সরযূর জল সমাধি — একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ / When Faith Pollutes

একবিংশ শতাব্দীতে যখন ভারতের মতো দেশ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও ডিজিটাল অবকাঠামোয় বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন অযোধ্যার সরযূ নদীতে “জল সমাধি” প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও নীতির স্ববিরোধিতা নিয়ে। রাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের মৃতদেহ পাথর বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাটি আইন, বিজ্ঞান ও রাজনীতির সংঘাতের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় জিগিরের কাছে কি নতজানু হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব?
ভারতের পরিবেশ সুরক্ষা আইন, ১৯৮৬ এবং জাতীয় হরিটেজ নদী মিশনের নির্দেশিকা স্পষ্ট করে: জলাশয়ে মৃতদেহ নিষ্পত্তি দূষণের অপরাধ। এমনকি ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ৩০১ অনুযায়ী, এ ধরনের কাজের সর্বোচ্চ শাস্তি ১ বছর কারাদণ্ড। অথচ, অযোধ্যার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে দেয়, আইনের প্রয়োগ শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (CPCB)-এর ২০২৩ সালের রিপোর্টে ইতিমধ্যে সরযূ নদীর জলে ফিকাল কোলিফর্মের মাত্রা নিরাপদ সীমার ৩০ গুণ বেশি বলে জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, একটি মৃতদেহ পচে গেলে তা ৫০ লিটার জল দূষিত করে, যা ১০০ জনের বার্ষিক পানীয় জলের সমান। তবুও, সরকারি নীরবতা কি প্রমাণ করে যে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ভোটব্যাঙ্কের ভয়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বলি হচ্ছে?
কোভিড-১৯ মহামারির সময় গঙ্গায় ভাসমান লাশের করুণ দৃশ্যের পর কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, “ভবিষ্যতে এমনটি আর কখনও হবে না।” অথচ ২০২৫ সালে একই নাটকের পুনরাবৃত্তি। উত্তরপ্রদেশ সরকার “স্বচ্ছ সরযূ মিশন”-এ ১,২০০ কোটি টাকা ব্যয় করলেও আইন প্রয়োগে শিথিলতা কেন?

ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্যক্তিগত অধিকার, কিন্তু তা যখন সমষ্টিগত স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি হয়, তখন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ জরুরি। গরুড় পুরাণের মতো ধর্মগ্রন্থেই শবদাহের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি বর্ণিত আছে। তাহলে কেন আধুনিক যুগে এসেও রাষ্ট্র কিছু গোষ্ঠীর কাছে পণবন্দি হয়ে পড়ছে? “স্বচ্ছ ভারত” বা “নমামি গঙ্গে” প্রকল্পের বুলি যখন শুধু বাজেট বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ, তখন সাধারণ মানুষ কি ভাববে — সরকারের অগ্রাধিকার কোথায়?
এই ঘটনার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। এটাই কি সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে? নাকি জনগণের ট্যাক্সের অর্থে গড়ে ওঠা “স্মার্ট সিটি” প্রকল্পগুলোর মতোই “জল সমাধি”ও একটি প্রহসন? যখন পরিবেশ আদালত (National Green Tribunal) বারবার নদী দূষণ রোধে কঠোর নির্দেশ দিচ্ছে, তখন স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা শুধু দর্শকের — এটি কি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার চূড়ান্ত প্রকাশ? কিন্তু প্রশ্ন হল, গ্রীন ট্রাইব্যুনাল কি পদক্ষেপ নেবে? দেশের বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়া কি প্রশ্ন তুলবে?
ভোটের লোভে কি পরিবেশ সুরক্ষার মতো সংবিধানিক দায়িত্বকে বলি দেওয়া যায়? ধর্মীয় অনুশাসন ও রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বন্দ্বে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? নদী দূষণ রোধে ব্যয় করা হাজার কোটি টাকা কি শুধুই কাগজে-কলমে সাফল্যের অঙ্ক?
উত্তর না দিয়ে সরকার যদি দুশো-পাঁচশ ভোটের জন্য এই নীতিহীনতা চালিয়ে যায়, তবে ভারতের গণতন্ত্রই প্রশ্নের মুখে পড়বে। আজ জল সমাধি, কাল হয়তো অন্য কোনো কুসংস্কার — রাষ্ট্র যদি নীরব থাকে, তবে ইতিহাসের বিচারে এই যুগই হবে “অন্ধকার যুগের পুনর্জন্ম”।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
জয়দীপ দত্ত
এরাই আবার ai নিয়ে বড় বড় কথা বলে।