্মে আর পাঁচজনের সহযোগী ছিল নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ বাকি যেসব পুরুষ ও মহিলার ডিএনএ পাওয়া গেছে তা সন্দেহভাজনদের ডিএনএ’র সাথে মিলিয়ে দেখার কোনও চেষ্টাই সিবিআই এর তরফে করা হয়নি।
এখানে আরও যেটা বলা প্রয়োজন সেটা হলো যদি অকুস্থল ঐ চারতলার সেমিনার রুম হয়ে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে সঞ্জয় রাই ছাড়াও ঐ চত্বরে সেই সময় আরও প্রায় ৬৭ জনের যাতায়াতের ফুটেজ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কেউ যে অপরাধটি সংগঠিত করতে সঞ্জয় রায়ের সাথে হাত মেলায়নি বা তাদেরই কারও ডিএনএ যে মৃতার দেহে পাওয়া যায়নি এমনটা তদন্ত ও পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হলো কি করে সিবিআই, এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। পাশাপাশি ঠিক যে সময় আর.জি. করে খুন ও ধর্ষনের ঘটনা ঘটছে সেই সময়ে আশেপাশে সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী অকুস্থল চত্বরে এতজন মানুষের যাতায়াত এটাই প্রমাণ করে চারতলার সেমিনার রুম চত্বর মোটেই সেরকম নির্জন নিশুতি জনবিহীন এলাকা নয়। কাজেই সিবিআই এর পক্ষে আর জি কর ধর্ষন ও খুন কান্ডের একজন সাক্ষীও খুজে না পাওয়াটা বলতে গেলে এক কথায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।
আর তদন্তে এইসমস্ত বিরলতম ব্যতিক্রমী ফাঁকফোকর থেকে যাওয়ার কারণেই অপরাধটি বিরলের মধ্যে বিরলতম হলেও অপরাধীকে বিরলতম সাজাটি দিতে গিয়ে বিচারককে ঢোঁক গিলতে হয়েছে। আর আমাদেরও তদন্ত জুড়ে এই সমস্ত ফাঁকফোকর গুলো মোটেই সিবিআই-সুলভ বলে মনে হচ্ছে না। বরং এর পিছনে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসছে তাতেই সিলমোহর দিতে হচ্ছে।
আসলে একটি বিরলতম শব্দবন্ধ বহুদিন হলো বঙ্গরাজনীতির অলিন্দে ঘুরে ঘুরে আসল দাগি অপরাধীদের আড়াল করে চলেছে। শব্দবন্ধটি হলো ‘সেটিং’! এর শুরুটা হয়েছিল চিটফান্ড কেলেঙ্কারী দিয়ে। তারপর একে একে নারদ স্টিং কান্ড থেকে শুরু করে আজকের কয়লা ও গরু পাচার বা সাম্প্রতিক নিয়োগ দুর্নীতি অথবা রেশন চুরি, প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই আমরা অনুভব করেছি “সেটিং” এর অমোঘ উপস্থিতি।
আমরা দেখেছি সেটিং সাম্রাজ্যে দাগি অপরাধীদের জামিন পাওয়াটাই দস্তুর । সেখানে এক্ষেত্রে একগুচ্ছ দাগিদের মধ্যে থেকে আসল রাঘব-বোয়ালদেরকে বাদ দিয়ে এক চুনোপুটি সিভিকের যে অন্তত যাবজ্জীবন হয়েছে এই অনেক! এখানে এটাও বলা দরকার এক্ষেত্রে জালে পড়া ‘চুনোপুঁটি’টিও যথেষ্ট দাগী। কাজেই এর মধ্যেই আমাদেরকে সান্ত্বনা খুজে নিতে হবে।
তাই সান্ত্বনা খুঁজুন ও ভালো থাকুন ।
জয় বাংলা। জয় শ্রী রাম।
ফুলের রাজ্যে বঙ্গ গদ্যময়,
জাস্টিস আজ যেন ঝলসানো রুটি।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.